আধুনিক মার্কেটিং স্ট্র্যাটেজিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো ‘সোশ্যাল কারেন্সি’। মানুষের প্রাত্যহিক জীবনে সোশ্যাল মিডিয়ার প্রভাব বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ব্র্যান্ডিং ও মার্কেটিংয়ের ধরণেও ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। মানুষ যা শেয়ার করে তা কেবল তথ্য নয়, বরং নিজের পরিচিতি, মূল্যবোধ ও পছন্দেরও প্রতিফলন।
সোশ্যাল কারেন্সি কী?
সোশ্যাল কারেন্সি বলতে বোঝায় এমন বিষয়বস্তু যা মানুষকে শেয়ার করতে উৎসাহী করে। এটি এমন কনটেন্ট যা মানুষ শেয়ার করলে নিজেকে আরও আকর্ষণীয়, স্মার্ট, এবং গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করে। উদাহরণস্বরূপ, কেউ যদি কোনো নতুন রেস্টুরেন্টে গিয়ে তাদের অভিজ্ঞতা শেয়ার করে, সেটি তাদের সোশ্যাল কারেন্সির অংশ হয়ে যায়।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে, যেখানে সোশ্যাল মিডিয়ার ব্যবহার দ্রুতগতিতে বাড়ছে, সেখানে ব্র্যান্ডগুলোর জন্য সোশ্যাল কারেন্সি তৈরির গুরুত্ব অপরিসীম।
কীভাবে সোশ্যাল কারেন্সি ব্র্যান্ডিংয়ে প্রভাব ফেলে?
Triggers: স্মৃতি উদ্রেককারী উপাদান
কোনো একটি পণ্যের সঙ্গে মানুষের প্রাত্যহিক জীবনের কোনো ঘটনার সংযোগ ঘটলে সেই পণ্যটির কথা বারবার মনে পড়ে। উদাহরণস্বরূপ, বাংলাদেশের ট্র্যাডিশনাল খাবারের মধ্যে যেমন পিঠা, বা কোনো উৎসবের সময় ফ্যাশন ব্র্যান্ডগুলোর প্রমোশনাল ক্যাম্পেইন। এই ধরনের বিষয়গুলো মানুষের মনে সহজেই জায়গা করে নেয়।
Emotion: আবেগের গুরুত্ব
যখন কোনো বিষয় আমাদের আবেগকে স্পর্শ করে, তখন আমরা সেই বিষয়টি শেয়ার করতে উৎসাহী হই। বাংলাদেশের অনেক ব্র্যান্ড এখন মানবিক গল্প বলার দিকে মনোযোগ দিচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ, একটি ই–কমার্স প্ল্যাটফর্ম যদি একটি উদ্যোক্তার সফলতার গল্প তুলে ধরে, তাহলে সেই গল্প মানুষ আরও বেশি শেয়ার করবে। কারণ, সেই গল্পে আবেগ জড়িত।
Public: দৃশ্যমানতা
মানুষ যা দেখে তা–ই অনুকরণ করে। বাংলাদেশের ফ্যাশন ব্র্যান্ডগুলো যদি তাদের পণ্যকে জনপ্রিয় সেলিব্রিটিদের মাধ্যমে প্রদর্শন করে, তাহলে সেই পণ্য মানুষের কাছে আরও গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠে। উদাহরণস্বরূপ, দেশীয় ফ্যাশন ব্র্যান্ড ‘সারা’ বা ‘নিত্য উপহার’ যখন সেলিব্রিটিদের মাধ্যমে তাদের পণ্যের প্রচারণা চালায়, তখন সাধারণ মানুষও সেই পণ্য কিনতে আগ্রহী হয়।
Practical Value: ব্যবহারিক মূল্য
মানুষ এমন তথ্য শেয়ার করতে চায় যা অন্যদের জন্য উপকারী। উদাহরণস্বরূপ, কেউ যদি জানতে পারে কোনো অনলাইন মার্কেটপ্লেসে বিশাল ছাড় চলছে, তাহলে তারা সেই তথ্য বন্ধুদের শেয়ার করতে চাইবে। বাংলাদেশের অনেক ব্র্যান্ড এখন এই স্ট্র্যাটেজি অনুসরণ করছে, যেমন বিভিন্ন অফার বা ডিসকাউন্ট শেয়ার করে গ্রাহকদের আকৃষ্ট করছে।
Stories: গল্প বলার কৌশল
গল্পের মাধ্যমে তথ্য সবচেয়ে সহজে মানুষের মনে স্থান করে নেয়। বাংলাদেশের ব্র্যান্ডগুলো এখন বিভিন্ন গল্প বলার মাধ্যমে তাদের পণ্য বা সেবার প্রচারণা করছে। উদাহরণস্বরূপ, গ্রামীণফোনের বিভিন্ন ক্যাম্পেইন বা ‘আরলা’র ‘ডেইরি ফার্মারদের গল্প’ এসবই মানুষের মনকে স্পর্শ করে।
বাংলাদেশি ব্র্যান্ডগুলোর জন্য করণীয়
সোশ্যাল কারেন্সি ব্যবহার করে বাংলাদেশের ব্র্যান্ডগুলো কীভাবে তাদের প্রচারণা আরও কার্যকর করতে পারে?
উদ্ভাবনী কনটেন্ট তৈরি করা: এমন কনটেন্ট তৈরি করতে হবে যা মানুষের আবেগ স্পর্শ করে এবং তাদের শেয়ার করতে উৎসাহী করে।
উৎসবকেন্দ্রিক ক্যাম্পেইন চালানো: বাংলাদেশের উৎসবসমূহকে কেন্দ্র করে ব্র্যান্ডগুলো বিশেষ প্রচারণা চালাতে পারে।
গ্রাহকদের গল্প তুলে ধরা: সফল গ্রাহকদের গল্প তুলে ধরা মানুষের মধ্যে ব্র্যান্ডের প্রতি আস্থা বাড়ায়।
সেলিব্রিটি ও ইনফ্লুয়েন্সার ব্যবহার করা: জনপ্রিয় ব্যক্তিদের মাধ্যমে ব্র্যান্ডের প্রচারণা চালালে ব্র্যান্ডের দৃশ্যমানতা বাড়ে।
ব্যবহারিক তথ্য প্রদান করা: গ্রাহকদের জন্য উপকারী তথ্য শেয়ার করতে হবে, যাতে তারা সেই তথ্য অন্যদের শেয়ার করতে উৎসাহী হয়।
বাংলাদেশ কীভাবে নিজেকে ব্র্যান্ডিং করছে?
একটি দেশ হিসেবে বাংলাদেশও এখন নিজের ব্র্যান্ডিংয়ে মনোযোগ দিচ্ছে। ‘ব্র্যান্ড বাংলাদেশ’ ধারণাটি বিশ্বমঞ্চে দেশের ইতিবাচক চিত্র তুলে ধরার প্রচেষ্টা।
অর্থনৈতিক উন্নতি ও তৈরি পোশাক শিল্প:
বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্পের অগ্রগতিতে সরকারের বিভিন্ন নীতিমালা এবং উদ্যোগ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। ১৯৮০–এর দশকে রপ্তানিমুখী শিল্প উন্নয়নে সরকার নীতি গ্রহণ করে। ১৯৮৩ সালে বেপজা (বাংলাদেশ এক্সপোর্ট প্রোসেসিং জোন অথরিটি) প্রতিষ্ঠা করা হয়, যা বিদেশি বিনিয়োগকে আকৃষ্ট করতে সহায়তা করে। এছাড়া, সরকার পোশাক শিল্পে কর ছাড়, সহজ ঋণ সুবিধা এবং বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল গঠন করেছে।
একটি সফল উদাহরণ হলো ‘বিজিএমইএ’ (বাংলাদেশ গার্মেন্ট ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন), যা তৈরি পোশাক রপ্তানি বাড়াতে এবং আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশকে ব্র্যান্ড হিসেবে তুলে ধরতে কাজ করছে।
বাংলাদেশি ব্র্যান্ডগুলো দেশীয় ব্র্যান্ড হিসেবে এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। এর পাশাপাশি, অনেক পোশাক প্রতিষ্ঠান পরিবেশবান্ধব এবং টেকসই উৎপাদনের দিকে মনোযোগ দিচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ, বাংলাদেশের বেশ কিছু কারখানা এখন বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় পরিবেশবান্ধব পোশাক কারখানা হিসেবে স্বীকৃত। বাংলাদেশ বর্তমানে বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ তৈরি পোশাক রপ্তানিকারক দেশ। ‘মেড ইন বাংলাদেশ’ ট্যাগটি এখন বিশ্বব্যাপী একটি ব্র্যান্ড হিসেবে পরিচিত।
সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য
বাংলাদেশ তার ঐতিহ্যবাহী পণ্য যেমন জামদানি শাড়ি, নকশিকাঁথা, এবং পিঠার সংস্কৃতিকে বিশ্বব্যাপী তুলে ধরছে। জামদানি শাড়ি ইতোমধ্যেই ইউনেস্কোর সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বাংলাদেশি সংস্কৃতি তুলে ধরার জন্য বিভিন্ন প্রদর্শনী ও মেলায় অংশগ্রহণ করা হয়। উদাহরণস্বরূপ, প্যারিস ফ্যাশন উইক, লন্ডনের ভিক্টোরিয়া অ্যান্ড আলবার্ট মিউজিয়াম, এবং ভারতের সুরজকুন্ড মেলায় জামদানি এবং নকশিকাঁথার প্রদর্শনী হয়েছে। এছাড়া, ‘ঢাকা আর্ট সামিট’ এবং ‘বাংলা উৎসব’–এর মতো ইভেন্টগুলো আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের শিল্প ও সংস্কৃতির সুনাম বৃদ্ধি করেছে।
বাংলাদেশ তার ঐতিহ্যবাহী পণ্য যেমন জামদানি শাড়ি, নকশিকাঁথা, এবং পিঠার সংস্কৃতিকে বিশ্বব্যাপী তুলে ধরছে। এছাড়া বাংলা সঙ্গীত, নৃত্য, এবং লোকজ সংস্কৃতি দেশের ব্র্যান্ডিংয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।
প্রযুক্তি ও স্টার্টআপ ইকোসিস্টেম
বাংলাদেশের প্রযুক্তি খাত এবং স্টার্টআপ সংস্কৃতি ক্রমেই উন্নতি করছে। বাংলাদেশি তরুণ উদ্যোক্তারা এখন আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিজেদের প্রমাণ করছেন। উল্লেখযোগ্য কিছু স্টার্টআপ হলো ‘পাঠাও’, যা বাংলাদেশ এবং নেপালে রাইড–শেয়ারিং এবং ডেলিভারি সেবা দিয়ে জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে, এবং ‘শেখো’, যা অনলাইন শিক্ষা প্ল্যাটফর্ম হিসেবে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেয়েছে। এছাড়া ‘ডেটা সফট’ এবং ‘রোবোস্ট্রাক’ এর মতো প্রতিষ্ঠানগুলোও প্রযুক্তি ক্ষেত্রে উদ্ভাবনী কাজ করছে।
সরকার স্টার্টআপ ইকোসিস্টেমকে এগিয়ে নিতে বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। ‘স্টার্টআপ বাংলাদেশ লিমিটেড’ হলো সরকারের একটি উদ্যোগ, যা নতুন উদ্যোক্তাদের আর্থিক সহায়তা প্রদান করে। এছাড়া, আইসিটি মন্ত্রণালয় বিভিন্ন প্রোগ্রাম চালু করেছে, যেমন ‘স্টার্টআপ ইকোসিস্টেম ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট’, যা তরুণ উদ্যোক্তাদের উদ্ভাবনী প্রকল্পকে সহায়তা করে। এইসব উদ্যোগ বাংলাদেশের প্রযুক্তি ও স্টার্টআপ ইকোসিস্টেমকে বিশ্বমঞ্চে আরও দৃঢ় অবস্থানে নিয়ে যাচ্ছে।
পর্যটন শিল্প
‘ভিজিট বাংলাদেশ’ ক্যাম্পেইন চালু করে বাংলাদেশ সরকার দেশের পর্যটন খাতকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে তুলে ধরতে কাজ করছে। সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশ বিশ্বের বিভিন্ন পর্যটন মেলায় অংশগ্রহণ করছে, যেমন বার্লিন আইটিবি, লন্ডন ওয়ার্ল্ড ট্রাভেল মার্কেট, এবং দুবাই ট্যুরিজম এক্সপো।
ব্যক্তিগত ব্র্যান্ডিংয়ে সোশ্যাল কারেন্সির ব্যবহার
ব্যক্তিগত ব্র্যান্ডিংয়ের জন্য সোশ্যাল কারেন্সি অত্যন্ত কার্যকরী একটি মাধ্যম। বাংলাদেশে যেহেতু সোশ্যাল মিডিয়ার ব্যবহার ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে, তাই একজন ব্যক্তি নিজেকে ব্র্যান্ড হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে এই টুলটি খুব সহজেই ব্যবহার করতে পারেন।
সফল কনটেন্ট শেয়ারিং
কোনো ব্যক্তি যদি তার সাফল্যের গল্প, অভিজ্ঞতা, বা অর্জন শেয়ার করেন, তবে তা তার পরিচিতি বাড়ায়। উদাহরণস্বরূপ, একজন ফ্রিল্যান্সার যদি তার ক্লায়েন্টদের ফিডব্যাক বা কাজের অভিজ্ঞতা শেয়ার করেন, তাহলে তা অন্যদের কাছে তার দক্ষতার প্রমাণ হয়।
মানবিক গল্প বলা
যে বিষয়গুলো আবেগকে স্পর্শ করে, সেগুলো মানুষ বেশি শেয়ার করে। যদি একজন ব্যক্তি তার জীবনের চ্যালেঞ্জ এবং তা কাটিয়ে ওঠার গল্প শেয়ার করেন, তাহলে তা মানুষের কাছে অনুপ্রেরণামূলক হয়ে ওঠে।
দৃশ্যমানতা বাড়ানো
বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মে সক্রিয় থেকে একজন ব্যক্তি তার উপস্থিতি বাড়াতে পারেন। উদাহরণস্বরূপ, একজন লেখক তার নতুন লেখা শেয়ার করতে পারেন বা একজন ফটোগ্রাফার তার কাজের ছবি পোস্ট করতে পারেন।
উপকারী তথ্য প্রদান
যে তথ্য অন্যের জন্য কার্যকরী, তা মানুষ বেশি শেয়ার করতে চায়। যেমন, একজন চাকরিপ্রার্থী যদি বিভিন্ন কোম্পানির নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি বা ইন্টারভিউয়ের টিপস শেয়ার করেন, তাহলে তা তার প্রোফাইলের মূল্য বাড়াবে।
ইনফ্লুয়েন্সার হিসেবে প্রতিষ্ঠা
যারা নিয়মিত এবং প্রাসঙ্গিক কনটেন্ট শেয়ার করেন, তারা ধীরে ধীরে ইনফ্লুয়েন্সার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হন। বাংলাদেশে অনেক তরুণ এখন এই কৌশল ব্যবহার করে সোশ্যাল মিডিয়ায় নিজেদের ব্র্যান্ড হিসেবে গড়ে তুলছেন। উদাহরণস্বরূপ, প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞরা টেক রিভিউ শেয়ার করছেন, ফিটনেস কোচরা স্বাস্থ্য বিষয়ক টিপস দিচ্ছেন।
লেখক: সিনিয়র ম্যানেজার, স্ট্র্যাটেজিক সেলস, এলিট পেইন্ট এন্ড কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ লিঃ।