এ সময়ের প্রতিষ্ঠিত অনেক খ্যাতিমান লেখক ও সাহিত্যিকদের জীবনের প্রথম লেখা ছাপা হয় স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সংবাদপত্র দৈনিক আজাদীর পাঠকপ্রিয় ‘আগামীদের আসর’–এ। কচি হাতে লেখা কবিতা, ছড়া ও গল্প ছাপিয়ে ‘আগামীদের আসর’ এর মাধ্যমে আজাদী যেন তাদের মনে কবি, ছড়াকার বা গল্পকার হওয়ার সূক্ষ্ম বীজ বুনে দেয়। তাইতো আগামীদের আসর–এর মাধ্যমে ছাপা অক্ষরে প্রথম নিজের নাম দেখে উচ্ছ্বসিত সেই কিশোর–তরুণদের অনেকে আজ চট্টগ্রামের গণ্ডি পেরিয়ে দেশে–বিদেশে লেখক, কবি, ছড়াকার ও প্রাবন্ধিক হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেছেন।
শব্দের বুননে যারা একসময় আগামীদের আসর রঙিন করে তুলেছেন সময়ের পরিক্রমায় এদের অনেকে চট্টগ্রাম থাকেন না। কিন্তু আগামীদের আসর–এর প্রতি তাদের ভালোবাসা কমেনি এক ফোঁটা। তাই তো আজাদীর ৬৬ বছরে পদার্পণ উপলক্ষে ছুটে আসেন আগামীদের আসর–এর লেখকরা, হয় মিলনমেলা। তারা আজাদী মিলনায়তনে বসে খুলে দেন স্মৃতির ডানা। তুলে ধরেন আগামীদের আসর–এ নিজের নাম দেখার সেই প্রথম অনুভূতি। প্রকাশ করেন আজাদীর প্রতি ভালোবাসা ও কৃতজ্ঞতা। গতকাল বুধবার বিকেল ৫টায় শুরু হয় এ মিলনমেলা। রাত সাড়ে ৮টা পর্যন্ত চলা এ মিলনমেলায় সভাপতিত্ব করেন দৈনিক আজাদী সম্পাদক এম এ মালেক। এসময় তিনি বলেন, ১৯৬০ সালে যখন আজাদী বের হয় তখন আমার বাবাই কিন্তু ছোটোদের নিয়ে এই আসরটা পরিচালনা করেন। তিনি নিজেই নাম দেন আগামীদের আসর। আজকে যারা এখানে এসেছেন তাদের প্রতি আমার ভালোবাসা। আপনারাও আজাদী পরিবারের অংশ।
এম এ মালেক বলেন, আজাদী বের করার মাত্র দুই বছর পর বাবা মারা যান। তখন আমার একটা উদ্দেশ্য ছিল কাগজটাকে বাঁচিয়ে রাখা। আপনারা জানেন একটা পত্রিকা বাঁচিয়ে রাখা দুরূহ একটা ব্যাপার। তারপরও পাঠকের ভালোবাসায় আজাদী আগামী শুক্রবার ৬৬ বছরের পদার্পণ করছে। তিনি বলেন, বাবা একটা কাগজ দিয়ে গেছেন, আমার চেষ্টা ছিল সে কাগজকে বাঁচিয়ে রাখা। আপনাদের দোয়ায় এখনো পর্যন্ত সেই চেষ্টায় আমি সফল হয়েছি বলে মনে করি।
আজাদী সম্পাদক বলেন, আজাদীর এমন কোনো সেকশন নেই যেখানে আমি কাজ করিনি। প্রথম যখন আজাদী বের হয় তখন ক্রেতা কারা সেটা জানতাম না। আমি এবং আমার ভাগিনা ডা. আলী রেজা সাইকেল চালিয়ে আত্মীয়–স্বজনের বাসায় আজাদী দিয়ে আসতাম। কারণ কাগজ যখন বেরিয়েছে সেটা পড়তে তো হবে। কেউ না কেউ পড়ুক, পড়তে পড়তে অন্তত অভ্যস্ত হয়ে গেলে তারা বাসায় কাগজ রাখতে আরম্ভ করবে। তিনি বলেন, বাবা প্রথমে কাগজ দিতেন। আমিও কিন্তু প্রায় ১৮ থেকে ২০ বছর সকালবেলায় ওঠে হকার ভাইদের কাছে আজাদী পৌঁছে দিয়েছি। এখানে কাগজ পৌঁছে দেয়াটার মধ্যে লজ্জার কিছু নেই। কারণ আমি যে কাজের সঙ্গে আমি জড়িত সেটাকে মূল্যায়ন করতে হবে। আমি যে কাজ করি সেটা নিজেকেই মূল্যায়ন করতে হবে।
তিনি বলেন, আমার বাবা ছিলেন দূরদর্শী। ১৯৬০ সালে যখন আজাদী বের হয় তখন অর্গানাইজড কোনো হকার ছিল না। তখন ঢাকা থেকে কাগজ আসতো ট্রেনে, একদিন পরে। আমার বাবা খুব ধার্মিক ছিলেন। আজান দিলেই নামাজ পড়ার জন্য মসজিদে চলে যেতেন। মসজিদে অনেক ফকির আসত, ভিক্ষা করত। এমন ফকিরদের তিনি বললেন, তোমরা আমার সঙ্গে চল। তোমাদেরকে একটা কাজ দেই। বাবা তাদের আজাদী দিলেন বিক্রি করার জন্য। তখন একটা কাগজের দাম ছিল দুই আনা। দুই আনা মানে ১২ পয়সা। উনি ফকিরদের ১০টা করে কাগজ দিলেন। বিক্রি করে ওরা টাকা আনলে বাবা নেননি। এভাবে চারদিন যাওয়ার পর ৫ টাকা হল। তখন বাবা ফকিরকে বললেন, এ টাকা তোমার। তবে কাল থেকে নগদ টাকা দিয়ে কাগজ নিয়ে যাবে। ওদের ৪০ শতাংশ কমিশন দেয়া হতো। এভাবে হকারদের পুঁজির ব্যবস্থা করে হকারদের স্বাবলম্বী করে তুলেন আমার বাবা। সেই সময়ের দুইজন হকারকে আমি চিনি, যারা পত্রিকা বিক্রি করে হজ পর্যন্ত করে এসেছেন।
আজাদী সবসময় চট্টগ্রামকে প্রাধান্য দেয় জানিয়ে এম এ মালেক বলেন, অনেকে আমাকে প্রশ্ন করেন আজাদী ঢাকা থেকে বের করি না কেন। আমার উত্তর থাকে, ঢাকা থেকে বের হলে আজাদী জাতীয় পত্রিকা হবে ঠিকই। কিন্তু তখন আর চট্টগ্রামের পত্রিকা থাকবে না। এখন ত্রিশদিনের মধ্যে ২৮–২৯ দিনই আমরা চট্টগ্রামের খবর হেডলাইন করি। ঢাকা থেকে বের করলে তখন পুরো বাংলাদেশ নিয়ে লিখতে হবে। কিন্তু আমার বাবা আজাদী বের করেছেন চট্টগ্রামের সুখ–দুঃখের কথা কথা লেখার জন্য।
অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন দৈনিক আজাদীর সহযোগী সম্পাদক রাশেদ রউফ। বক্তব্য রাখেন আগামীদের আসর–এর বিভাগীয় সম্পাদক প্রদীপ দেওয়ানজী। আগামীদের আসর–এর লেখকদের মধ্যে বক্তব্য দেন, লেখক এমরান চৌধুরী, সঙ্গীতশিল্পী কেশব জিপসী, কবি নিশাত হাসিনা শিরীন, ছড়াকার মিজানুর রহমান শামীম, গল্পকার রোকসানা বন্যা, ছড়াশিল্পী আ ফ ম মোদচ্ছের আলী, কথাসাহিত্যিক নাসের রহমান, ছড়াশিল্লী তালুকদার হালিম, কবি জিন্নাহ চৌধুরী, আবৃত্তিশিল্পী সোহেল আনোয়ার, কবি শিবুকান্তি দাশ, ছড়াকার রমজান মাহমুদ, ছড়াকার রহীম শাহ, মেজর (অব.) এমদাদুল ইসলাম, কবি পঙ্কজ দেব অপু, কবি শামীম ফাতেমা মুন্নী, শিশুসাহিত্যক জসীম মেহবুব, প্রফেসর ডা. প্রণব কুমার চৌধুরী, কবি বিশ্বজিৎ চৌধুরী, অধ্যাপক মৃণালিনী চক্রবর্তী, কবি সাইফুদ্দিন আহমেদ সাকী, চলচ্চিত্র সমালোচক শৈবাল চৌধূরী, কবি নাজিমুদ্দীন শ্যামল, প্রাবন্ধিক ইকবাল হায়দার, ছড়াকার উৎপল কান্তি বড়ুয়া, কবি মর্জিনা আকতার, কবি প্রফেসর মুস্তফা কামরুল আকতার, কবি প্রফেসর মুজিব রাহমান, ছড়াশিল্পী প্রফসের আলেঙ আলীম, কবি অধ্যাপক সনজীব বড়ুয়া, কবি সৈয়দ খালেদুল আনোয়ার, শিশুসাহিত্যিক দীপক বড়ুয়া, গল্পকার বিপুল বড়ুয়া, প্রফেসর ড. মুন্সী আবু বকর, নবীন মেলার সভাপতি জামাল উদ্দিন বাবুল। অনুষ্ঠানে যাদু প্রদর্শন করেন যাদুশিল্পী রাজী বসাক।
প্রদীপ দেওয়ানজী বলেন, আগামীদের আসর শুরু করেছিলেন দৈনিক আজাদীর প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খলেক। এরপর অনেক গুণীজন এ পাতা সম্পাদনা করেছেন। অতীতের আগামীদের আসর লেখক সৃষ্টিতে ভূমিকা রেখেছে। আগামীতেও রাখবে।
রাশেদ রউফ বলেন, আজকে সবাই একত্রিত হয়ে ভালো লাগছে। লেখকের সঙ্গে সংযোগ স্থাপনের সুযোগ হয়েছে মিলনমেলায়।
মিজানুর রহমান শামীম বলেন, আমার লেখালেখির শুরু আগামীদের আসর দিয়ে। রমজান মাহমুদ আজাদীতে ছাপা হওয়া লেখা দিয়ে একটি সংকলন প্রকাশের প্রস্তাব করেন। রহীম শাহ বলেন, আজাদী ছিল বলেই রহীম শাহ, রহীম শাহ হতে পেরেছে।
কবি শামীম ফাতেমা মুন্নী বলেন, ফুলের কথা শিরোনামে ১৯৮১ সালে আমার প্রথম লেখা ছাপা হয়। তখন আমি ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্রী। এ স্মৃতি ভোলার না।
জসীম মেহবুব বলেন, প্রথম লেখা ছাপা হওয়ার যে অনুভূতি তার সঙ্গে অন্য কিছুর তুলনা চলে না। বিশ্বজিৎ চৌধুরী বলেন, আগামীদের আসর নিয়ে আজ সবার মধ্যে যে উচ্ছ্বাস সেটা বিস্ময়কর।
মৃণালিনী চক্রবর্তী বলেন, আগামীদের আসর–এর একটি প্রতিযোগিতায় প্রথম পুরস্কার পেয়েছি। এটা আমার জীবনের সবচেয়ে আনন্দের স্মৃতি।
সাইফুদ্দিন আহমেদ সাকী বলেন, ১৯৭৫ সালে ঈদকে কেন্দ্র করে আজাদীতে প্রথম লেখা ছাপা হয়। এটা আমার জীবনের চরম পাওয়া। তিনি বলেন, দীর্ঘদিন চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের জনসংযোগ কর্মকর্তা ছিলাম। মেয়রদের দেখতাম অন্য পত্রিকার চেয়েও আজাদীতে কর্পোরেশনের সংবাদ ছাপা হয়েছে কীনা খবর নিতেন।
নাজিমুদ্দীন শ্যামল বলেন, আজাদীকে আগের মত ১৬ পৃষ্ঠা দেখতে চাই। আগামীদের আসরও পূর্ণ কলেবরে দেখতে চাই। উৎপল কান্তি বড়ুয়া বলেন, আজকের মিলমেলা আগামীদের আসর–এর লেখকদের জন্য সম্মানজনক। মর্জিনা আকতার বলেন, আগামীদের আসর–এর শীত সংখ্যায় আমার প্রথম লেখা ছাপা হয়। সেদিনের সে প্রথম লেখা ছাপা হওয়ার আনন্দ আর কোথাও খুঁজে পাইনি।
প্রফেসর মুস্তফা কামরুল আকতার বলেন, ১৯৭৮ সালে আগামীদের আসর–এর পাতায় গল্প প্রতিযোগিতার আহ্বান করা হয়। ‘সীমান্ত’ শিরোনামে আমার একটি গল্প সে প্রতিযোগিতায় দ্বিতীয় হয়। সেটাই ছাপা পত্রিকায় আমার প্রথম গল্প।
প্রফেসর মুজিব রাহমান বলেন, আগামীদের আসর আমাদের তৈরি করেছে। আজাদীর প্রতি তাই কৃতজ্ঞ।
আলেঙ আলীম বলেন, আগামীদের আসর একটি জমি, এটা লেখক সৃষ্টির জমি।
অধ্যাপক সনজীব বড়ুয়া বলেন, ১৯৭১ সালের মার্চের মাঝামাঝিতে আগামীদের আসরের একটি লেখালেখির অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়। তখন আমি নবম শ্রেণিতে পড়ি। সেখানে আমার কচি হাতে লেখা প্রতিরোধ নামে একটি গল্প পাঠ করার সৌভাগ্য হয়।
সৈয়দ খালেদুল আনোয়ার ১৯৭০ সালের নভেম্বর মাসে আগামীদের আসর–এ ছাপা হওয়া তার প্রথম ছড়া পাঠ করে শুনান। ড. মুন্সী আবু বকর বলেন, আগামীদের আসর দিয়েই আমার লেখালেখি শুরু।
দীপক বড়ুয়া বলেন, ১৯৭০ সালে আগামীদের আসরে আমার প্রথম লেখা ছাপা হয়।