‘আমার ফুফু মারা গেছেন। তার জানাজায় অংশ নিতে হাটহাজারী যাচ্ছি। কারফিউ চললেও নিরুপায়, যেতেই হবে। কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির জন্য শুরুতে কিছুটা ভয় থাকলেও এখন তা নেই। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বিশেষ করে সেনাবাহিনীর তৎপরতা শুরু হওয়ার পর দুষ্কৃতকারীরা পালিয়েছে। তাই পথের নিরাপত্তা নিয়ে কোনো ভয় কাজ করছে না।’ গতকাল সন্ধ্যা ৬টা দিকে নগরের মুরাদপুরে আজাদীকে এসব কথা বলেন সজীব নামে এক পথচারী। তিনি নগরের ডবলমুরিং এলাকার বাসিন্দা। শুধু সজীব নয়। পৃথক আটজনের সঙ্গে কথা হয় আজাদীর। সবার কথা প্রায় অভিন্ন। তারা জানিয়েছেন, কারফিউ জারির সঙ্গে সঙ্গে সেনাবাহিনীর টহল শুরু হওয়ার পর জনমনে স্বস্তি এসেছে। তাই জরুরি কাজে নির্ভয়ে বের হচ্ছেন তারা।
মুবিন নামে এক পথচারী আজাদীকে বলেন, আন্দোলন চলাকালে ঢাকাসহ দেশের অন্যান্য এলাকার মতো চট্টগ্রামেও কয়েক জায়গায় নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি তৈরি হয়। এতে সবার মধ্যে আতংক ভর করে। কিন্তু যখন সেনাবাহিনী মাঠে নামে তখন থেকে সবাই আশার আলো দেখে। নিমিষেই সব ভয় এবং আতংক দূর হয়। কারণ সেনাবাহিনীর টহল শুরুর পর স্বাভাবিক হতে শুরু করে চট্টগ্রামের পরিস্থিতি।
জানা গেছে, কোটা সংস্কার আন্দোলন নিয়ে সারা দেশে নৈরাজ্য–নাশকতা ও বিশৃঙ্খলা হওয়ায় শান্তি–শৃক্সখলা রক্ষা এবং জানমালের নিরাপত্তা বিধানের লক্ষ্যে চট্টগ্রামসহ সারা দেশে ১৯ জুলাই দিবাগত রাত ১২টায় কারফিউ জারি করা হয়। একইসঙ্গে বেসামরিক প্রশাসনকে সহযোগিতা করার জন্য মোতায়েন করা হয় সেনাবাহিনী। এর অংশ হিসেবে পরদিন ২০ জুলাই সন্ধ্যা থেকে সেনাবাহিনীর ২৪ ডিভিশনের গঠিত ‘টাস্কফোর্স–৪’ মাঠে নামে নগরে। তখন থেকে প্রতিদিন ২৪ ঘণ্টা নগরে টহল দিচ্ছে সেনাবাহিনী। একইসঙ্গে বিভিন্ন স্থানে চেকপোস্ট বসিয়ে জননিরাপত্তা নিশ্চিতে কাজ করে যাচ্ছে সেনাবাহিনী। মূলত সেনাবাহিনীর এসব তৎপরতা শুরু হওয়ার পর থেকে ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হতে শুরু করে নগরের পরিস্থিতি। এতে স্বস্তি আসে জনমনে। সেনাবাহিনীর ২৪ ডিভিশনের গঠিত টাস্কফোর্স–৪ এর দায়িত্বশীল প্রতিনিধির সঙ্গে আলাপকালে জানা গেছে, শহরের বিভিন্ন এলাকায় টহল দেওয়া হচ্ছে। বিশেষ করে চান্দগাঁও, বাকলিয়া, কোতোয়ালী, চকবাজার, বায়েজিদের কিছু এলাকায় ২৪ ঘণ্টা টহল দিচ্ছেন তারা। অর্থাৎ যখন কারফিউ শিথিল থাকে তখনও সাধারণ মানুষের নিরাপত্তার কথা ভেবে টহল দিয়েছে সেনাবাহিনী। এছাড়া কন্ট্রোল সেল থেকে ২৪ ঘণ্টা সবকিছু মনিটরিং করা হচ্ছে। ফলে পরিস্থিতি স্বাভাবিক আছে।
জানা গেছে, ২৪ ডিভিশনের গঠিত টাস্কফোর্স–৪ এর মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে জননিরাপত্তা নিশ্চিত করা। টাস্কফোর্স–৪ শহরের কিছু কিছু এলাকাকে ঝুঁকিপূর্ণ চিহ্নিত করে সেখানে নিরাপত্তা নিশ্চিতে গুরুত্ব দেওয়া হয়। ওসব এলাকায় টহল, মনিটরিংয়ের পাশাপাশি চেকপোস্ট বসানো হয়। এক্ষেত্রে কোটা আন্দোলন চলাকালে সংঘর্ষ হয়েছে বা আন্দোলকারীদের অবস্থান ছিল এমন এলাকা প্রাধান্য পাচ্ছে। যেমন মুরাদপুর, জিইসি, বহদ্দারহাট, লালদীঘি, চকবাজার, শাহ আমানত ব্রিজসহ আশেপাশের এলাকা। এছাড়া এখানে যেসব কেপিআইভুক্ত এলাকা আছে সেখানেও নিরাপত্তা নিশ্চিতে নজরদারি করছে সেনাবাহিনী। এছাড়া বিটিভি চট্টগ্রাম কেন্দ্র, বিটিসিএল, রেল স্টেশন, বিভিন্ন পেট্রোল পাম্পসহ অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ স্থানে নিরাপত্তা নিশ্চিতে বেশি জোর দিচ্ছে টাস্কফোর্স–৪।
সাধারণ মানুষ জানিয়েছেন, সেনাবাহিনীর টহল শুরু হওয়ার পথ থেকে কোথাও কোনো মিছিল হয়নি। তবে কোথাও কৌতূহলী লোক জমায়েত হলেও তারা সেনাবাহিনীর টহল টিম দেখামাত্র সরে গেছে। তবে জরুরি প্রয়োজনে বের হয়েছেন বা জনস্বার্র্থে যেসব ‘মুভমেন্ট’ ছিল তাতে বাধা দেওয়া হয়নি। বরং তাদের নিরাপত্তার দিকে সজাগ দৃষ্টি ছিল সেনাবাহিনীর।
টাস্কফোর্স–৪ সূত্রে জানা গেছে, যারা কারফিউর মধ্যে চলাফেরা করছে, উপযুক্ত কারণ বলতে পারেনি এবং কাগজপত্র ছিল না এমন লোকজন ও মোটরসাইকেল আরোহীকে আটক করে পুলিশের কাছে সোপর্দ করা হয়েছে। যার সংখ্যা ১২। এছাড়া কারফিউ চলাকালে যারা গ্যাস, বিদ্যুতের বিল পরিশোধে বা প্রিপেইড মিটারের কার্ড সংগ্রহে বের হয়েছেন, তারা যেন নির্বিঘ্নে কাজ সারতে পারে সেটাও খেয়াল রাখে সেনাবাহিনী।
টাস্কফোর্স–৪ এর দায়িত্বশীল প্রতিনিধির সঙ্গে আলাপকালে জানা গেছে, টহলের পাশাপাশি কোথাও কোনো অপ্রীতিকর খবর পেলে দ্রুত সেখানে উপস্থিত হচ্ছেন সেনাবাহিনীর সদস্যরা। গত সোমবার শহরের কয়েক জায়গা থেকে গায়েবানা জানাজা হবে এমন তথ্য পেয়ে উপস্থিত হন সেনাবাহিনীর সদস্যরা। ফলে সেখানে গায়েবানা জানাজার আয়োজন করেনি কেউ। পাশাপাশি জেলা প্রশাসন থেকে কোনো ইনফরমেশন পেলে সেখানেও দ্রুত উপস্থিত হচ্ছেন সেনাবাহিনী।
এদিকে কক্সবাজারে আটকে পড়া পর্যটকদের আইনশৃক্সখলা রক্ষাকারী বাহিনীর সহযোগিতায় ঢাকায় পৌঁছে দেওয়া হয় গতকাল। নগরে তাদের নিরাপত্তা দিয়েছে টাস্কফোর্স–৪।