সেই চিঠি আর আসে না…

আজাদী প্রতিবেদন | বৃহস্পতিবার , ৯ অক্টোবর, ২০২৫ at ১০:২৮ পূর্বাহ্ণ

করুণা করে হলেও চিঠি দিও, ভুলে গিয়ে ভুল করে একখানি চিঠি দিও খামে’কবি মহাদেব সাহার ‘চিঠি দিও’ কবিতার এই লাইনগুলোই বলে দেয় প্রিয়জনের একটি চিঠির জন্য কতটা ব্যাকুল থাকত মানুষ। প্রিয়জনকে চিঠি পাঠিয়ে মানুষ উত্তরের জন্য তীর্থের কাকের মতো অপেক্ষা করত, কখন আসবে ডাক পিয়ন। আধুনিক প্রযুক্তির কল্যাণে চিঠি ও ডাকঘর সেই আবেদন হারিয়েছে।

হলুদ খামের সেই গন্ধ, সেই চিঠি, সেই চিঠির লাল বাক্সমনে আছে কি কারো? তবে এখনো শহরের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ মোড়ে এবং গ্রামের হাটবাজার গুলোর কোনো এক কোনে অযত্নঅবহেলায় পড়ে থাকা ধুলোমাখা লাল রঙের পুরোনো চিঠির বাক্স গুলো এখনো আমাদেরকে মনে করিয়ে দেয়চিঠির জন্য অপেক্ষা, তবু চিঠি আসে না, কেউ চিঠি লেখে না। রাস্তার পাশে পড়ে থাকে ধুলো জমা ডাকবাক্স। ভাঙাচোরা সাইকেলে চড়ে সময়মতো ডাকবাক্সের তালা খুলতেও আসেন না ডাকপিয়ন। আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তি ও যোগাযোগমাধ্যম নিয়েই ব্যস্ত সবাই। আর এভাবেই দিন দিন বিলীন হয়ে যাচ্ছে চিঠির চিরায়ত চিত্র। আধুনিকতার সঙ্গে তাল মেলাতে না পেরে হারিয়ে যাচ্ছে ডাক বিভাগের পোস্টাল সার্ভিস বা ডাকসেবা।

প্রাণে প্রাণ মেলাতে আর হৃদয়ের গভীরতম কথাগুলো প্রিয়জনের কানে সঙ্গোপনে শুনিয়ে দেয়াই চিঠির দায়িত্ব ছিল। অবাধ ইন্টারনেট আর প্রযুক্তির এই যুগে চিঠিপত্রের আবেদন যেন আর টিকছে না। যুগের পর যুগ মানুষের আবেগভালোবাসার কথাগুলো বাতাসে ভেসে বেড়ানোর মতো চিঠির খামে খামে পৌঁছে যেত আপনজনের হাতে। তীব্র আবেগে সেই চিঠি ঘরের কোণে মিটিমিটি আলোতে বসে বারংবার পড়তো প্রিয়জন। সেই মহানন্দের কাহিনী আজকাল শুধুই দাদাদাদির মুখে মুখেই প্রচলিত। আবেদনময় সেই চিঠি এখন কেবল পরীক্ষার খাতায় মার্কস তোলার ক্ষেত্রেই চিঠি লিখতে হচ্ছে। প্রকৃতপক্ষে বর্তমানে কারিকুলামে যা শেখানো হয়, তা শুধুই পরীক্ষার খাতায় বন্দি।

চিঠির বিপরীতে এসেছে উন্নত যোগাযোগ মাধ্যম। যেমনফেসবুক, ভাইবার, ইমু, হোয়াটসঅ্যাপ ইত্যাদি। চোখের পলক পড়তে না পড়তেই নিজের মনের কথা কিংবা বার্তা পৌঁছে দেয়া যায় পৃথিবীর সকল প্রান্তে। তথ্যপ্রযুক্তির এই অবাধ প্রবাহ বিশ্বটাকে খুবই সংকুচিত করে দিয়েছে, এর সুফলের পাশাপাশি কুফলও রয়েছে। তাই বলে কি চিঠির কোনো গুরুত্বই রইলো না? আমরা খুব সহজেই যান্ত্রিক হয়ে যাচ্ছি। খুব কম সময়ে পৌঁছে যাওয়া বার্তাগুলো খুব কম সময়ই মনের স্টোরেজে থাকে, অথচ চিঠিতে পাওয়া প্রত্যেকটা শব্দই যেন কতটা আবেগজড়িত, কতটা স্নিগ্ধ।

এক সময় ব্যক্তিগত পর্যায়ে যে সব চিঠি লেখা হতো, সেগুলো নিছক চিঠিই ছিল না। এর মাধ্যমে তৎকালীন আর্থসামাজিক এবং রাজনৈতিক বিষয়গুলোও উঠে আসত। বিখ্যাত মানুষের এমন বহু চিঠি পরবর্তীকালে সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছে। বহু চিঠি ব্যাপক মূল্যে নিলামে বিক্রি হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম বা শরৎচন্দ্র চট্টোপ্যাধায়ের কয়েক হাজার চিঠি সাহিত্যের সম্পদ। আত্মউদ্ঘাটনমূলক বা প্রয়োজননির্ভর এই সব পত্রে তাদের জীবনের অনবদ্য অনুভূতি উপলদ্ধি ব্যক্ত করেছেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পাঁচ হাজারের বেশি চিঠি লিখেছেন। যার মধ্যে প্রায় চার হাজার সাময়িক পত্রপত্রিকায় ছাপা হয়েছে। তিন শতাধিক ব্যক্তির সঙ্গে তার পত্রে যোগাযোগ হয়েছে। এমন চিঠি এখন লেখা হয় না বললেই চলে।

বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমান তার স্ত্রীকে যেই চিঠি পাঠিয়েছিলেন, সেটা কে না পড়েছে! আব্রাহাম লিংকনের তার পুত্রের শিক্ষকের প্রতি চিঠির কথাও অবিস্মরণীয়। চিঠিকে কেন্দ্র করে লেখা হয়েছে কতশত গান আর কবিতা।

দু’তিন যুগ আগেও ভালোবাসার প্রথম আবেদন পাঠানোর একমাত্র মাধ্যম ছিল চিঠিপত্র। সেই ভালোবাসাও যেমন আজ বিলীন, তেমনি চিঠির আদানপ্রদানও নেই। সময় এসেছে চিঠির ব্যবহার বাড়ানোর। চিঠিই পারে মনের মনিকোঠায় এঁকে দিতে ভালোবাসা পরম অনুভূতি।

একটা সময় ছিল যখন ডাকপিওন বা রানার হাতে লণ্ঠনবর্শা এবং কাঁধে চিঠির ঝোলা নিয়ে খুব ভোরে ডাকঘরে পৌঁছে যেত। সেই ঝোলায় শুধু যে চিঠি থাকত তা নয়, তখন প্রত্যন্ত এলাকার প্রিয়জনের কাছে টাকা পাঠানো হতো ডাক ব্যবস্থার মাধ্যমে। এই তিন দুই দশক আগেও, যখন মোবাইল ফোন বা ইন্টারনেট মানুষের হাত হাতে পৌঁছায়নিতখন বস্তা বস্তা চিঠি আদানপ্রদান হতো। ২০০৪ সালেও দেশে ২৩ কোটি চিঠি লেনদেন হয়েছে। কিন্তু ক্রমে চিঠির সংখ্যা কমতে থাকে। কমতে কমতে ২০১৫ সালে সেই সংখ্যা এসে ঠেকেছে চার কোটিতে। ২০২০২০২১ সালে এক কোটিতে এসে ঠেকেছে।

ডাক বিভাগের মোমিন রোড এলাকার ডকিপিয়ন আবদুর রহমান বলেন, সরকারি ডাকের মাধ্যমে এখন যে সব চিঠি আদানপ্রদান হয়, সেটির বেশির ভাগ সরকারের বিভিন্ন দপ্তরের বা সরকারিবেসরকারি সংস্থায় নিয়োগ সংক্রান্ত চিঠি। ব্যক্তিগত চিঠির আদানপ্রদান বহুলাংশে কমে গেছে। আনোয়ারা উপজেলার পাঠনীকোঠাশিলালিয়া এলাকার ডাকপিয়ন টেবুল চক্রবর্তী বলেন, আমি যখন ৪০ বছর আগে ডাকবিভাগে কাজ শুরু করি যখন প্রতিটি গ্রামে প্রতিদিন কয়েকটি চিঠি আসতো, প্রতি মাসে মানি আর্ডারের টাকা আসতো। এখন মাসে একটি চিঠিও আসেনা! বছরে কয়েকটি চিঠি আসে, কারো চাকরির চিঠি, করো জমিজমা সংক্রান্ত বা নোটিশ জাতীয় চিঠিপত্র। অন্য কোনো চিঠি আসে না। তারপরও প্রতিদিন একবার ডাকঘরে যাই, ঘুরে আসি। গুরুত্ব কমে গেলেও সরকারি বিভিন্ন দপ্তরের চিঠি আদান প্রদান, চাকরির আবেদন, সঞ্চয়পত্র লেনদেনসহ বিভিন্ন গুরত্বপূর্ণ কাজের জন্য এখনও ডাকঘরে যেতে হয়। কিন্তু প্রিয়জনের হাতের লেখা আবেগ আর উচ্ছ্বাসে ভরা সেই চিঠি এখন ডাকযোগে আর আসে না!

পূর্ববর্তী নিবন্ধবিশ্ব দৃষ্টি দিবস আজ
পরবর্তী নিবন্ধ১৬৯ ডট বল খেলে বাংলাদেশের হার