চট্টগ্রাম আদালতের মহানগর পিপি অফিসের সামনে থেকে গায়েব হওয়া সেই ১,৯১১ টি মামলার কেইস ডকেট বা সিডির হদিস মিলেছে একটি ভাঙারির দোকানে। এ ঘটনায় মো. রাসেল নামের এক যুবককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তার বয়স ১৯। কুমিল্লার মুরাদনগরের রামচন্দ্র পুর এলাকার মো. হবি মিয়ার ছেলে তিনি। নগরীর বাকলিয়ার বউবাজার এলাকার একটি চায়ের দোকান থেকে গতকাল ভোর রাতে অভিযান চালিয়ে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। বউবাজারেই পরিবারের সাথে থাকতেন রাসেল।
মূলত তার কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে নগরীর কোতোয়ালী থানাধীন সতীশ বাবু লেইনের সোবহান সওদাগর মসজিদ এলাকার আকবর কলোনির ৭ নম্বর রুমে এসব সিডির হদিস মেলে। পরে সেগুলো উদ্ধার করা হয়। সিডিগুলো ৯ টি বস্তায় ভরা অবস্থায় ছিল। যে রুম থেকে সিডি উদ্ধার করা
হয়েছে সেটি মফিজের ভাঙারির দোকান হিসেবে পরিচিত। কেজি প্রতি ১৬ টাকা দরে এসব সিডি মো. রাসেল ভাঙারির দোকানটিতে বিক্রি করেছিল।
কোতোয়ালী থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মো.আফতাব হোসেন দৈনিক আজাদীকে এসব তথ্য নিশ্চিত করেন। তিনি বলেন, সোর্সের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে প্রথমে আমরা রাসেলকে গ্রেপ্তার করি। পরে তার দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে একটি ভাঙারি দোকান থেকে আদালতের পিপি অফিসের সামনে থেকে গায়েব হওয়া কেইস ডকেট বা সিডিগুলো উদ্ধার করি। গায়েব হওয়া ৯ বস্তা সিডির সবগুলোই উদ্ধার করা হয়েছে বলে জানান তিনি।
পরিদর্শক মো.আফতাব হোসেন বলেন, আদালত ভবনে থাকা সিসিটিভি ফুটেজে মো. রাসেলকে দেখা গিয়েছিল। তিনি মাথায় করে আদালত ভবন থেকে বস্তাভর্তি কেইস ডকেট নামাচ্ছিলেন। সেটি আমাদের এক সোর্সকে দেখালে তিনি রাসেলকে চিনতে পারেন। এরই ধারাবাহিকতায় তাকে ধরতে অভিযান চালানো হয়। মহানগর পিপি অফিসের সামনে থেকে কেইস ডকেট বা সিডি গায়েব হওয়ার এ ঘটনায় পিপি অফিসের অফিস সহকারী পলাশ দে বাদী হয়ে অজ্ঞাতদের বিরুদ্ধে গতকাল কোতোয়ালী থানায় একটি চুরির মামলা দায়ের করেছেন (ঘটনার পরপর পিপি মফিজুল হক ভূইয়া নিজে একটি জিডি করেছিলেন)।
এ বিষয়ে পরিদর্শক মো. আফতাব হোসেন বলেন, পিপি অফিসের অফিস সহকারীর মামলায় গ্রেপ্তার মো. রাসেলকে আদালতে পাঠানো হয়েছে। আমরা তাকে জিজ্ঞাবাদের জন্য ৭ দিনের রিমান্ড চেয়ে একটি আবেদন করেছি।
নগর পুলিশের অতিরিক্ত উপকমিশনার (প্রসিকিউশন) মফিজ উদ্দিন দৈনিক আজাদীকে বলেন, থানা পুলিশ গ্রেপ্তার মো. রাসেলকে আদালতে হাজির করলে মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট কাজী শরীফুল ইসলাম তাকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন। চট্টগ্রাম আদালতপাড়ার নতুন আদালত ভবনের তৃতীয় তলায় মহানগর পিপির অফিস। অফিসটির বাইরে বারান্দায় প্লাস্টিকের ৯ টি বস্তায় ভরে ১ হাজার ৯১১টি মামলার সিডি রাখা হয়েছিল। এসব সিডি গায়েব হয়েছে মর্মে গত ৫ জানুয়ারি নগরীর কোতোয়ালী থানায় একটি জিডি করেন চট্টগ্রাম মহানগর পিপি মফিজুল হক ভূইয়া। জিডিতে তিনি উল্লেখ করেন, মহানগর পিপি অফিসে প্রায় ২৮ থেকে ৩০টি আদালতের কেইস ডকেট রাখা ছিল। পিপি অফিসে জায়গার স্বল্পতার কারণে ২০২৩ সালের ২৪ এপ্রিল পিপি অফিসের সামনের বারান্দায় প্লাস্টিকের বস্তায় মোট ১ হাজার ৯১১টি মামলার কেইস ডকেট পলিথিনে মুড়িয়ে স্তূপ আকারে রাখা ছিল। সর্বশেষ গত বছরের ১২ ডিসেম্বর মহানগর কোর্টের ভেকেশন কোর্ট ছিল। তারপর থেকে মহানগর আদালত ও পিপি অফিস বন্ধ থাকা অবস্থায় গত বছরের ১৩ ডিসেম্বর থেকে ৩১ ডিসেম্বর তারিখের মধ্যে সেগুলো হারিয়ে গেছে। আশেপাশে খোঁজাখুঁজি করেও কেইস ডকেটগুলো পাওয়া যায়নি। আদালত সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, একটি মামলার অনেকগুলো কাগজপত্র থাকে। এর মধ্যে কিছু কাগজপত্র তদন্ত কর্মকর্তা বা থানা, পিপি ও আদালত এই তিনটি জায়গায় থাকে। আবার কিছু কাগজপত্র, বিশেষ করে তদন্ত সংশ্লিষ্ট কাগজপত্র তদন্ত কর্মকর্তা বা থানা ও পিপির কাছে থাকে। আদালতের কাছে থাকে না। সেই হিসাবে হারিয়ে যাওয়া মামলার কেইস ডকেটগুলো গুরুত্বপূর্ণ। এদিকে গত ৭ জানুয়ারি চট্টগ্রাম মহানগর দায়রা জজ আদালতের প্রশাসনিক কর্মকর্তা স্বপন কুমার সরকার একটি প্রেস রিলিজের মাধ্যমে জানিয়েছেন, গত ৬ জানুয়ারি দেশের বিভিন্ন সংবাদপত্রে চট্টগ্রাম আদালতে ১ হাজার ৯১১ টি মামলার নথি গায়েব, থানায় জিডি শীর্ষক একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদ এ বিষয়ে তার উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন এবং চট্টগ্রাম–১ অঞ্চলের জন্য নিযুক্ত মনিটরিং কমিটি ফর সাব অর্ডিনেইট কোর্টস এর প্রধান হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি এস এম কুদ্দুস জামানকে একটি তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের জন্য নির্দেশ প্রদান করেন। পরবর্তীতে বিচারপতি এস এম কুদ্দুস জামান একটি প্রতিবেদন দাখিল করেন।
যেখানে তিনি উল্লেখ করেন, চট্টগ্রাম মহানগর দায়রা জজ আদালতের কোনো এজলাস বা চেম্বার হতে কোনো ফৌজদারি মামলার নথি চুরি হয়নি। সংবাদপত্রে যে ১ হাজার ৯১১ টি কেইস ডকেট চুরির বিষয়ে উল্লেখ করা হয়েছে, সেগুলো চট্টগ্রাম মহানগর দায়রা জজ আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটরের কার্যালয়ের বারান্দা থেকে চুরি হয়েছে। উক্ত কেইস ডকেটগুলো ছিল ২০১৫ সালের পূর্বের ফৌজদারি মামলা সংক্রান্তে, বেশির ভাগ মামলা পূর্বে নিষ্পত্তি হয়ে গেছে। তাছাড়া, ফৌজদারি যে কোনো মামলার কেইস ডকেটের একটি কপি সংশ্লিষ্ট সার্কেল সহকারী পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে সংরক্ষিত থাকায় আদালতে বিচারাধীন কোনো ফৌজদারি মামলা ক্ষতিগ্রস্ত হবে না বলেও জানানো হয়।