করোনাভাইরাসে আক্রান্ত অনেকে সেরে ওঠার পরও নানা শারীরিক ও মানসিক জটিলতায় ভুগছেন। কারও কারও ক্ষেত্রে তেমন জটিলতা দেখা যায় না। আবার কারও কারও ওপর করোনা দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব ফেলতে পারে বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। এইসব জটিলতা কাটিয়ে উঠতে কয়েক মাস সময় লাগতে পারে। কোভিড-১৯ থেকে সেরে ওঠার পরও প্রায় এক তৃতীয়াংশ রোগী শারীরিক বা মানসিক জটিলতায় ভুগছেন বলে জানিয়েছেন মেডিসিন বিশেষজ্ঞ নওসাবা নূর। একে বলা হয় পোস্ট কোভিড সিনড্রোম। খবর বিবিসি বাংলার।
কারণ : করোনায় আক্রান্ত হওয়ার পর শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ওই ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াই করতে থাকে। এই প্রতিরোধ ক্ষমতা এক পর্যায়ে অনিয়ন্ত্রিতভাবে সক্রিয় হয়ে শরীরের অন্যান্য অঙ্গ প্রত্যঙ্গে প্রদাহের সৃষ্টি করে। ফলে নানা শারীরিক জটিলতা দেখা দেয়। ভাইরাস যতটা না ক্ষতি করছে তার চাইতে বড় ক্ষতি হতে পারে যদি শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা অনিয়ন্ত্রিতভাবে কাজ করে, যা ফুসফুসসহ শরীরের নানা অঙ্গ প্রত্যঙ্গে আঘাত গানে। এটা মাল্টি সিস্টেম ডিসঅর্ডার। সাধারণত দুর্বলতা ও অল্পতেই হাঁপিয়ে ওঠার মতো সমস্যাগুলো থেকে যায়। শরীর ম্যাজম্যাজ করা, অস্থিসন্ধি ও মাংসপেশিতে ব্যথা, অবসাদ ও ক্লান্তি ভাব হয়। রোগীর স্বাস্থ্য পরিস্থিতি, লিঙ্গ ও বয়স ভেদে একেকজনের লক্ষণ একেক মাত্রার হতে পারে। তবে আগে থেকেই যারা বিভিন্ন জটিল রোগে আক্রান্ত তাদের বিভিন্ন অঙ্গ ঝুঁকির মধ্যে থাকে। ডা. নূর জানান, করোনা সবচেয়ে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে ফুসফুসে। অনেকে নেগেটিভ হওয়ার পরও তার কাশি, শ্বাসকষ্ট দীর্ঘদিন ধরে থেকে যেতে পারে। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা অনিয়ন্ত্রিতভাবে সক্রিয় হলে এটি ফুসফুসের দেয়ালে প্রদাহের সৃষ্টি করে, ফুসফুসে পানি জমে যায়। যার ফলে রোগীর স্বাভাবিকভাবে শ্বাস-প্রশ্বাস নিতে কষ্ট হয়। ফাইব্রোসিস একবার হলে সেটা পুরোপুরি ঠিক হওয়ার সম্ভাবনা কম থাকে।
কোভিড-১৯ ফুসফুসের রোগ বলা হলেও এটি হৃদপিণ্ডের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলে। সামপ্রতিক এক গবেষণায় অংশ নেওয়া কোভিড রোগীদের ৭৮% পরবর্তীতে হৃদপিণ্ডের নানা জটিলতায় আক্রান্ত হয়েছেন। করোনার কারণে রোগীর রক্ত জমাট বাঁধার আশঙ্কা থাকায় হার্ট এটাকের ঝুঁকিও বেড়ে যায় কয়েক গুণ।
যারা দীর্ঘদিন ধরে কিডনির জটিলতায় ভুগছেন এবং নিয়মিত ডায়ালাইসিস করতে হয় তারা করোনা থেকে সেরে ওঠার পরও বড় ঝুঁকিতে থাকেন। আর ভাইরাসজনিত রোগে আক্রান্ত হলে লিভার স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে বেশি সক্রিয় হয়।
এছাড়া অনেক রোগী অগ্নাশয় জনিত জটিলতায় আক্রান্ত হয়েছেন। এর ফলে রোগীদের পেটে তীব্র ব্যথা হয়। যাদের আগে থেকেই হাই প্রেশার, লো প্রেশার, কোলেস্টরেল বা ডায়াবেটিসজনিত সমস্যা আছে তারা কোভিড পরবর্তী সময়েও ঝুঁকিতে থাকেন।
করোনা থেকে সুস্থ হওয়ার পরও অনেক রোগী দীর্ঘদিন ধরে মানসিক উদ্বেগ, বিষণ্নতায় ভুগেছেন। অনেকে কাজে মনোযোগ দিতে পারছেন না। এক্ষেত্রে ধ্যান করার পাশাপাশি মানসিক বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়া জরুরি বলে মনে করেন ডা. নূর।
করণীয় : জাতীয় নীতিমালায় বলা আছে, করোনা আক্রান্ত হয়ে যদি কেউ হাসপাতালে ভর্তি থাকেন সেরে ওঠার পরও তার নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা করাতে হবে। সেরে ওঠার ৪৮ ঘণ্টা পর, এরপর ১ মাস, ৩ মাস ও ৬ মাস পর চিকিৎসকের পরামর্শে স্বাস্থ্য পরীক্ষা করানো জরুরি। সেই সঙ্গে পর্যাপ্ত বিশ্রাম নেওয়া জরুরি।
যারা আগে থেকে জটিলতায় ভুগছেন তাদেরকে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে বলেছেন ডা. নূর। চিকিৎসকের পরামর্শে ইনসুলিন বা ওষুধের মাত্রা ঠিক করে নেওয়া যেতে পারে। এছাড়া খাবারের দিকে নজর রাখতে হবে। প্রতিদিনের খাবারের তালিকায় সুষম খাবার রাখা জরুরি। সেই সঙ্গে প্রচুর পরিমাণ পানি, ফলের রস খেতে হবে। এছাড়া নিয়মিত অল্প করে ব্যায়াম করতে হবে।
রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে ভূমিকা রাখে ভিটামিন ডি। ভিটামিন ডি এর উৎস হলো সূর্য। সকাল ৯টা থেকে ১১টায় শরীরের চামড়ায় সরাসরি রোদ লাগানো বেশ প্রয়োজন। এছাড়া পরিবার পরিজন, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধুর সাথে দেখা করা সম্ভব না হলেও তাদের সাথে যোগাযোগ রেখে, বই পড়ে, গান শুনে বা সখের চর্চা করে মন উৎফুল্ল রাখা জরুরি।