সেলসম্যানশিপ এবং এআই সঙ্কুল সময়

এম. এ. মুকিত চৌধুরী | সোমবার , ৭ এপ্রিল, ২০২৫ at ১১:০৯ পূর্বাহ্ণ

প্রতিটি সেলসপারসন কি ক্রেতা বা বিক্রেতা? আজকাল ব্যবসায়িক পৃথিবীতে সেলসপারসনের ভূমিকা অনেক বেশি জটিল এবং বৈচিত্র্যময়। সাধারণভাবে ভাবলে, সেলসপারসন মানে একজন বিক্রেতা, যিনি পণ্য বা সেবা বিক্রি করেন। কিন্তু যদি আমরা একটু গভীরভাবে বিশ্লেষণ করি, তাহলে দেখা যাবে, প্রতিটি সেলসপারসন আসলে কেবল বিক্রেতা নন, তারা অনেক সময় ক্রেতাও হয়ে থাকেন। তবে এই বিষয়টি বুঝতে হলে আমাদের কিছু নির্দিষ্ট ধারণা পরিষ্কার করা জরুরি।

এটা কি সত্যি?

সাধারণভাবে যদি আমরা বলি, ‘প্রতিটি সেলসপারসন একজন ক্রেতা বা বিক্রেতা’ তাহলে প্রথমেই প্রশ্ন উঠে আসে এটা কি বাস্তবে সঠিক? বাস্তবে, সেলসপারসনরা বিক্রয় প্রক্রিয়ার বিভিন্ন স্তরে কাজ করেন এবং সেই অনুযায়ী তাদের ভূমিকা এক সময় বিক্রেতা, আবার অন্য সময়ে ক্রেতা হতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, একজন সেলসপারসন পণ্য বিক্রি করার সময় বিক্রেতা হিসেবে কাজ করছেন, কিন্তু সেই একই সময়ে তিনি বাজার গবেষণা করে তথ্য সংগ্রহ করছেন, নতুন সম্পর্ক গড়ে তুলছেন, এবং তাদের নিজস্ব সংস্থার জন্য মূল্যবান রিসোর্স সংগ্রহ করছেন যা আসলে তাকে এক ধরনের ক্রেতার ভূমিকা প্রদান করে।

বিক্রেতা এবং ক্রেতার সম্পর্ক

প্রথাগতভাবে বিক্রেতা এবং ক্রেতা দুজনেই একে অপরের প্রতিপক্ষ হিসেবে বিবেচিত হতেন। বিক্রেতা চায় তার পণ্যের জন্য সর্বোচ্চ মূল্য আদায় করতে, আর ক্রেতা চায় সর্বনিম্ন মূল্য দিয়ে পণ্য বা সেবা পেতে। তবে আধুনিক ব্যবসায়িক দৃষ্টিকোণ থেকে, এই সম্পর্ক অনেকটাই পরিবর্তিত হয়েছে। এখন, বিক্রয় প্রক্রিয়া শুধুমাত্র একটি লেনদেন নয়, বরং একটি সম্পর্ক তৈরি করার প্রক্রিয়া, যেখানে বিক্রেতা তার ক্রেতার প্রয়োজনীয়তা বুঝে, তাদের সমস্যার সমাধান করতে সচেষ্ট থাকে।

আধুনিক বিক্রয় প্রক্রিয়া

আজকাল ব্যবসায়িক দুনিয়ায় সেলসপারসনরা শুধুমাত্র পণ্য বিক্রি করেই ক্ষান্ত হন না। তারা সম্পর্ক তৈরি করেন, পরামর্শ দেন, এবং ক্রেতার সমস্যা সমাধানে সহায়ক হন। এর ফলে, বিক্রেতা এবং ক্রেতার ভূমিকা একে অপরের মধ্যে মিশে যায়। যেমন:

রিলেশনশিপ সেলিং: সেলসপারসনরা ক্রেতার সাথে বিশ্বাস এবং সম্পর্ক গড়ে তোলেন, যাতে তারা শুধুমাত্র পণ্য বিক্রি না করে, ভবিষ্যতে আরও অনেক সুযোগ তৈরি করতে পারে।

কনসালটেটিভ সেলিং: সেলসপারসনরা ক্রেতার প্রয়োজন এবং সমস্যা বুঝে, তাদের উপযুক্ত সমাধান বা পণ্য পরামর্শ দেন।

ভ্যালুবেসড সেলিং: এখানে পণ্য বা সেবা বিক্রি করার চেয়ে ক্রেতাকে যে মূল্য বা সুবিধা দিচ্ছেন, সেটাই প্রধান বিষয়।

সলিউশন সেলিং: ক্রেতার সমস্যার সমাধান খোঁজাই মূল লক্ষ্য, পণ্য বা সেবা বিক্রির চেয়ে।

ক্রেতা এবং বিক্রেতার দ্বৈত ভূমিকা

একজন সেলসপারসন কখনো শুধু বিক্রেতা, কখনো শুধু ক্রেতা হন না। বরং তারা দুইটি ভূমিকা একসঙ্গে পালন করেন। তারা যেমন পণ্য বিক্রি করে থাকেন, তেমনই তারা তথ্য সংগ্রহ করেন, সম্পর্ক তৈরি করেন এবং কখনো কখনো তাদের সংস্থার জন্য ক্রয়ের সিদ্ধান্তও নেন। অর্থাৎ তারা ‘ক্রেতা’ হতে পারেন যখন তারা বাজারের তথ্য সংগ্রহ করেন বা নতুন সম্পর্ক তৈরি করেন, এবং ‘বিক্রেতা’ হন যখন তারা পণ্য বা সেবা বিক্রি করছেন।

সুতরাং ‘প্রতিটি সেলসপারসন একজন ক্রেতা বা বিক্রেতা’ এই ধারণা এক ধরনের সাধারণীকরণ হলেও, এটি আধুনিক বিক্রয় প্রক্রিয়ার পুরোপুরি ছবি তুলে ধরতে সক্ষম নয়। এক্ষেত্রে একটি সঠিক বিবৃতি হতে পারে: ‘প্রতিটি সেলসপারসন বিভিন্ন পর্যায়ে এবং প্রেক্ষাপটে ক্রেতা এবং বিক্রেতা উভয় ভূমিকা পালন করেন।’

সেলসপারসনের নিজেদের প্রয়োজনে কিভাবে অন্য সেলসপারসন থেকে কিনবে?

এখানে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন উঠে আসে সেলসপারসন নিজের প্রয়োজনের জন্য কিভাবে অন্য সেলসপারসনের কাছ থেকে কিছু কিনবেন?

ব্যবসায়িক বাস্তবতায়, একজন সেলসপারসন শুধুমাত্র পণ্য বিক্রির জন্য মাঠে নামেন না। তিনি প্রায়ই নিজেও একটি নির্দিষ্ট পণ্য, পরিষেবা বা তথ্যের জন্য ‘ক্রেতা’ হয়ে ওঠেন। উদাহরণস্বরূপ:

একজন রিটেইল সেলসপারসন হয়তো তার দোকানে বিক্রির জন্য পাইকারি বাজারে পণ্য সংগ্রহ করছেন।

একজন সফটওয়্যার সেলস এক্সিকিউটিভ হয়তো নিজ কোম্পানির কাজের জন্য CRM সফটওয়্যার কিনছেন।

বা, দুইজন সেলসপারসন হয়তো নিজেদের পণ্য বা পরিষেবা একে অন্যের কাছে সরবরাহ করছেন এটি হতে পারে পারস্পরিক ব্যবসার সুযোগও।

এই ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে গেলে, সেলসপারসনদের জন্য একটি নেটওয়ার্ক বা কমিউনিটি থাকা প্রয়োজন, যেখানে তারা একে অপরের কাছ থেকে কিনতে ও বিক্রি করতে পারেন, এবং নিজেদের সম্পর্ক ও ব্যবসার সুযোগ প্রসারিত করতে পারেন। এমন একটি প্ল্যাটফর্ম বা ইভেন্ট তৈরির চিন্তাও আজকের সময়ে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

এআই কি সেলসপারসনের চাকরির জন্য হুমকি?

যখনই প্রযুক্তি নতুন উন্নতি লাভ করে, তা স্বাভাবিকভাবেই মানুষের কর্মসংস্থানকে প্রভাবিত করে। আজকাল, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) ব্যবসায়িক দুনিয়ায় বিপ্লব সৃষ্টি করছে এবং এটি সেলসপেশার ক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম নয়। সেলসপারসনরা যে বিক্রয় প্রক্রিয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ, তা অব্যাহত রেখেও এআই তাদের ভূমিকা অনেকটা পরিবর্তন করতে পারে। তবে, এআই কি সেলসপারসনের চাকরির জন্য প্রকৃত হুমকি হতে পারে? আসুন, এ বিষয়ে কিছু দৃষ্টিকোণ পর্যালোচনা করা যাক।

এআই এর প্রবৃদ্ধি এবং সেলস পেশায় প্রভাব

. স্বয়ংক্রিয় প্রক্রিয়া ও অটোমেশন: এআইএর মাধ্যমে অনেক সেলস সম্পর্কিত কাজ অটোমেটেড হয়ে গেছে। যেমন, গ্রাহক যোগাযোগ, অনুসরণ, ডেটা বিশ্লেষণ এবং হালনাগাদ ইমেল পাঠানোর মতো কাজগুলি এখন সফটওয়্যার ও বটের মাধ্যমে করা সম্ভব। এছাড়াও, অনেক কোম্পানি এআই ব্যবহার করে সম্ভাব্য গ্রাহকদের চিহ্নিত করার জন্য ডেটা বিশ্লেষণ করে, যা সেলসপেরসনের কাজকে আরও সহজ এবং দ্রুত করে তোলে। এই উন্নত প্রযুক্তি সেলসপারসনদের জন্য কিছু সময় সাশ্রয় করতে পারে, তবে একে একে পুরো কাজের জন্য একটি কমপ্লিট প্রতিস্থাপন হতে পারে না।

. কাস্টমার সাপোর্ট এবং চ্যাটবটস: এআইভিত্তিক চ্যাটবটগুলি এখন গ্রাহক সেবা এবং সেলস প্রক্রিয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে উঠেছে। ক্রেতারা অনেক সময় দ্রুত উত্তর এবং ২৪/৭ সহায়তা চান, যা সেলসপারসনের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হতে পারে। চ্যাটবটগুলি গ্রাহকদের সহজ প্রশ্নের উত্তর দেয় এবং তাদের প্রাথমিক সমস্যা সমাধান করে, যা সেলসপারসনের জন্য সময় বাঁচাতে পারে। তবে, একটি বট মানুষের মতো সম্পর্ক তৈরি করতে, অনুভূতি বুঝতে এবং কাস্টমাইজড পরামর্শ দিতে সক্ষম নয়, যা এখনও সেলসপেশার একটি অপরিহার্য দিক।

. পণ্য সুপারিশ এবং পছন্দ অনুযায়ী বিক্রয়: এআই এখন ক্রেতাদের পছন্দ এবং ইতিহাস বিশ্লেষণ করে তাদের জন্য কাস্টমাইজড পণ্য সুপারিশ করতে পারে। এই পদ্ধতি অনেক সেলসপারসনের প্রচলিত কাজকে স্বয়ংক্রিয় করে, যেমন ক্রেতার আগের ক্রয়ের তথ্য বিশ্লেষণ করা বা তাদের বর্তমান চাহিদা অনুযায়ী পরামর্শ প্রদান করা। কিন্তু, এটি কোনও সেলসপারসনের বিক্রয় দক্ষতা এবং মানবিক সম্পর্ক স্থাপনের সক্ষমতার মতো কিছু প্রতিস্থাপন করতে পারে না।

সেলসপেশার জন্য কীভাবে সুযোগ তৈরি হচ্ছে?

এআই এবং অটোমেশন সেলস পেশাকে অনেক ক্ষেত্রেই আরও সহজ করে তুলতে পারে, কিন্তু এর মানে এই নয় যে সেলসপারসনের চাকরি হারিয়ে যাবে। বরং, এটি তাদের ক্ষমতাকে আরও শক্তিশালী করতে পারে। সেলসপারসনদের যে স্কিল এবং মানবিক সম্পর্ক গড়ে তোলার ক্ষমতা রয়েছে, তা কোনো এআই প্রযুক্তি রিপ্লেস করতে পারবে না।

. সম্পর্কভিত্তিক বিক্রয়: এআই কখনোই একজন সেলসপারসনের মতো মানুষের সাথে সম্পর্ক তৈরি করতে পারবে না। এআই গ্রাহকের সমস্যার দ্রুত সমাধান দিতে পারে, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদী সম্পর্ক গড়ে তোলা, বিশ্বাস তৈরি করা এবং মানসিক বা এক্সপেরিয়েন্সভিত্তিক বিক্রয় প্রক্রিয়া সম্পাদন করতে পারে না।

. পরামর্শমূলক ভূমিকা: একজন দক্ষ সেলসপারসন কেবল একটি পণ্য বিক্রি করেন না, তারা ক্রেতার চাহিদা ও সমস্যা বুঝে তাদের উপযুক্ত পরামর্শ দেন। যদিও এআই অনেক তথ্য সরবরাহ করতে পারে, কিন্তু এক্সপেরিয়েন্স এবং মানসিক বুদ্ধিমত্তা অনুযায়ী সঠিক পরামর্শ দেওয়ার জন্য একজন মানুষের দক্ষতা এখনও অপরিহার্য।

. কাস্টমাইজড সেলিং: এআই সেলসপ্রসেসকে দ্রুত এবং আরও প্রভাবশালী করতে পারে, তবে ব্যক্তিগত সম্পর্ক এবং বিশেষ চাহিদা অনুযায়ী পণ্য বা সেবা কাস্টমাইজ করার ক্ষেত্রে সেলসপারসনের দক্ষতা অপরিহার্য। মানবিক স্পর্শ এবং পণ্যের গুরুত্ব বুঝে সেলসপারসনরা একটি গ্রাহককেন্দ্রিক অভিজ্ঞতা তৈরি করতে পারেন, যা এআই কখনোই করতে পারবে না।

এআই এবং প্রযুক্তি বিক্রয় পেশায় অনেক পরিবর্তন আনতে পারে, তবে তা সেলসপারসনের কাজের শেষ নয়। বরং, এআই সেলসপারসনের দক্ষতাকে আরও সঠিকভাবে কাজে লাগানোর একটি উপায় হতে পারে। সেলসপারসনরা এআই থেকে প্রাপ্ত তথ্য এবং অটোমেশন ব্যবহার করে তাদের কাজ আরও কার্যকরী করতে পারেন, কিন্তু মানবিক সম্পর্ক, পরামর্শ দেওয়া এবং কাস্টমাইজড সেলিংয়ের ক্ষেত্রে তাদের দক্ষতা এবং অভিজ্ঞতা কখনোই এআই দ্বারা প্রতিস্থাপিত হবে না। সুতরাং, সেলসপেশার জন্য এআই একটি সহযোগী শক্তি হতে পারে, তবে এর আসল প্রতিযোগী বা হুমকি হতে পারে না।

এ চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় করণীয় কী?

এআই এর যুগে সেলসপারসনদের প্রাসঙ্গিকতা বজায় রাখার জন্য নিচের দিকগুলোতে মনোযোগ দিতে হবে:

মানবিক দক্ষতা বাড়ানো: যেমন ইমোশনাল ইন্টেলিজেন্স, পার্সোনালাইজড কমিউনিকেশন, ট্রাস্ট বিল্ডিং।

পরামর্শমূলক ও কনসালটেটিভ সেলিং: যেখানে আপনি ক্রেতার বাস্তব সমস্যা বুঝে সমাধান দিতে পারেন।

ডেটা লিটারেসি: এআই এবং সফটওয়্যারকে কাজে লাগিয়ে সঠিক তথ্য বিশ্লেষণ করে সিদ্ধান্ত নিতে পারার ক্ষমতা অর্জন করা। প্ল্যাটফর্ম ভিত্তিক পারস্পরিক সেলিং নেটওয়ার্কে যুক্ত হওয়া: যেখানে সেলসপারসনরাই একে অপরের থেকে কেনেন ও বিক্রি করেন।

এক্সপেরিয়েন্সড্রিভেন সেলিং: যেখানে গ্রাহকের অভিজ্ঞতা এবং সম্পর্কই বিক্রয়ের মূল চালিকা শক্তি। আজকের সেলসপারসন আর কেবল বিক্রেতা নন। তিনি একাধারে ক্রেতা, সমস্যা সমাধানকারী, পরামর্শদাতা এবং একজন বিশ্বাসযোগ্য সম্পর্ক নির্মাতা। এআই প্রযুক্তি তাকে প্রতিস্থাপন না করে বরং শক্তিশালী করে। তবে সেই সুযোগকে কাজে লাগাতে হলে, তাকে নিজের স্কিল ও দৃষ্টিভঙ্গি আধুনিক করতে হবে।

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণভাবে, সেলসপারসনদের নিজেদের জন্য এমন একটি সম্পর্কমুখী, ব্যবসায়িক নেটওয়ার্ক বা প্ল্যাটফর্ম তৈরি করতে হবে, যেখানে তারা একে অপরের কাছ থেকে কিনতে ও বিক্রি করতে পারেন। এতে শুধু বেঁচে থাকা নয়, বরং ভবিষ্যতের বিক্রয় জগতের নেতৃত্ব নেওয়া সম্ভব।

লেখক: সিনিয়র ম্যানেজার, স্ট্র্যোটেজিক সেলস, এলিট পেইন্ট এন্ড কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ লি:

পূর্ববর্তী নিবন্ধসুস্থ সুন্দর সমাজ বিনির্মাণে স্কাউট আন্দোলন জোরদার করা জরুরি
পরবর্তী নিবন্ধদূরের দুরবিনে