স্কুলে বিধ্বস্ত বিমান। নিহত হলেন পাইলটসহ ২০ জন। এর মধ্যে ১৭ জন শিশু। একটি দুর্ঘটনা সারা জীবনের কান্না। আর এই একটি দুর্ঘটনা কাঁদাল দেশবাসীকে। শিশুদের আর্তনাদ, আহাজারি, কান্না স্পর্শ করল দেশের মানুষকে। তারাও কাঁদলেন, শোকাতুর হলেন।
ঢাকার দিয়াবাড়িতে মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের ভেতরে বিমানবাহিনীর একটি প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্ত হয়ে পাইলটসহ ২০ জনের মৃত্যু হয়েছে। আহত ও দগ্ধ হয়েছেন দেড় শতাধিক। আন্তঃবাহিনীর জনসংযোগ পরিদপ্তর–আইএসপিআর জানিয়েছে, বিমান বাহিনীর ‘এফ–৭ বিজিআই’ ফাইটার জেটটি গতকাল সোমবার দুপুর ১টা ৬ মিনিটে উড্ডয়নের ১২ মিনিটের মাথায় বিধ্বস্ত হয়।
ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী জহিরুল নামে স্থানীয় এক বাসিন্দা বলেন, আমার কাছে মনে হয়েছে উড়োজাহাজটা মাঠে আছড়ে পড়ে। তারপর ছেঁচড়ে ভবনে গিয়ে ধাক্কা খায়। সেখানেই আগুন ধরে যায়। হায়দার আলী ভবন নামের ওই দুই তলা অ্যাকাডেমিক ভবনে ইংরেজি মাধ্যমের থ্রি থেকে এইটের শিক্ষার্থীদের ক্লাস হতো। স্কুল ছুটির সময় হওয়ায় অনেক অভিভাবকও ভবনের সামনে দাঁড়িয়েছিলেন। বিধ্বস্ত হওয়ার পরপরই উড়োজাহাজটিতে আগুন ধরে যায়। অনেক দূর থেকেও সেখানে ধোঁয়া উঠতে দেখা যায়। জ্বলন্ত উড়োজাহাজটির আগুন নেভাতে ঘটনাস্থলে ছুটে যায় ফায়ার সার্ভিসের নয়টি ইউনিট। খবর বিডিনিউজ, বিবিসি বাংলা ও বাংলানিউজের।
মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের জনসংযোগ কর্মকর্তা শাহ বুলবুল বলেন, ওই ভবনে বাচ্চাদের ক্লাস চলছিল। আগুনে ভবন থেকে কেউ বের হতে পারেনি। অনেকেই সেখানে দগ্ধ হয়েছে। দুর্ঘটনাস্থল থেকে আহত ও দগ্ধদের রিকশা, ঠেলাগাড়িসহ বিভিন্ন বাহনে করে সরিয়ে নিতে দেখা যায়। এক ডজনের বেশি অ্যাম্বুলেন্সে করে তাদের পাঠানো হয় হাসপাতালে। তাদের একটি অংশকে প্রাথমিকভাবে ঢাকা সিএমএইচ, উত্তরার ক্রিসেন্ট হাসপাতাল, উত্তরা আধুনিক হাসপাতাল, কুর্মিটোলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, কুয়েত মৈত্রী হাসপাতাল, লুবনা জেনারেল হাসপাতাল অ্যান্ড কার্ডিয়াক সেন্টারে নেওয়া হয়। দগ্ধদের অধিকাংশকে পরে পাঠানো হয় জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে।
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মুহাম্মদ জাহেদ কামাল বিকাল সাড়ে ৪টার দিকে ঘটনাস্থলে সাংবাদিকদের বলেন, তাদের কর্মীরা ধ্বংসস্তূপ থেকে ১৯ জনের লাশ উদ্ধার করেছে। আইএসপিআরও পরে জানায়, বিমান বাহিনীর প্রশিক্ষণ বিমানের পাইলট ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট মো. তৌকির ইসলামসহ মোট ২০ জন সেখানে মারা গেছেন। নিহতদের মধ্যে ঢাকা সিএমএইচে নিহত ১২ জন, বার্ন ইনস্টিটিউটে ২ জন, কুর্মিটোলা জেনারেল হসপিটালে ২ জন, উত্তরার লুবনা জেনারেল হাসপাতাল অ্যান্ড কার্ডিয়াক সেন্টারে ২ জন, ঢাকা মেডিকেলে ১, উত্তরা আধুনিক হসপিটালে ১ জনের লাশ আছে। তাৎক্ষণিকভাবে নিহতদের পরিচয় জানা যায়নি।
এদিকে বিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় নিহতদের মধ্যে ১৭ জনই শিশু বলে জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী (স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়) অধ্যাপক ডা. মো. সায়েদুর রহমান। এর মধ্যে সাতজনের মরদেহ শনাক্ত করা যায়নি। তাদের পরিচয় শনাক্ত করতে ডিএনএ পরীক্ষা লাগবে বলে জানান তিনি। গত রাত সাড়ে আটটার দিকে ঢাকার জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে ব্রিফিং করেন তিনি। আহতদের মধ্যে বর্তমানে ৮৮ জন হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা। তাদের মধ্যে ২৫ জনের অবস্থা আশঙ্কাজনক বলে জানান ডা. সায়েদুর।
ঢাকায় যে বিমান দুর্ঘটনায় শিক্ষার্থীসহ ২০ জনের প্রাণহানি হয়েছে, সেই যানের পাইলট ক্ষয়ক্ষতি এড়াতে সর্বাত্মক চেষ্টা করেছিলেন বলে আইএসপিআরের ভাষ্য।
হতাহতের ঘটনায় শোক জানিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন এবং প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস। মাইলস্টোনের ঘটনায় আজ মঙ্গলবার রাষ্ট্রীয়ভাবে শোক পালন করবে বাংলাদেশ। এর অংশ হিসেবে আজ দেশের সকল সরকারি, আধা সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত থাকবে। পাশাপাশি সকল সরকারি, বেসরকারি ভবন ও বিদেশে বাংলাদেশি মিশনেও জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত থাকবে। হতাহতদের জন্য দেশের সকল ধর্মীয় উপাসনালয়ে বিশেষ প্রার্থনার আয়োজন করা হবে
সন্তানের খোঁজে আহাজারি : একের পর এক অ্যাম্বুলেন্স ছুটে চলছে সাইরেন বাজিয়ে, সেগুলোকে পাহারা দিয়ে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে সামরিক যান। বাশির ফুঁয়ে ভিড় সামাল দেয়ার চেষ্টা করছেন সেনাবাহিনীর সদস্যরা। এর মাঝেই এক নারী চিৎকার করতে করতে মোবাইল ফোনে কথা বলছিলেন। ফোনের ওপাশে ব্যক্তিকে কাঁদতে কাঁদতে বারবার জিজ্ঞেস করছেন ‘মিস আমার বাচ্চা কই’।
দুর্ঘটনার খবর ছড়িয়ে পড়তেই সন্তানের খোঁজে অভিভাবক ও স্বজনরা ছুটে আসেন মাইলস্টোনে। মোবাইল ফোনে শিক্ষকের কাছে সন্তানের খোঁজ করা ওই নারী তাদেরই একজন। তিনি যখন চিৎকার করে কাঁদছিলেন তখন স্কুল ফটকে জড়ো হওয়া স্থানীয়রা তার সন্তানের এবং ক্লাসের নাম জানতে চান।
আহাজারি হাসপাতালেও : উড়োজাহাজ বিধ্বস্তের ঘটনায় দগ্ধ শিক্ষার্থীদের একটি বড় অংশের চিকিৎসা চলছে জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে। সেখানকার জরুরি বিভাগে চিকিৎসা চলছে ১১ বছর বয়সী চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থী মাহিদ হাসান আরিয়ান, সপ্তম শ্রেণি পড়ুয়া শায়ান, তৃতীয় শ্রেণি পড়ুয়া জুনায়েদ হাসানসহ আরো বহু শিক্ষার্থীর। জরুরি বিভাগের বাইরে অপেক্ষায় আছেন এসব শিক্ষার্থীর অভিভাবকরা। তাদের আহাজারিতে ভারি ওঠে সেখানকার পরিবেশ।
ইনস্টিটিউটের আবাসিক সার্জন ডা. শাওন বিন রহমান বলেন, এখন পর্যন্ত ৬০ জনকে জরুরি বিভাগে আনা হয়েছে। দগ্ধদের বেশিরভাগই শিক্ষার্থী। তাদের অনেকের অবস্থাই আশঙ্কাজনক।
সারা শরীর পুড়ে যাওয়া ১১ বছর বয়সী আরিয়ানের যখন জরুরি বিভাগের ভেতরে চিকিৎসা চলছিল, বাইরে বসে তার মা মনিকা আক্তার আঁখি কাঁদতে কাঁদতে বলেন, আল্লাহ আমার সন্তানরে আমার কাছে ফিরাইয়া দেও। সকাল পৌনে আটটায় স্কুলে গেছে। দেড়টায় ছুটি হওয়ার কথা ছিল। এরপর দেড়টা থেকে সাড়ে তিনটা পর্যন্ত কোচিং। সকালে ছেলেরে খাবার দিয়া দিছি, এর মধ্যে এই ঘটনা ঘটল। স্কুলের কাছেই তাদের বাসা। দুর্ঘটনার খবর পেয়ে ছেলের খোঁজে স্কুলে ছুটে যান বলে জানিয়েছেন আঁখি; এরপর গিয়ে ওই মা ছেলেকে দগ্ধ অবস্থায় পান। সেখান থেকে তাকে প্রথমে বাংলাদেশ মেডিকেলে নেওয়া হয়। ওই হাসপাতাল থেকে আরিয়ানকে বার্ন ইনস্টিটিউটে পাঠিয়ে দেয় উন্নত চিকিৎসার জন্য।
সপ্তম শ্রেণির শায়ানের শরীরের বেশিরভাগ অংশ পুড়ে গেছে বলে জানিয়েছেন তার ফুপু রুবিনা আক্তার। উত্তরা ১০ নম্বর সেক্টরের এই বাসিন্দা বলেন, সকাল বেলা সুস্থ ছেলেটা বাসা থেকে বের হইল, আর এখন হাসপাতালে।
তৃতীয় শ্রেণি পড়ুয়া জুনায়েদ হাসানের মা ঝর্না আক্তারও জরুরি বিভাগের সামনে কাঁদছিলেন। নয়া নগরের এই বাসিন্দা জানিয়েছেন, তার ছেলেকে আইসিউতে নেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, আর একটু পরেই ছুটি হইলে ছেলে বাসায় চলে যেত। আর এখন ছেলে আমার আইসিইউতে।
একাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী সাইয়ুম খান বলেন, জুনিয়রদের শিফটটা সকাল থেকে শুরু হয়। ঘটনার সময় ক্লাসে ছিলাম। তারপর বিকট শব্দ শুনে দেখি আগুন, অবস্থা খারাপ। কিছুক্ষণের মধ্যেই সেনাবাহিনীর সদস্যরা এসে উদ্ধার কাজ শুরু করে। তারপর ফায়ার সার্ভিস আসে। এক আন্টি বলেন বাবা আমার মেয়েকে একটু ধরো, তার দুই হাত পুড়ে গেছে। পরে তাকে নিয়ে হাসপাতালে এসেছি।
উত্তরার ক্রিসেন্ট হাসপাতালের প্রশাসন শাখার পরিচালক নাজমুল ইসলাম বলেন, যাদের কম বার্ন তাদের আমরা এখানে চিকিৎসা দিচ্ছি। কয়েকজন অভজার্ভেশনে আছে। যাদের ৩০ শতাংশের বেশি পুড়ে গেছে তাদের বার্ন ইউনিটে রেফার করা হচ্ছে। অল্প আঘাত নিয়ে কয়েকজন এসেছিলেন তাদের প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে বাসায় চিকিৎসা নেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
উত্তরা আধুনিক হাসপাতালের সহকারী পরিচালক চিকিৎসক আকাশ বলেন, বেশিরভাগের শরীর ৬০–৭০ শতাংশ পুড়ে গেছে। তাদের অনেকের বয়স ১৪ থেকে ২০ বছরের মধ্যে।
হঠাৎ বিপুল সংখ্যক রোগী আসায় এ হাসপাতালে রক্তের প্রয়োজন দেখা দেয়। বিশেষ করে জরুরি ভিত্তিতে ‘ও নেগেটিভ’ রক্ত খোঁজেন অনেকে। মাইলস্টোনের ঘটনায় আহতদের বহনের জন্য মেট্রোরেলে বগি সংরক্ষণ রাখার কথা জানায় পুলিশ। পুলিশ সদর দপ্তর থেকে জানানো হয়, মেট্রোরেলের নারী বগির পাশের বগি আহতদের বহনের জন্য সংরক্ষণ থাকবে।
নিখোঁজ শিক্ষার্থীদের জন্য জরুরি যোগাযোগের নম্বর : মাইলস্টোনের যে অভিভাবকরা তাদের সন্তানের খোঁজ পাননি, তাদের জরুরি যোগাযোগের জন্য কয়েকটি ফোন নম্বর দেওয়া হয়েছে। মিলিটারি রেসকিউ ব্রিগেড ০১৭৬৯০২৪২০২, সিএমএইচ বার্ন ইউনিট ০১৭৬৯০১৬০১৯, সিএমএইচ ইমার্জেন্সি ০১৭৬৯০১৩৩১১, মাইলস্টোন স্কুলের প্রশাসনিক কর্মকর্তা ০১৮১৪৭৭৪১৩২, মাইলস্টোন স্কুলের উপাধ্যক্ষ ০১৭৭১১১১৭৬৬। প্রধান উপদেষ্টার দপ্তর থেকে এসব নম্বর দিয়ে বলা হয়েছে, জাতীয় জরুরি নম্বর ৯৯৯ পুলিশের জরুরি সেল থেকে বার্ন ইউনিটগুলোর সঙ্গে সংযোগ করিয়ে দেবে।
বার্ন ইনস্টিটিউটে হটলাইন : হতাহতের ঘটনায় তথ্য আদান–প্রদানের সুবিধার জন্য আলাদা হটলাইন চালু করেছে বার্ন ইনস্টিটিউট। জরুরি প্রয়োজনে জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের হটলাইন নম্বর হলো ০১৯৪৯০৪৩৬৯৭। এই নম্বর ব্যবহার করে সেবা গ্রহণ করা যাবে বলে প্রধান উপদেষ্টার সদর দপ্তর জানিয়েছে।
উত্তরায় সাইরেন–হুইসেল : মাঝেমধ্যে বাজছে ফায়ার সার্ভিসের সাইরেন। হুইসেল বাজিয়ে আসছে অ্যাম্বুলেন্স। সড়কের দুপাশে দাঁড়িয়ে হাজার হাজার জনতা হাতে হাত ধরে তৈরি করেছে বেষ্টনী। এর মধ্য দিয়েই অ্যাম্বুলেন্সগুলো আসছে এবং যাচ্ছে। এখানে–সেখানে ছুটছেন অভিভাবকরা। কেউ খুঁজছেন সন্তানকে, কেউ খুঁজছেন ভাগ্নেকে। তাদের আহাজারিতে ভারী হয়ে উঠছে উত্তরার আকাশ।
রক্তের জন্য মাইকিং : দুর্ঘটনায় আহত বিভিন্নজনকে নিকটবর্তী ও দূরবর্তী বিভিন্ন হাসপাতালে নেওয়া হচ্ছে। তাদের জন্য লাগছে রক্ত। এর মধ্যে দুষ্প্রাপ্য ‘ও নেগেটিভ’ এবং ‘এ নেগেটিভ’ রক্তের জন্য হ্যান্ড মাইকে বারবার ঘোষণা দেওয়া হচ্ছে ঘটনাস্থলে। বলা হচ্ছে, যারা পারেন রক্ত দিয়ে সহায়তা করেন।
শেষ হলো উদ্ধার অভিযান : মাইলস্টোন স্কুল ও কলেজ ক্যাম্পাসে বিধ্বস্ত হওয়া ঘটনায় উদ্ধার অভিযান শেষ হয়েছে। গতকাল রাত সাড়ে ৮টার দিকে উদ্ধার অভিযান সমাপ্ত ঘোষণা করা হয়। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের মিডিয়া কর্মকর্তা শাজাহান সিকদার বিষয়টি নিশ্চিত করেন। তিনি জানান, রাত সাড়ে ৮টায় উদ্ধার কাজ সমাপ্ত করা হয়েছে। তবে বিমানবাহিনী বিধ্বস্ত বিমানের ধ্বংসাবশেষ সরানো পর্যন্ত ফায়ার সার্ভিসের একটি ইউনিট সেখানে মোতায়েন ছিল। রাত ৯টা ১০ মিনিটে তারা ঘটনাস্থল থেকে ফায়ার স্টেশনে ফিরেছে।