প্রতিটি মানুষ স্বপ্ন দেখে। বেঁচে থাকার আর এক নাম স্বপ্ন দেখা। অথবা এভাবে বলা যায় যে, মানুষের স্বপ্নই তাকে বাঁচিয়ে রাখে। পৃথিবীতে যে মানুষ যত বড় হয়েছেন সে মানুষটির স্বপ্নও তত বড় ছিল। প্রতিটি স্বপ্ন মানুষ সফলভাবে বাস্তবায়ন করতে পারে তা হয়তো না, কিন্তু প্রতিটি সফলতার পেছনেই যে একটি স্বপ্ন ছিল তা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়। তাহলে স্বপ্ন কী? প্রচলিত অর্থে মানুষ যেটাকে স্বপ্ন বলে জানে আমরা তার কথা বলছি না। স্বপ্নের প্রচলিত অর্থ হলো মানুষ ঘুমের ভেতর অবচেতনভাবে যা অনুভব করে, অনেকটা সত্যি ঘটনার মতো। ঘটনাগুলি কাল্পনিক হলেও স্বপ্ন দেখার সময় সত্যি মনে হয়। অধিকাংশ সময় দ্রষ্টা নিজে সেই ঘটনায় অংশগ্রহণ করেছে বলে মনে করতে থাকে। এগুলো কল্পনা হতে পারে, অবচেতন মনের কথা হতে পারে, বা অন্য কিছুও হতে পারে। কিন্তু এই স্বপ্নগুলো একবারেই অর্থহীন। এগুলো সত্যিকারের স্বপ্ন নয়। তাহলে সত্যিকারের স্বপ্ন আমরা কাকে বলছি। সত্যিকারের স্বপ্ন সেটাই যা মানুষের আকাঙ্ক্ষা থেকে উৎসারিত হয়ে মানুষকে নতুন কিছু করতে উদ্দীপ্ত করে। নিজের, সমাজের এবং রাষ্ট্রের কল্যাণের জন্য মানুষের মনে যে তীব্র আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয় সেটাই প্রকৃত স্বপ্ন, সত্যিকারের স্বপ্ন। মানুষের মনের সুন্দর বিশ্বাসগুলোই হলো মানুষের স্বপ্ন যা সমস্ত প্রতিকুলতাকে অতিক্রম করে মানুষকে নিয়ে যায় সেই স্বর্গরাজ্যে, যেথানে প্রতিটি মুহূর্তে মানুষ বেঁচে থাকার অপার সম্ভাবনাকে দেখতে পায়। মানুষের অন্তর্দৃষ্টির এই গভীর পর্যবেক্ষণ এবং অবারিত আকাঙ্ক্ষাই স্বপ্ন। বিষয়টিকে চমৎকারভাবে বলেছেন ভারতের প্রয়াত রাষ্ট্রপতি একাধারে বিজ্ঞানী ও দার্শনিক এপিজে আবদুল কালাম। তিনি বলেছেন, “স্বপ্ন সেটা না যা তুমি ঘুমিয়ে দেখ। স্বপ্ন হলো সেটাই যা তোমাকে ঘুমাতে বাধা দেয়।” সত্যিইতো তাই। মানুষের মনে যখন কোন কিছু অর্জন করার তীব্র আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয় তা অর্জন না করা পর্যন্ত তার ভেতরে এক ধরনের উদ্দীপনা কাজ করতে থাকে যা তাকে ঘুমোতে বাধা দেয়। তাই সত্যিকারের স্বপ্ন হচ্ছে মানুষের বর্ণিল আকাঙ্ক্ষাগুলোর সুসজ্জিত সমাহার। এই আকাঙ্ক্ষাই মানুষকে পৌঁছে দিতে পারে তার স্বপ্নের তীর্থভূমিতে। জীবন চলার পথ মসৃণ নয়। নানা রকম বিষাদ, গ্লানি, দারিদ্র্য মানুষের কাঙ্ক্ষিত স্বপ্ন পূরণে বাধা হয়ে দাঁড়ায় বলে অনেকে মনে করেন। কিন্তু যাঁরা এই বাধাগুলো অতিক্রম করে জীবনযুদ্ধে সফলতা অর্জন করেছেন তারাই প্রকৃত স্বপ্নবাজ। প্রতিকূলতা আছে বলে হতাশাগ্রস্ত হয়ে জীবনটাকে অর্থহীন মনে করার কোনো কারণ নেই। পৃথিবীতে যত মানুষ সফলতার শিখরে আরোহণ করেছেন তাঁদের সফলতার পেছনে রয়েছে একটি স্বপ্ন। যে স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য তাঁরা আত্মবিশ্বাসের সাথে নিরলস পরিশ্রম করেছেন। স্বপ্ন হচ্ছে মানুষের মনের ভেতর তৈরি হওয়া একটি ভ্রুণ যা পৃথিবীতে দৃশ্যমান হয় এর সফল বাস্তবায়নের মাধ্যমে। কাজেই স্বপ্নকে মনের ভেতর লালন করলেই হবে না, স্বপ্নের সফল বাস্তবায়নের জন্য চাই কর্মনিষ্ঠা, একগ্রতা এবং মেধা বিনিয়োগ। মানব শিশুকে যেমন ধীরে ধীরে যত্ন করে লালন করতে হয় তেমনি স্বপ্নকে খুব যত্ন করে এর প্রসার এবং প্রতিষ্ঠা করতে হয়। আবারও এপিজে আবদুল কালামকে স্মরণ করতে হয়। স্বপ্নের বাস্তব রূপায়ণ প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন, “আকাশের দিকে তাকাও, আমরা একা নই। মহাবিশ্ব আমাদের বন্ধুপ্রতীম। যারা স্বপ্ন দেখে ও সেই মতো কাজ করে স্বপ্ন তাদের কাছেই ধরা দেয়।” ডব্লিউ এস ল্যান্ডেল বলেছেন, “সময় বেশী লাগলেও ধৈর্য সহকারে কাজ কর, তাহলে প্রতিষ্ঠা পাবেই।” ব্রায়ান ডাইসনের মতে “স্বপ্ন পূরণ জীবনের একমাত্র লক্ষ্য নয়, তাই বলে স্বপ্নকে ত্যাগ করে নয়, তাকে সঙ্গে নিয়ে চল।” স্বপ্ন ছাড়া জীবন অর্থহীন। কাজেই আমাদের স্বপ্ন দেখতে হবে এবং স্বপ্নকে সফল করার জন্য প্রচুর পড়াশুনা করতে হবে, অধ্যাবসায় করতে হবে, আত্মবিশ্বাস বাড়াতে হবে, প্রতিভাবানদের জীবনী অনুসরণ করতে হবে, ভাল মানসিকতা নিয়ে মানুষের সাথে মিশতে হবে, পরিশ্রম করতে হবে। কোন পেশাই নিন্দনীয় নয় যদি সেখানে দক্ষতার সাথে কাজ করা যায়। কাজকে ভালবাসা যায়। কাজেই প্রত্যহই আমরা অস্যংখ্য সুন্দর স্বপ্নকে মনের মাঝে ধারণ ও লালন করে যাব। আবারও সেই মহান পুরুষ এপিজে আবদুল কালাম–এর উদ্ধৃতি দিয়ে শেষ করবো। “সূর্যের মতো দীপ্তমান হতে হলে নিজেকে প্রথমে সূর্যের মতই পুড়তে হবে।”