সত্তর দশকের একজন প্রোজ্বল ছড়াকার সৈয়দ খালেদুল আনোয়ার। লোকজ ছড়ার অবয়বে মিষ্টি ছড়া নিয়ে তাঁর আবির্ভাব সেই সত্তরের পাড়ভাঙার দিনে। সেই যে শুরু সে থেকে আজ অবধি সব প্রকরণের ছড়ায় তিনি সমান পক্কতার পরিচয় দিয়ে চলেছেন। ঘুমপাড়ানিয়া তথা শিশুতোষ ছড়ার পাশাপাশি তিনি সমাজমনস্ক, হাস্য–কৌতুক, ব্যঙ্গাত্মক, ঘুম ভাঙানো ছড়ায়ও সপ্রাণ। তাঁর প্রথম প্রকাশিত বই সোনা রোদের হাসি (১৯৮৯) একটি নিটোল শিশুতোষ ছড়াগ্রন্থ। এরপর দীর্ঘ দুই দশকের বিরতিতে প্রকাশিত হয় জোড়াগ্রন্থ স্মৃতি আঁকা চিঠি (২০০৯), অসংগতির ছড়া (২০০৯)। এর ১১ বছর পর আবারো জোড়াগ্রন্থ প্রীতির জামা (২০২০) এবং মনের ছবি (২০২০) নিয়ে হাজির হন সৈয়দ খালেদুল আনোয়ার। তাঁর লেখালেখির সময়কাল বিচারে তাঁর গ্রন্থের সংখ্যা কম। সাকুল্যে পাঁচটি গ্রন্থের মধ্যে তিনটি ছড়ার এবং বাকি দুটো কিশোর কবিতার। অবশ্য প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা দিয়ে একজন লেখকের লেখালেখির মান বা মূল্যায়ন হতে পারে না। মূল্যায়ন হয় লেখা ও তার ভেতরের রসায়ন দিয়ে। এদিক দিয়ে সৈয়দ খালেদুল আনোয়ার সপ্রতিভায় দীপ্তিমান। শিশুতোষ ছড়ায় তিনি দীপ্ত ছড়িয়েছেন তা এখনো জ্বলজ্বলে সচেতন পাঠক হৃদয়ে।
২. তাঁর ‘মনের ছবি‘ কিশোর কবিতাগ্রন্থে ২০টি কিশোর কবিতা স্থান পেয়েছে। গ্রন্হভুক্ত কবিতাগুলোর বিষয় বৈচিত্র্যময় ও কৌতুহল জাগানিয়া । প্রকৃতির অপরূপ রূপের আধার বাংলাদেশ। ষড়ঋতুর পালাবদলে আমরা গ্রীষ্মের খরতাপ, বর্ষার ছন্দোময় বর্ষণ, শরতে রোদের ঝিকিমিকি, হেমন্তে ধান শালিক, শীতে নকশিকাঁথা আর বসন্তে কৃষ্ণচূড়ার মনছোঁয়া রূপ পর্যবেক্ষণ করি সেই নানারূপকে নিয়ে তিনি পঙক্তিমালায় সাজিয়েছেন একাধিক কবিতা। তেমনি মাথা উঁচু করে থাকা একুশ, প্রাণের দামে কেনা স্বাধীনতা উঠে এসেছে সমুজ্জ্বল প্রাণময়তায়। আছে মা–বাবাকে নিযে কবিতা এবং কিশোরের কৈশোরক ভাবনা ও দুরন্তপনার চিত্রকল্প।
‘চাঁদনী রাত্রে যখোন উঠোনে জোছনার ধারা ঝরে
আমার তখন জ্বলজ্বল করে আম্মুকে মনে পড়ে
চাঁদ থেকে নিয়ে আম্মু আমাকে দিতো জোছনার টিপ
তার তুলতলে কোল হয়ে যেতো সুখের রত্নদ্বীপ।’ (মনের ছবি, পৃষ্ঠা –০৫)
উপযুক্ত পঙক্তি কটিতে আমরা মায়ের অপার স্নেহ–মমতার আবেগময় প্রকাশ লক্ষ্য করি। জোছনা ধারা,জ্বলজ্বল,তুলতলে, রত্নদ্বীপ এই উপমাগুলো সহজাতভাবে এসেছে মায়ের ভালোবাসার প্রতীক হয়ে।
আমরা জানি, কিশোর কবিতার প্রাণ হচ্ছে আবেগ। উপমা, অনুপ্রাস, চিত্রকল্প, কল্পনার যতই ছড়াছড়ি থাক আবেগের প্রাবল্য ছাড়া কিশোর কবিতার প্রাণপ্রবাহে স্বতঃস্ফূর্ততা আসে না।কালজয়ী কিশোর কবিতাগুলো আমাদের সেই পথই নির্দেশ করে। সৈয়দ খালেদুল আনোয়ার–এর কিশোর কবিতায় আমরা সেই আবেগের বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাস প্রত্যক্ষ করি।
একইভাবে বাবা নামক মানুষটার প্রতিও তার সমান ভালোবাসা হৃদয় ছুঁয়ে যায়।
‘আজও জ্বলে বুকের ভেতর বাবার স্মরণশিখা / বাবার নামটি হয়নি দেশের ইতিহাসে লিখা। বাবা আমার ফুটিয়ে গেলো
স্বাধীনতার কলি/ আমি বাবার গর্ব নিয়ে হীরার মতো জ্বলি।‘ ( মনের ছবি,পৃষ্ঠা–২৪)
৩. পার্থিব জগতে বইই মানুষের একমাত্র ও বিশ্বস্ত বন্ধু। ফুল যেমন আপনার জন্য ফোটে না, বইও তেমনি। তাই বইয়ের পক্ষে সম্ভব এমন আহ্বান।
‘বই আমাকে ডেকে বলে, সকাল সন্ধ্যা রাতি,/ এসো খোকা তোমার ভেতর জ্বালাই জ্ঞানের বাতি।
….
জীবন দিয়ে রঙিন মধুর স্বপ্ন যদি আঁকো/ বন্ধু মেনে সারা জীবন আমার সাথে থাকো। বইয়ের সাথে তাই তো আমার
প্রাণের নিবিড় প্রীতি / কেউ পাবে না বইয়ের মতো বন্ধু এমন কৃতি।‘ (মনের ছবি, পৃষ্ঠা–০৭)
কিশোর কবিতার অন্যতম অনুষঙ্গ শৈশব–কৈশোরের দিনগুলো। সেই দিনগুলো হতে পারে সোনাঝরা কিংবা বিষাদে ভরা দিন ও রাতের মতো। সৈয়দ খালেদুল আনোয়ার এই গ্রন্থে দুটো কবিতা স্থান দিয়েছেন বড় বোন ও ছোটবেলার হারিয়ে যাওয়া বন্ধু সুমিকে নিয়ে। আসলে খুনসুটি আর প্রীতিময় সেই দিনগুলো কোনোভাবে ভুলা যায় না। যেমন ভুলতে পারেন না কবি ছোটবেলার খেলার সাথী সুমিকে। / ‘বছর ঘুরে আসলে শুভ জন্মদিন আমার / সুমি দিতো একটি রঙিন রুমাল উপহার,/ কুরুশ কাঁটায় সেই রুমালে তুলতো আমার নাম / পকেটে তা রাখতাম আমি না মুছে গা–র ঘাম। মিষ্টি বন্ধু সুমি এখন নেই পৃথিবীর নীড়ে / হারিয়ে গেছে ছোট্টবেলায় লক্ষ তারার ভিড়ে।‘ (মনের ছবি, পৃষ্ঠা–১৭)
তেমনি বেদনাময় ছবি প্রত্যক্ষ করা যায় ‘আপু তুমি‘ কবিতায়।
‘আমি এখন ছাদ বাগানে একা একাই হাঁটি / কেউ বলে না গল্প রাতে, রাত হয়ে যায় মাটি।‘ ( মনের ছবি, পৃষ্ঠা–১১)
এই হচ্ছে কিশোর কবিতা, যা পড়তে গিয়ে কখনো আনন্দে উড়ি, কখনো বিষাদে ভরে ওঠে মন।
৪. কিশোর কবিতায় গল্প থাকতে হয়। সে গল্প যখন পাঠকের মন ছুঁয়ে যায় তখন পাঠক উদ্দীপ্ত হয় সে কবিতার প্রতি। আলোচ্য গ্রন্থে এমন দুটো কবিতার নাম মনের ছবি ও মেঘের সাথি। দুটে কবিতার চিত্রকল্প যেমন মনকাড়া, তেমনি উপমা, অনুপ্রাস, শব্দচয়ন ও বাক্যগঠনে অনন্য।কিশোরের অন্তহীন ভাবনার রূপায়ন এ দুটো কবিতায় নতুন মাত্রা পেয়েছে। মনের ছবি কি আঁকা যায়? যায় না। তবু নাছোড়বান্দা কিশোর মা– বোন– ভাই–স্যার– দাদুর কাছে আবদার রাখে মনের ছবি এঁকে দিতে। কেউ যখন মনের ছবি এঁকে দিলো না তখন কিশোর–মনে প্রশ্ন জাগল, ‘মন কি তাহলে বহু বণের্র চঞ্চল পাখি বনের?’
কিশোরের মন বড়ই বিচিত্র। কখন কী তার মানসপটে খেলা করে বলা যায় না। এই তো সে মনের ছবি এঁকে দেওয়ার আবদার করল, পরক্ষণে তার ভাবনায় এলো মেঘের সাথি হতে। কারণ মেঘকে পড়তে হয় না, স্কুলে যেতে হয় না। মেঘ অবাধ, স্বাধীন। সেও চায় মেঘ হতে। কারণ
‘ইচ্ছে আমার হয় না মোটেও থাকতে ডুবে পাঠে
বইয়ের সঙ্গে খেলে খেলে দিন কি কারো কাটে?
কত্তো করে বলি মাকে আমাকে দাও ছুটি
আজকে না হয় মেঘের মতো আনন্দটা লুটি।‘
চমৎকার উপস্থাপনা। কিশোরমাত্রই অস্থির, দুরন্তপনা যার শিরায় বহমান। চুপচাপ, সুবোধ বালকের মতো বসে থাকা তার স্বভাবে পড়ে না।
৫. সৈয়দ খালেদুল আনোয়ার ছড়াকার হিসেবে যতটা আদৃত, ঠিক ততটাই কুশলি কিশোর কবিতায়। তিনি ভাষার সারল্যে, বাক্য ও শব্দের সহজিয়া চয়নে, ছন্দের সহজাত প্রকাশে এক একটি কিশোর কবিতার শরীর নির্মাণ করেছেন। চাইলে তিনি ছন্দের নিরীক্ষা, অতিপর্ব, ভাঙ্গা পর্ব কিংবা অতিরিক্ত পর্ব সংযোজনে চমক দেখাতে পারতেন। ভাবগম্ভীর শব্দচয়ন করতে পারতেন। সেই মেধা ও মনন তাঁর ছিল। কিন্তু তিনি তা থেকে সযত্নে বিরত থেকে সারল্যে ছিলেন স্থির, এখানেই তাঁর সার্থকতা–স্বকীয়তা। শৈলী থেকে প্রকাশিত গ্রন্থটির প্রচ্ছদ ও অলংকরণ করেছেন মোমিন উদ্দীন খালেদ। গ্রন্থটির দাম রাখা হয়েছে মাত্র ১৭০ টাকা। আমরা গ্রন্থটির বহুল প্রচার ও প্রসার কামনা করছি।
লেখক : প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট, শিশুসাহিত্যিক;
সম্পাদক–আলোর পাতা।