সেসব বৈশাখী বিকেল

কুমুদিনী কলি | শুক্রবার , ১৭ মে, ২০২৪ at ৭:৫২ পূর্বাহ্ণ

পুকুরের পুবপাড়ের সাদাটে ফুলের ঘ্রাণে আশৈশব নিমগ্ন থাকা ফুলের নামটি আমার জানা হলো আজ। তার নাম কুর্চি ফুল। ভীষণ টানটান একটা ঘ্রাণ!

এই সময়ে কুর্চি ফুটতো। অসাধারণ লাগতো দেখতে। এই বৈশাখের দাবদাহ শেষে, বর্ষা আসি আসি দিনগুলোতে কুর্চির যৌবন হয়তো শুরু হয়। সে কী রূপ তার! সে কী গন্ধ! মাতাল মাতাল লাগে!

আমি মহুয়া দেখিনি। সেই মহুয়া না দেখা চোখে কুর্চিতে আমার নেশা হয়ে গেলো ভীষণ। পুবপাড়ের আকাশ দেখতো আমাদের দৃষ্টি বিনিময়। সেই আকাশের নীলে কুর্চি তার পাপড়ি মেলতো। সেই নীল গায়ে মেখে কুর্চি হেসে উঠতো। বর্ষার ছাইরঙা মেঘে কাজল পরতো কুর্চি, সে তার ভিন্ন রূপ। বর্ষার ছাইরঙা মেঘে আকাশ আয়োজন করে কান্নার। তারপর যাবতীয় আয়োজন শেষে ঝরঝর করে তার অভিমান গলে জল হয়ে গড়িয়ে পড়ে পৃথিবীতে।

কী অপার্থিব সৌন্দর্য সে অভিমানের! অভিমান খুব সুন্দর একটি শব্দ, অভিমানের প্রকাশও তেমনিই সুন্দর। আকাশের অভিমান গলা জলে স্নাত হয় পৃথিবী! অতঃপর ভালোবাসার ঘনত্বও বাড়তে থাকে।

অভিমানগলা জলে কুর্চি স্নাত হয়, তার ভেজা পাপড়ি চুইয়ে চুইয়ে গড়িয়ে পড়ে ভালোবাসা।

পুবপাড়ের আকাশ জানে সে কেমনতর অপার্থিব দৃশ্য, কুর্চির ভালোবাসা কতটা নিরেট, কুর্চির নেশা কতটা প্রখর। তাতে আমি পুরোটা মগ্ন ছিলাম। একদিন কুর্চিকে আমার মনে পড়লো ভীষণ। তাকে দেখার বাসনায় আমি উন্মাতাল।

তাকে একটিবার খোঁপায় জড়িয়েছিলাম শুধু, সেই তো তার সাথে আমার প্রথম একাকার হয়ে থাকা। কী ভীষণ প্রেম আমাদের, কী ভীষণ বোঝাপড়া।

সারারাত খোঁপায় আলো হয়ে ছিলো আমার কুর্চি। সকালে পুকুরের স্থির জলে ভাসিয়ে দিয়েছিলাম মলিন মালাখানি। মনে পড়ে গেলো সেসব কথাও। কিন্তু কুর্চিকে আর দেখা হলো না।

কুর্চি বিরহ আবার জেগে উঠলো সেদিন, যেদিন কুর্চির গাছটিকে পুবপাড়ের কোথাও আর খুঁজে পেলাম না। মুহূর্তেই আলো ঝলমলে পুবপাড়ে সন্ধ্যার আঁধার ঘনিয়ে এলো যেনো। আমার আটপৌরে কুর্চি শেষ হয়ে গেলো আধুনিকতায়। এখন পুবপাড়ের নীলাকাশে পাপড়ি মেলে না কুর্চি। সেই আকাশ নিংড়ানো জলে আমার কুর্চি স্নাত হয় না আজকাল। ছাইরঙা মেঘে কাজল পরে না চোখে! কুর্চিকে কুর্চি বলে চিনতে না চিনতেই আমার জীবন থেকে হারিয়ে গেলো চিরতরে। আমার হৃদয়ের সমস্ত ভালোবাসা নিয়েই সে পালিয়ে গেলো, আমি তাকে আর খুঁজে পেলাম না।

এখনও তাই কামিনী দেখলেও কুর্চি অনুভবে দোলা দেয়, চাঁপাতেও তাই, অবেলার কদমেও। যেমনটি বেলীতে, জুঁইয়ে।

ভীষণ মনে পড়ে যায়, যখন তখন। পশ্চিমপাড়ের অমলতাসেও আজ বিরহগাথা।

লুকিয়ে লুকিয়ে পাতার ফাঁকে কুর্চিকে ভীষণভাবে দেখতে থাকা অমলতাসও আজ নেই। আধুনিকতা তাকেও গ্রাস করেছে। তার সোনারঙ চোখে মেখে সূর্যাস্ত দেখিনি সে কত কতকাল!

সেবার শেষ বেলায় বৃষ্টি শেষে রংধনু উঠলো যখন, তখন অমলতাসের ভরপুর যৌবন। আকাশের রংধনু নাকি আমার সোনারঙা অমলতাস ভেবেই পাইনি কাকে দেখবো। দুটোই চোখে প্রশান্তি এনে দেয়, মনে নিরেট ভালোবাসা।

কোথায় গেলো সেই সোনার বিকেলগুলো, সোনারঙা অমলতাস আর সাদাটে কুর্চির বিকেল, দেবী দিদিদের গাছের কৃষ্ণচূড়া, বেলী, মাধবীলতার ঝোপ।

যেখান দিয়ে হেঁটে যাবার ছুঁতো খুঁজতাম, একটু বুক ভরে ঘ্রাণ নেবার ছুঁতো।

সেসব বৈশাখী বিকেলের শীতল বাতাসে এমন নেশা নেশা ঘ্রাণ লেগে থাকতো, বুক ভরে নিঃশ্বাস নেয়া হলে মনে হতো জীবনে আর কী দরকার! আজও সেই জমানো নিঃশ্বাসে জীবন চলে যাচ্ছে, নতুন করে নিঃশ্বাস নেবার জন্য সেই বৈশাখী বিকেলগুলোকে আর খুঁজেই পেলাম না কোথাও!

পূর্ববর্তী নিবন্ধমা স্বর্গীয় সম্পদ
পরবর্তী নিবন্ধআসন্ন বাজেট এবং শ্রমজীবী মানুষের প্রত্যাশা