সম্প্রতি ডন পত্রিকায় পাকিস্তানের কায়েদে আযম বিশ্ববিদ্যালয়ের নিউক্লিয়ার পদার্থ বিদ্যার অধ্যাপক পারভেহ হুদভয়ের একটি আর্টিকেল প্রকাশিত হয়। তার অনুবাদ পড়ছিলাম। পড়ে এই করোনাকালের যাবতীয় অশান্তি মন থেকে সরে গিয়ে প্রশান্তিতে ভরে গেল। তিনি পাকিস্তানের অর্থনীতি ও সামাজিক অবস্থানের সাথে বাংলাদেশের অর্থনীতি ও সামাজিক অবস্থানের তুলনামূলক চিত্র তুলে ধরেন। তিনি পাকিস্তানকে পরামর্শ দিয়েছেন, “পাকিস্তানকে অবশ্যই যুদ্ধভিত্তিক অর্থনীতি থেকে সরে এসে একটা শান্তিপূর্ণ অর্থনীতির দিকে মনোযোগী হতে হবে। আর তা না হলে পাকিস্তানের অর্থনীতির অবস্থা তলানীতে গিয়ে ঠেকবে বলেও সাবধান করেছেন। তিনি আরও বলেন দুই দেশের জাতীয় আগ্রহ সম্পূর্ণ আলাদা। বাংলাদেশ তাদের ভবিষ্যৎ দেখছে ব্যক্তিগত উন্নয়ন ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে লক্ষ্য রেখে, তারা রপ্তানি বৃদ্ধি, বেকারত্ব হ্রাস, স্বাস্থ্য সেবার উন্নয়ন, বৈদেশিক ঋণের উপর নির্ভরশীলতা কমানো ইত্যাদি বিষয়ের উপর জোরারোপ করে এগিয়ে যাওয়ার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে। কিন্তু পাকিস্তানের এসব বিষয় নিয়ে যেন কোন ভাবনা নেই, পাকিস্তানের জন্য এসব বিষয় শিক্ষণীয় হতে পারে বলে তিনি মন্তব্য করেন। স্বস্তির ব্যাপারটা এখানেই। দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে যখন ভারতকে খণ্ডিত করা হলো স্বাধীনতার নামে তখনও পূর্ব বাংলা ও পূর্ব বাংলার মানুষকে অবমূল্যায়ন করা হয়েছে সাতচল্লিশে যারা স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন তারা নিজেরাও পূর্ববঙ্গের টিকে থাকা নিয়ে গভীর সন্দেহে ছিলেন। তখনকার গভর্নর ফ্রেডরিক ব্যারেজ প্রায় আতঙ্কিত কন্ঠে বলেছিলেন, কলকাতাকে বাদ দিয়ে পূর্ববঙ্গ কি করে হবে এতো হবে একটি গ্রাম্য বস্তি। মানুষের অনেক সম্পদ নেই। যা আছে তা হলো পাট। পাটই বা কি কাজে লাগবে যেখানে পাটকলই নেই। স্বয়ং জহরলাল নেহেরুও ভেবেছিলেন পূর্ববঙ্গ বড়জোর দশ বছর টিকবে। তারপরে তদবীর করবে ভারতের সাথে যোগ দিতে। বড়লাট মাউন্ট ব্যাটন জিন্নাহ বলেছিলেন বাংলাকে দুটুকরো মনে হয় করবেনই কিন্তু সেক্ষেত্রে আপনি পাবেন একেবারে মূল্যহীন খণ্ডটি। সেই মূল্যহীন খণ্ডটির প্রতি পাকিস্তানও সুবিচার করেনি। স্বাধীনতার স্বপ্ন অচিরেই দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়েছিল। পাকিস্তান সৃষ্টির পরপরই এদেশের মানুষ বুঝে গিয়েছিল এ তাদের দেশ নয়। ক্রমান্বয়ে ভাষার উপর আঘাত সাংস্কৃতিক উপর আঘাত, অর্থনৈতিক নিষ্পন্ন, গণতান্ত্রিক অধিকার হরণ, কি অসাধারণভাবে ঘুরে দাঁড়িয়েছিল সেই ভুখানাঙ্গা মানুষগুলো। দুই যুগ পেরুনোর আগেই একটা সামষ্টিক স্বপ্নকে সামনে রেখে এদেশের মানুষ বারুদের মত জ্বলে উঠেছিল, তারা জীবনকে তুচ্ছ করে ভাষাকে রক্ষা করেছে, সাংস্কৃতিকে রক্ষা করেছে, ক্রমাগত লড়তে লড়তে অনেক বেশি মূল্য দিয়ে স্বাধীনতাও অর্জন করেছে। তখনও এই জাতিকে অবমূল্যায়ন করেছে অনেকে। কিসিঞ্জার তো বলেই দিয়েছিলো এতো তলাবিহীন ঝুড়ি।” কেউ কেউ ভেবেছিল ভারতের অঙ্গরাজ্যে পরিণত হবে। আবার কেউ কেউ পাকিস্তানের সাথে কনফেডারেশন করার স্বপ্নও দেখেছিল। এ যেন সেই দরিদ্র পরিবারের মেধাবী ছেলেটার গল্প। ছেলেটির উত্তরণ প্রতিবেশীদের সহ্য হচ্ছিল না তাই তাদের শ্লেষ বাক্য ছুঁড়ে দিত এভাবে ‘‘ছেলে পড়ালেখায় ভালো হলে কি হবে পাস করতে পারবে না। পাস করলে কি হবে চাকরি পাবে না। চাকরি পেলে কি হবে বেতন পাবে না। গত অর্থ বছরে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ছিল চোখে পড়ার মত। বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৭ দশমিক ৮ শতাংশ যা টক্কর দিচ্ছে ৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধির দেশ ভারতকেও। যেখানে ৫ দশমিক ৮ শতাংশ নিয়ে বাংলাদেশের চেয়ে অনেক নীচে পাকিস্তান। তাছাড়া বাংলাদেশের মাথাপিছুৃ ঋণ যেখানে ৪৩৪ ডলার সেখানে পাকিস্তানের ৯৭৪ ডলার। বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বর্তমানে ৩২ বিলিয়ন ডলার পাকিস্তানে তা মাত্র চারভাগের এক ভাগ ৮ বিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধির বেশীর ভাগই হয়েছে রপ্তানি থেকে। ১৯৭১ সালে শূন্য হাতে শুরু করলেও এখন যা এসে দাঁড়িয়েছে ৩৫ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলারে।
ইন্টারন্যাশনাল মনিটরি ফান্ড আই এম এফ তাদের হিসাব অনুযায়ী অনুমান করছে বাংলাদেশের বর্তমানে ১৮০ বিলিয়ন ডলারের ক্রম অগ্রসরমান অর্থনীতি ২০২১ সালের ৩২২ বিলিয়নে গিয়ে দাঁড়াবে। বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায় অর্থনীতিবিদরা বলছেন এই বাংলাদেশই হবে আগামীর এশিয়ার টাইগার। বাংলা দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের অন্যতম ভিত্তি ছিল পূর্ব পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যকার আর্থ সামাজিক বৈষম্য। জনসংখ্যা বেশি হলেও তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের জন্য তুলনামূলক কম বরাদ্দ দেওয়া হতো। পশ্চিম পাকিস্তানের উন্নয়নে বেশি বরাদ্দ দেওয়া হতো। এই অর্থনৈতিক ও সামাজিক বঞ্চনার কারণেই বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রেক্ষাপট তৈরি হয়। ১৯৭১ সালে রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মধ্যে দিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়। ২০২১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী উৎসব উদযাপন করবে। তার আগেই পাকিস্তানের চেয়ে এগিয়ে গেছে বাংলাদেশ, যেমন মোট দেশজ উৎপাদনে জিডিপি এখন পাকিস্তানের প্রবৃদ্ধির চেয়ে অনেক বেশি। ২০১৮-১৯ অর্থ বছরে বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৮ দশমিক ১৫ শতাংশ এমন উচ্চ প্রবৃদ্ধি গোটা বিশ্বে হাতে গোনা কয়েকটি দেশে হয়েছে। এখানেই আমাদের সন্তুষ্টি। আমরা যারা একটা সামষ্টিক স্বপ্নের পেছনে ছুটতে ছুটতে বেড়ে উঠেছি এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে সত্যিকার অর্থে ধারণ করি আমরা দেখতে চাই বাংলাদেশকে অনেক উচ্চতায়। যে রকম দেশটা পেতে চেয়েছিলাম এখনও বিশ্বাস করি সেই বাংলাদেশ কিংবা তার চেয়ে সুন্দর ও সমৃদ্ধ একটা দেশে পরিণত হবে এই দেশ।
লেখক : প্রাবন্ধিক, সংগঠক