স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়কে কাজের তদারকির দায়িত্ব নিতে হবে

চট্টগ্রামের জলাবদ্ধতা

রেজাউল করিম স্বপন | মঙ্গলবার , ২২ আগস্ট, ২০২৩ at ৬:০৪ পূর্বাহ্ণ

একটু ভারী বৃষ্টি হলেই চট্টগ্রাম নগরের অধিকাংশ এলাকা ডুবে যায়। জনজীবন হয়ে পড়ে বিপর্যস্ত। আর বৃষ্টির সাথে জোয়ারের পানি মিশে গেলে পরিস্থিতি হয় ভয়াবহ। প্রশ্ন জাগে, যে শহর দেশের অর্থনীতির প্রাণকেন্দ্র, যে শহরের আয় দিয়ে পুরো দেশের অর্থনীতি সচল থাকে ও যে শহরকে বাণিজ্যিক রাজধানী বলা হয়,সেই শহরের এই করুণ দশা কেন? কেন সেই শহরের জলাবদ্ধতা নিয়ে সরকারের এক সংস্থা সহিত অন্য সংস্থা কাদা ছোড়াছুড়িতে ব্যস্ত।

চট্টগ্রামের জলাবদ্ধতার সমস্যা অনেক পুরোনো। একসময় চট্টগ্রাম শহরে প্রাকৃতিকভাবে আড়াই হাজার খাল ও নালা ছিল, যা দিয়ে শহরের পানি নদী ও সমুদ্রে যেত। কিন্তু দখল, পাহাড় কর্তন ও অপরিকল্পিত নগরায়নের ফলে সেই খালের বেশির ভাগ অংশই ভরাট হয়ে গেছে। ফলে বৃষ্টির পানি দ্রুত নামতে পারে না। অন্যদিকে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়ে গেছে। অমাবস্যা পূর্ণিমার সময় অল্পতেই জোয়ারের পানি শহরে প্রবেশ করছে।

সেজন্য জলাবদ্ধতা দূর করতে খাল ও নালাগুলো যেমন পুনরুদ্ধার করা দরকার, তেমনি সমুদ্রের পানিপ্রবাহ ঠেকাতে জলকপাট তৈরি করাও দরকার। সেই প্রেক্ষিতে ১৯৬৯ সালে একটি বিদেশি কোম্পানি চট্টগ্রামের জলাবদ্ধতা নিরসনে মাস্টার প্লান দিয়েছিল, যা বাস্তবায়নের মুখ দেখেনি। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৯৫ সালে সরকারের পক্ষ থেকে আর একটি মহাপরিকল্পনা হাতে নেওয়া হয়। কিন্তু পরিকল্পনার কাজ কে কীভাবে করবে, সেটি ঠিক করতেই দীর্ঘ সময় চলে যায়। মহাপরিকল্পনা অনুযায়ী চট্টগ্রাম নগরের জলাবদ্ধতা নিরসনে বর্তমানে তিন সংস্থার মাধ্যমে চারটি প্রকল্পের কাজ চলছে। উল্লিখিত তিন সংস্থা হলো চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ), চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন ও পানি উন্নয়ন বোর্ড। তবে এই তিন সংস্থার কাজে সমন্বয়হীনতার কারণেই চট্টগ্রাম ডুবছে বার বার। এরা একে অপরকে সহযোগিতা না করলে প্রকল্প বাস্তবায়ন করা কঠিন হবে।

জলাবদ্ধতার কারণে প্রতি বছর মানুষের দুর্ভোগ ছাড়াও অর্থনীতিতে অপূরণীয় ক্ষতি হচ্ছে। পানি নিষ্কাশনের জন্য খাল খনন কিংবা জোয়ারের পানি আটকে দেওয়ার জন্য যে জলকপাট নির্মাণ করা প্রয়োজন, তার কোনোটি অপূর্ণ থাকলে পরিস্থিতির উন্নয়ন আশা করা যায় না। আবার দ্রুত বৃষ্টির পানি সরার বা ধরে রাখার জন্য শহরে অবস্থিত পুকুর বা উন্মুক্ত জলাধার রক্ষা করতে না পারলে রাস্তাঘাটসহ পুরো শহর তলিয়ে যাবে বার বার। মহাপরিকল্পনার আওতায় বিপুল টাকা খরচ হলেও এখনো জলাবদ্ধতা নিরসন তো হয়নি বরং বেড়েছে। নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। ভারী বৃষ্টিতে বছরে ১০ থেকে ১৫ বার ডুবছে নগর। আগেই বলেছি চট্টগ্রাম নগরের জলাবদ্ধতা দীর্ঘদিনের পুরোনো সমস্যা। এ সমস্যা নিরসন না হওয়ার জন্য একসময় অর্থ বরাদ্দকে অন্যতম প্রধান কারণ হিসেবে দায়ী করা হতো। কিন্তু এখন সে সমস্যা নেই। বিপুল টাকা খরচ হলেও নগরবাসী জলাবদ্ধতার হাত হতে মুক্তি পাচ্ছে না। সর্বশেষ গত কয়েকদিনের বৃষ্টিতে শহরের অন্তত ৫০% এলাকায় জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে। এর মধ্যে কিছু কিছু এলাকায় পানি জমে ছিল ৯১০ ঘণ্টা থেকে কয়েকদিন পর্যন্ত।

এদিকে জলাবদ্ধতা নিরসনে সিটি করপোরেশন একটি, চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ) দুটি ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের একটি প্রকল্পের আওতায় ১১ হাজার ৩৪৪ কোটি টাকার কাজ চলছে। গত ছয় বছরে ৫ হাজার ৭৯০ কোটি টাকা ব্যয়ের পরেও সুফল পাচ্ছেন না নগরবাসী। এর মধ্যে সিটি কর্পোরেশন নগরের বহদ্দারহাটের বারইপাড়া থেকে বলিরহাট পর্যন্ত নতুন খাল খননে ১ হাজার ১৭৫ কোটি টাকা ব্যয় করেছে। ২০১৪ সালের জুনে অনুমোদন হলেও এই প্রকল্পের কাজ এখনো শেষ হয় নি।

অন্য দিকে সিডিএ জলাবদ্ধতা দূর করতে ৫ হাজার ৬১৬ কোটি টাকার একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছে। ২০১৭ সালে এর অনুমোদন দেওয়া হয় এবং পরের বছর কাজ শুরু হয়। এতে এখন পর্যন্ত ব্যয় হয়েছে ৩ হাজার ১৮ কোটি টাকা। এই টাকায় ৩৬টি খালের ময়লা আবর্জনা পরিষ্কার করা হয়েছে, নির্মাণ করা হয়েছে প্রতিরোধ দেয়াল, নতুন নালা, সেতু ও কালভার্ট। এ ছাড়া পাঁচটি জলকপাট নির্মাণ ও চালু করা হয়েছে। তবে সিটি করপোরেশন নালা নর্দমাগুলো ঠিকমত পরিষ্কার রাখতে পারছে না। ফলে নগরের ড্রেনেজ ব্যবস্থা অকার্যকর হয়ে পড়েছে।

কর্ণফুলী নদীর পাশে বাঁধসহ রাস্তা নির্মাণে ২ হাজার ৭৭৯ কোটি টাকার আরেকটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে সিডিএ। এখন পর্যন্ত এই প্রকল্পে ব্যয় হয়েছে ১ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। জোয়ার জনিত জলাবদ্ধতা নিরসনে এই প্রকল্পের আওতায় নদীর সঙ্গে সংযুক্ত ১২টি খালের মুখে জলকপাট নির্মাণ করার কথা ছিল। কিন্তু এখন পর্যন্ত ১০টির অবকাঠামো শেষ করলেও সেগুলো চালু হয়নি। এর মধ্যে নগরের পানি নিষ্কাশনের প্রধান মাধ্যম চাক্তাই ও রাজাখালী খালও রয়েছে। জলকপাটগুলো চালু না হওয়ায় বৃষ্টি ও জোয়ারের পানিতে নগরের জলাবদ্ধতা তীব্র আকার ধারণ করেছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।

এ ছাড়া পানি উন্নয়ন বোর্ড নগরের কর্ণফুলী ও হালদা নদীর সঙ্গে যুক্ত নগরের ২৩ খালের মুখে জলকপাটের কাজ এখনো শেষ করতে পারেনি। এতে এখন পর্যন্ত ব্যয় হয়েছে ৯৭ কোটি টাকা।

কোনো স্থানে বৃষ্টি হলে কী হয়? প্রায় ৪৫৫০% পানি গাছপালা ও মাটি শোষণ করে। বাকি পানি গড়িয়ে নালা, খাল, নদী হয়ে সাগরে চলে যায়। যেই অংশ মাটি শোষণ করে, তার একাংশ গাছ পালাকে শুকনো মৌসুমে বাঁচিয়ে রাখে, অপর অংশ মাটির গভীরে ঢুকে ভূগর্ভস্থ জলাধারে জমা হয়। এই ভূগর্ভস্থ পানিই আমরা নলকূপের মাধ্যমে উত্তোলন করে গৃহস্থালী, শিল্প কারখানা ও কৃষি কাজে ব্যবহার করি। কাজেই বৃষ্টি না হলে বা কম হলে গাছপালা ও বনভূমি রুগ্ন হয়ে যাবে ও নলকূপ শুকিয়ে হাহাকার পড়ে যাবে। এতে শিল্প উৎপাদন ও শুষ্ক মৌসুমে কৃষিকাজ বন্ধ হয়ে যাবে। বর্তমানে আমরা শহরগুলোতে সমস্ত উম্মুক্ত জায়গা কনক্রিটে আচ্ছাদিত করে ফেলায় বৃষ্টির পানি মাটির নীচে যেতে পারে না। ফলে শতভাগ বৃষ্টির পানি নালা নর্দমা ও খালের মাধ্যমে নিঃসরিত হয়। এতে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নীচে নেমে যাওয়ায় নলকূপের মাধ্যমে পানি উত্তোলন বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। বিষয়টি আমাদের জন্য আশঙ্কার। মনে রাখতে হবে দুনিয়াতে সবচেয়ে নিরাপদ ও দুষণমুক্ত পানি হলো বৃষ্টির পানি। এটি বাতাসকে ফিল্টার করে। ধুলো, ধোঁয়া, ক্ষতিকর জীবাণু, পরাগরেণু, বিষাক্ত গ্যাস এসব থেকে বাতাসকে পরিশুদ্ধ করে। বৃষ্টি কম হলে নদীতে পানির প্রবাহ কমে যাবে, সাগরের লবণাক্ত পানি উপকূলীয় এলাকায় মাটির গভীরে ঢুকে ফসল মাছ পরিবেশ সব নষ্ট করে ফেলবে। আর এক্ষেত্রে চট্টগ্রাম আছে বিপদজনক অবস্থায়। কারণ সাগরের মোহনায়ই চট্টগ্রাম শহর অবস্থিত। তবে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, চট্টগ্রামের জলাবদ্ধতা নিরসনে চারটি প্রকল্পের কাজ চললেও প্রাধিকার ভিত্তিতে কাজগুলো করা হয়নি। অনেক খালে প্রতিরোধ দেয়াল নির্মাণ ও পরিষ্কারের কাজ শেষ হলেও খালগুলোর মুখে জলকপাট চালু হয়নি।

আবার সংস্থাগুলো যে যার মতো করে কাজ করছে। তাই স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়কে সংস্থাগুলোর কাজের তদারকির দায়িত্ব নিতে হবে। প্রকল্পগুলোর ত্রুটি ও অসম্পূর্ণতা চিহ্নিত করে তা দ্রুত সমাধান করতে হবে। উম্মুক্ত জলাধার ও লেকের ব্যবস্থা করতে হবে। তবেই হয়ত চট্টগ্রামে জলবদ্ধতার স্থায়ী সমাধান হবে ও একটি বাসযোগ্য নগরীতে পরিনত হবে। মনে রাখতে হবে, হৃদপিণ্ডে রক্ত চলাচলে বাধা বা বন্ধ হয়ে গেলে যেমন মানুষের মৃত্যু হয়, ঠিক তেমনি পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা সচল না থাকলে যে কোনো শহর একটি পরিত্যক্ত শহরে পরিনত হয়। আর চট্টগ্রামের ক্ষেত্রে সেই আশঙ্কা একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না।

লেখক : কলামিস্ট, প্রাবন্ধিক

পূর্ববর্তী নিবন্ধস্বমহিমায় উজ্জ্বল এক ব্যক্তিত্বকে স্মরণ
পরবর্তী নিবন্ধভূগোলের গোল