গত ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর দেশের ৬১ জেলা পরিষদের প্রশাসক নিয়োগ দিলেও এর বাইরে আছে তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ। বিগত দুই মাসের বেশি সময় ধরে আত্মগোপনে তিন পার্বত্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও অধিকাংশ সদস্যরা। রাঙামাটিতে এক সদস্যকে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের দায়িত্ব হস্তান্তর করে সটকে পড়েন চেয়ারম্যান। খাগড়াছড়ি ও বান্দরবানের চেয়ারম্যান আত্মগোপনে। আবার অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছেন পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড চেয়ারম্যান সুপ্রদীপ চাকমা। এতে করে দুই মাস ধরে চেয়ারম্যান নেই উন্নয়ন বোর্ডেও। অভিভাবক শূন্য হয়ে কার্যত স্থবির হয়ে পড়েছে পাহাড়ের উন্নয়ন প্রতিষ্ঠানসমূহ, থমকে আছে কার্যক্রম।
তিন জেলা পরিষদের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, নতুন চেয়ারম্যানসহ পরিষদ পুনর্গঠন না হওয়ায় ফাইল–নথিপত্র অনুমোদন, প্রকল্প গ্রহণের ক্ষেত্রে কোনো সিদ্ধান্ত নেয়া যাচ্ছে না। নতুন অর্থবছরের সাড়ে তিন মাস অতিবাহিত হলেও অভিভাবক শূন্যতার কারণে কোনো প্রকল্প গ্রহণ হয়নি। উন্নয়ন কাজ বাস্তবায়নের জন্য কোনো বরাদ্দও দেয়নি পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়। পরিষদ পুনর্গঠনে বিলম্ব হলে পরবর্তীতে বরাদ্দ পেলেও প্রকল্প বাস্তবায়নে তড়িঘড়ি ও হিমশিম খেতে হবে। জানতে চাইলে রাঙামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা খোন্দকার মোহাম্মদ রিজাউল করিম বলেন, ‘মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তার একক স্বাক্ষরে কর্মচারীদের বেতন–ভাতা দেওয়া হচ্ছে মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তে। বাকি সবকিছুই পুরোপুরি বন্ধ রয়েছে। কবে নাগাদ নতুন পরিষদ পুনর্গঠন হতে পারে এ ব্যাপারে আমরা কিছুই জানি না।’
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, পাহাড়ের শাসন পদ্ধতিতে স্বচ্ছতা, গতিশীলতা ও উন্নয়ন নিশ্চিতের লক্ষ্যে ১৯৮৯ সালে সাবেক রাষ্ট্রপতি প্রয়াত হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের শাসনামলে পাহাড়ি সমপ্রদায় থেকে একজন চেয়ারম্যান করে ৩৪ সদস্য বিশিষ্ট তিন পার্বত্য জেলায় (রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান) স্থানীয় সরকার পরিষদ গঠন করা হয়। ১৯৮৯ সালের ২৫ জুন পাঁচ বছর মেয়াদের জন্য এসব পরিষদের একবার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এরপর প্রায় তিন যুগেও কোনো নির্বাচন হয়নি। পরবর্তীতে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতা আসার পর ১৯৯৭ সালে ২ ডিসেম্বর পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরের পর চুক্তি অনুযায়ী ‘স্থানীয় সরকার পরিষদ’–এর পরিবর্তে রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান নামে ‘পার্বত্য জেলা পরিষদ’ নামকরণ করে একজন পাহাড়ি ব্যক্তিকে চেয়ারম্যান ও ৪ জন সদস্য করে অন্তর্বর্তীকালীন পরিষদ গঠিত হয়।
এরপর থেকে যে সরকারই ক্ষমতায় আসে তাদের মনোনীত দলীয় লোকজনদের দিয়ে অর্ন্তবর্তীকালীন পরিষদের কার্যক্রম চলে আসছে। সর্বশেষ ২০১৪ সালে তিন পার্বত্য পরিষদের আইন সংশোধন করে তিন পার্বত্য জেলা পরিষদকে পুনর্গঠন করে একজন চেয়ারম্যানসহ ১৫ সদস্যের আন্তর্বর্তীকালীন পরিষদ গঠন করে সরকার। এতে আওয়ামী লীগ সরকারের মনোনীত দলীয় ব্যক্তিদের নিয়ে অন্তর্বর্তীকালীন পরিষদের কার্যক্রম চলছে। পরিষদের কার্যক্রমে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা না থাকায় জনগণের আস্থা হারিয়েছে এই উন্নয়ন প্রতিষ্ঠানগুলো। গত দেড় দশকে আওয়ামী লীগের শাসনামলে টানা তিন পর্ষদ নিজেদের দখলে জেলা পরিষদ থাকায় নিয়োগ বাণিজ্য–অনিয়ম–ভুয়া প্রকল্পের নামে অর্থ লোপাটসহ নানান অনিয়মের অভিযোগের পাহাড় পার্বত্য জেলা পরিষদগুলোর বিরুদ্ধে।
এদিকে, গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের ক্ষমতাচ্যুতির পর তিন পার্বত্য জেলা পরিষদের বেশিরভাগ সদস্য ও চেয়ারম্যানরা ছিলেন আত্মগোপনে। গত ৩ সেপ্টেম্বর এক অফিস আদেশে ‘শারীরিক অসুস্থতা ও ব্যক্তিগত কারণ’ দেখিয়ে রাঙামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদ চেয়ারম্যানের পদ থেকে সটকে পড়েন তৎকালীন চেয়ারম্যান ও জেলা আওয়ামী লীগ সহ–সভাপতি অংসুই প্রু চৌধুরী। ওই অফিস আদেশে পরিষদের সদস্য রেমলিয়ানা পাংখোয়াকে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। রাঙামাটিতে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের দায়িত্ব একজন সদস্যকে দেওয়া হলেও খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান পার্বত্য জেলা পরিষদের দুই চেয়ারম্যান মংসুই প্রু চৌধুরী ও ক্যশৈহ্লা আত্মগোপনে রয়েছেন।
রাঙামাটিতে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান থাকলেও তিন পার্বত্য জেলা পরিষদে অর্থ ছাড়, ফাইল–নথি অনুমোদনসহ গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালনের সুযোগ না থাকায় বেতন–ভাতা বন্ধ হয়ে যায় সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীদের। তবে গত ৭ অক্টোবর পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় এক অফিস আদেশে সংশ্লিষ্ট জেলায় নতুনভাবে জেলা পরিষদ পুনর্গঠন না হওয়া পর্যন্ত পরিষদের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা ও নির্বাহী প্রকৌশলীর যৌথ স্বাক্ষরে ইউএনডিপির অর্থায়নে প্রকল্পসমূহ পরিচালনার জন্য আর্থিক ক্ষমতা দেওয়া হয়। একই প্রক্রিয়ায় বেতন–ভাতা পাচ্ছেন পরিষদের কর্মকর্তা–কর্মচারীরাও।
অন্যদিকে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের পর তিন পার্বত্য জেলায় সফরে এসে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সুপ্রদীপ চাকমা পার্বত্য জেলা পরিষদ পুনর্গঠন হচ্ছে বলে ঘোষণা দিলেও দুই মাসেও নতুন পর্ষদ গঠন হয়নি। তিন পার্বত্য জেলা পরিষদে– কে হচ্ছেন চেয়ারম্যান–সদস্য; এসব আলোচনা এখন স্থানীয়দের মুখে মুখে। তবে এসব প্রসঙ্গে জানতে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সুপ্রদীপ চাকমার মুঠোফোনে একাধিকবার চেষ্টা করেও সেটি বন্ধ পাওয়া গেছে।
পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড সূত্র জানিয়েছে, চেয়ারম্যানের পদ শূন্য হলে কিংবা অনুপস্থিতি, অসুস্থতা বা অন্য কোনো কারণে চেয়ারম্যান দায়িত্ব পালনে অসমর্থ হলে, নবনিযুক্ত চেয়ারম্যান পদে তার যোগদান না করা পর্যন্ত কিংবা চেয়ারম্যান পুনরায় স্বীয় দায়িত্ব পালনে সমর্থ না হওয়া পর্যন্ত ভাইস–চেয়ারম্যান চেয়ারম্যান হিসাবে দায়িত্ব পালন করবেন। এই আইনের আলোকে বর্তমানে পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করছেন ভাইস চেয়ারম্যান রিপন চাকমা।
জানতে চাইলে পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের ভাইস–চেয়ারম্যান (যুগ্ম সচিব) রিপন চাকমা বলেন, ‘আইন অনুযায়ী আমি চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করছি। নতুন চেয়ারম্যান নিয়োগের বিষয়টি সরকার দেখবে। এখানে আমাদের কোনো এখতিয়ার নেই। আমি রুটিন কাজ করছি।’ বোর্ডের বরাদ্দ আটকে থাকার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, অর্থ বরাদ্দ তো মন্ত্রণালয় দেবে, বরাদ্দ না পেলে নতুন প্রকল্পের কাজ শুরু করা যাবে না। তবে তিনি উন্নয়ন বোর্ডে যোগদানের পর কোনো বোর্ড সভাও অনুষ্ঠিত হয়নি বলে জানিয়েছেন।
এসব প্রসঙ্গে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব একেএম শামিমুল হক ছিদ্দিকী বলেন, ‘তিন পার্বত্য জেলা পরিষদে চেয়ারম্যান–সদস্য নিয়োগের বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। আমরা আশা করছি শীঘ্রই নতুন পরিষদ পুনর্গঠন হবে। তবে উন্নয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান নিয়োগ নিয়ে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। তিন পার্বত্য জেলা পরিষদে চেয়ারম্যান–সদস্য নিয়োগের পর বরাদ্দসহ সব কিছুই হবে।’