আফ্রিকার দেশ মোজাম্বিক থেকে কয়লা নিয়ে সংযুক্ত আরব আমিরাতে যাওয়ার পথে ভারত মহাসাগরে জলদস্যুর কবলে পড়েছে বাংলাদেশি পতাকাবাহী জাহাজ এমভি আবদুল্লাহ। ওই জাহাজে ২৩ জন বাংলাদেশি নাবিক আছেন। তারা সবাই জিম্মি দশায় পড়েছেন বলে জানিয়েছে জাহাজের মালিকপক্ষ। জিম্মি ২৩ জন নাবিকের মধ্যে ১১ জনের বাড়ি চট্টগ্রামে। কেএসআরএম গ্রুপের মালিকানাধীন এসআর শিপিংয়ের জাহাজটি নৌপথে পণ্য পরিবহন করে। জাহাজের ক্যাপ্টেনের নাম আবদুর রশিদ।
১৪ বছরের মাথায় এসে আবার জলদস্যুদের কবলে পড়ল কেএসআরএম গ্রুপের জাহাজ। ২০১০ সালের ডিসেম্বরে আরব সাগরে সোমালি জলদস্যুদের কবলে পড়েছিল জাহাজ ‘জাহান মণি’। নিকেল ভরতি ওই জাহাজের ২৫ নাবিক এবং প্রধান প্রকৌশলীর স্ত্রীকে জিম্মি করা হয়। নানাভাবে চেষ্টার পর ১০০ দিনের মাথায় জলদস্যুদের কবল থেকে মুক্তি পান তারা। পরে তাদের দেশে ফিরিয়ে আনা হয়। এসআর শিপিংয়ের সিইও মোহাম্মদ মেহেরুল করিম বলেন, বাংলাদেশ সময় মঙ্গলবার (গতকাল) দুপুর দেড়টার দিকে জাহাজ থেকে তাদের বার্তা পাঠানো হয়। জাহাজ পুরোপুরি দস্যুদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। জলদস্যুরা ক্রুদের জাহাজের কেবিনে রেখেছে। আমরা বিস্তারিত জানার চেষ্টা করছি। রাতে শেষ খবরে জানা গেছে, জলদস্যুরা জাহাজটি সোমালিয়া উপকূলের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। প্রায় একশ জলদস্যু একযোগে জাহাজটিতে চড়াও হয় বলে নাবিকদের উদ্ধৃতি দিয়ে বিভিন্ন সূত্র জানিয়েছে।
জানা যায়, এসআর শিপিংয়ের মালিকানাধীন এমভি আবদুল্লাহ মোজাম্বিক থেকে কয়লা নিয়ে সংযুক্ত আরব আমিরাত যাচ্ছিল। নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে সোমালিয়া উপকূল থেকে প্রায় ৫শ নটিক্যাল মাইল দূর দিয়ে গন্তব্যে যাচ্ছিল। কিন্তু দুপুর ১টার দিকে ভারত মহাসাগরের গভীরে গিয়ে শতাধিক জলদস্যু একে–৪৭ রাইফেলসহ অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে জাহাজটির নিয়ন্ত্রণ নেয়। পৃথিবীর কুখ্যাত সোমালি জলদস্যুর দলটি এমভি আবদুল্লাহ দখল করার আগে উপকূলের কাছাকাছি থেকে মাছ ধরায় নিয়োজিত একটি ইরানি ফিশিং ভ্যাসেলের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছিল। ওই ফিশিং ভ্যাসেল নিয়ে তারা গভীর সমুদ্রে গিয়ে এমভি আবদুল্লাহ দখল করে।
রাতে শেষ খবর নিয়ে কেএসআরএম গ্রুপের উপ–ব্যবস্থাপনা পরিচালক শাহরিয়ার জাহান আজাদীকে বলেন, দস্যুরা আমাদের নাবিকদের সাথে খারাপ ব্যবহার করেনি। তাদের সাথে ভালো আচরণ করছে। আমাদের সকল নাবিক নিরাপদে রয়েছেন। তবে জাহাজের পুরো নিয়ন্ত্রণ দস্যুদের হাতে। তারা জাহাজটি সোমালিয়ার দিকে নিয়ে যাচ্ছে।
১৯০ মিটার লম্বা এমভি আবদুল্লাহ গত বছর এসআর শিপিং বহরে যুক্ত হয়। ২০১৬ সালে তৈরি জাহাজটির আগের নাম ছিল এমভি গোল্ডেন হক। কেএসআরএম গ্রুপের বহরে যুক্ত হওয়ার পর নাম হয় ‘এমভি আবদুল্লাহ’।
জিম্মি যারা : এমভি আবদুল্লাহ জাহাজে থাকা নাবিক ও ক্রুরা হলেন জাহাজের মাস্টার মোহাম্মদ আবদুর রশিদ, চিফ অফিসার মো. আতিক উল্লাহ খান, সেকেন্ড অফিসার মোজাহেরুল ইসলাম চৌধুরী, থার্ড অফিসার এন মোহাম্মদ তারেকুল ইসলাম, ডেক ক্যাডেট মো. সাব্বির হোসাইন, চিফ ইঞ্জিনিয়ার এএসএম সাইদুজ্জামান, সেকেন্ড ইঞ্জিনিয়ার মো. তৌফিকুল ইসলাম, থার্ড ইঞ্জিনিয়ার মো. রোকন উদ্দিন, ফোর্থ ইঞ্জিনিয়ার তানভীর আহমেদ, ইঞ্জিন ক্যাডেট আইয়ুব খান, ইলেকট্রিশিয়ান ইব্রাহীম খলিল উল্লাহ, এবি পদের মোহাম্মদ আনোয়ারুল হক, মো. আসিফুর রহমান, মো. সাজ্জাদ হোসাইন, জয় মাহমুদ, ওএস পদের মো. নাজমুল হক, অয়েলার পদের আইনুল হক, মোহাম্মদ শামসুদ্দিন, মো. আলী হোসেন, ফায়ারম্যান মোশাররফ হোসেন শাকিল, চিফ কুক মো. শফিকুল ইসলাম, জিএস পদের মোহাম্মদ নুর উদ্দিন ও ফিটার মোহাম্মদ সালেহ আহমদ। এর মধ্যে ১১ জনের বাড়ি চট্টগ্রামে। নোয়াখালীর দুজন। বাকিরা ফরিদপুর, টাঙ্গাইল, নওগাঁ, খুলনা, নেত্রকোনা, লক্ষ্মীপুর, ফেনী, নাটোর, সিরাজগঞ্জ ও বরিশালের।
নাবিকরা নিরাপদে আছেন : জাহাজের ২৩ নাবিক সুস্থ ও নিরাপদে আছেন উল্লেখ করে কেএসআরএম গ্রুপের ডিএমডি শাহরিয়ার জাহান জানান, নাবিকদের উদ্ধারে আন্তর্জাতিক নিয়ম অনুসরণ করা হচ্ছে।
বাংলানিউজ জানায়, নৌ মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, নাবিকেরা নিরাপদে রয়েছেন। নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় বিষয়টি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে জানিয়েছে। কর্মকর্তারা গণমাধ্যমকে জানান, সোমালিয়া থেকে প্রায় ৪৫০ নটিক্যাল মাইল দূরে সমুদ্রে প্রায় ১০০ দস্যু জাহাজটি তাদের নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে। তারা জানিয়েছেন, নাবিকদের উদ্ধারে আন্তর্জাতিক প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হচ্ছে।
বাংলাদেশ মার্চেন্ট মেরিন অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মো. শাখাওয়াত হোসেন জানান, অ্যাসোসিয়েশনের সঙ্গে জাহাজমালিক কর্তৃপক্ষের কথা হয়েছে। তারা জানিয়েছেন, জলদস্যুরা জাহাজের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার বেশ কিছুক্ষণ সময় পরেও জাহাজের মালিকপক্ষ ও তাদের পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পেরেছিলেন নাবিকরা এবং তারা সবাই সুস্থ আছেন। অ্যাসোসিয়েশন বাংলাদেশি নাবিকদের নিরাপত্তার বিষয়টিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, তারা জাহাজের মালিকপক্ষের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখছেন এবং বিষয়টি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছেন।
বিডিনিউজ জানায়, একটি মার্চেন্ট শিপের ক্যাপ্টেন আতিক ইউএ খান এক ফেইসবুক পোস্টে লিখেছেন, তিনি ইনবক্সে কিছু মেসেজ পেয়েছেন, যেখানে বলা হচ্ছে আনুমানিক ৫০ জন সশস্ত্র জলদস্যু ওই জাহাজে অবস্থান করছে। জাহাজটি সোমালিয়ার আশপাশে আছে। জিম্মিদের মধ্যে সাতজন বাংলাদেশ মেরিন একাডেমির সাবেক ক্যাডেট।
ছোট একটি ভিডিও তিনি ফেইসবুকে শেয়ার করেছেন। বলা হচ্ছে, জলদস্যুরা যখন ছোট ছোট বোটে করে এসে জাহাজের নিয়ন্ত্রণ নেয়, তখন একজন নাবিকের মোবাইলে ধারণ করা ভিডিও এটি।