আমাদের দেশে শিক্ষা জগতের প্রোজ্জ্বল অতীত ইতিহাসের সুদীর্ঘ এক সময়ে সবচে মেধাবী ছাত্ররা ইতিহাস বিষয়ে পঠন–পাঠনে উৎসাহী ছিল। এর পরের পছন্দের বিষয় ছিল ইংরেজি সাহিত্য। সেই সময়ের ঢাকা ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, প্রেসিডেন্সী কলেজের মেধাবী ছাত্রদের তালিকা দেখলেই তার প্রমাণ মিলবে। সেই বৃটিশ আমল থেকে ’৪৭ পরবর্তী উভয় বাংলায় উচ্চ শিক্ষার ক্ষেত্রে এ দু’বিষয়ের মেধাবী শিক্ষার্থীদের সাফল্য ছিল চোখ ধাঁধানো। প্রবাদ প্রতিম দুই ইতিহাসবিদ ও শিক্ষক অধ্যাপক সুশোভন সরকার ও হীরেন মুখার্জি দু’জনই ছিলেন সবচেয়ে বয়োজ্যেষ্ঠ প্রগতিশীল ইতিহাসবিদ। দু’জনেই ছিলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃতী শিক্ষার্থী। অমিত সরকার ছদ্ম নামে ১৯৪০ সালের দিকে বাংলা ভাষায় প্রথম ইতিাহাসের বস্তুবাদী ধারণা নিয়ে ‘ইতিহাসের ধারা’ নামে বই লিখেন অধ্যাপক সুশোভন সরকার। এ সব তথ্য এখন প্রগতিশীল চিন্তার অনেকের অজানা। তাঁদেরই ছাত্র ছিলেন প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ অমলেশ ত্রিপাঠী, অশীন দাশগুপ্ত, ইরফান হাবিব, তপন রায় চৌধুরী প্রমুখ। এঁদেরই সমসাময়িক দুই কৃতী শিক্ষার্থী ও পরবর্তীতে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগে স্বনামধন্য দুই শিক্ষক, আমাদের বোয়ালখালী উপজেলারই কৃতী সন্তান ছিলেন। এঁদের একজন কানুনগোপাড়া গ্রামের কালিকারঞ্জন কানুনগো ও অন্যজন শাকপুরা উচ্চ বিদ্যালয়ের এক সময়ের কৃতি ছাত্র বিনয় চৌধুরী। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের এই দুই প্রখ্যাত শিক্ষক ও তাঁদের কর্মময় জীবন সম্পর্কে চট্টগ্রামের খুব লোকই জানে। এই কালিকা রঞ্জন কানুনগোর ভ্রাতুষ্পুত্র ছিলেন আমাদের পরম শ্রদ্ধেয় সদ্য প্রয়াত ঐতিহাসিক প্রফেসর সুনীতি ভূষণ কানুনগো। তিনি তাঁর পিতৃব্য ইতিহাসবিদ কালিকারঞ্জন কানুনগোর উৎসাহ ও আগ্রহাতিশয্যে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৬০ সালে ইতিহাসে কৃতিত্বের সাথে এম.এ ডিগ্রি নেন। তাঁরই অনুপ্রেরণায় তিনি সেই থেকে পুরো জীবন ইতিহাসে পাঠদান, নিরন্তর গবেষণা ও লেখালেখির কাজে আত্মনিয়োগ করেন। একজন নিভৃত গবেষক, লেখক ও গ্রন্থকার হিসাবে দীর্ঘ জীবন তিনি অতিবাহিত করে শেষ জীবন নীরবে নিজ গ্রামে বাস করে কর্মময় ও সৃষ্টিশীল ইহজীবনের ইতি টানেন। শিক্ষক হিসাবে তাঁকে দূর থেকে দেখলেও কাছে পেয়েছি ‘ইংল্যান্ডের ইতিহাস’, ‘চট্টগ্রামের ইতিহাস’, ‘বাংলার মধ্যযুগের ইতিহাস’, ‘চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহের ইতিহাস’, ‘বাংলার বৈষ্ণব আন্দোলন’ সহ সমসাময়িক ইতিকথা নিয়ে তাঁর রচিত প্রচুর গ্রন্থরাজির মধ্যে যেগুলে বাংলার সারস্বত সমাজে তাঁকে চিরঞ্জীব করে রাখবে। তিনি শুধু নিভৃত জ্ঞান সাধক ছিলেন না ’৪৭ এর পরে নিজ গ্রামের তাঁর সমসাময়িক শিক্ষিত মধ্যবিত্তদের ব্যাপক দেশ ত্যাগের ফলে সৃষ্ট শূন্যতায় তিনি বলতে গেলে একাকী অবহেলিত গ্রামের সমাজ ও সংস্কৃতিকে উন্নত করার কাজে যতদূর পেরেছেন নিজেকে যুক্ত রেখেছেন। কানুনগোপাড়ার ঐতিহ্যবাহী সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংস্থা ‘বান্ধব পাঠাগার’ কে প্রকৃত অর্থে সর্ব সাধারণের উন্নত পাঠাগার হিসাবে গড়ে তুলতে সচেষ্ট ছিলেন আজীবন। এর শতবর্ষ পূর্তিতে আয়োজিত অনুষ্ঠানমালা ও এ উপলক্ষে প্রকাশিত তথ্য সমৃদ্ধ মননশীল ব্যতিক্রমী স্মারক সংখ্যাটির প্রকাশনার পেছনে তাঁর অবদান স্মরণীয় হয়ে থাকবে।
১৯৬১ সালে ইতিহাসের শিক্ষক হিসাবে তিনি তদানীন্তন চট্টগ্রামের সুবিখ্যাত উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্যার আশুতোষ কলেজে যোগ দেন। ১৯৭০ এর দশকের শুরুতে দেশের প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা শিক্ষক, পরবর্তীতে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রফেসর ড.আবদুল করিমের তত্ত্বাবধানে গবেষণা করে তিনি ইতিহাসে পি.এইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। উল্লেখ্য তিনিই ছিলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে প্রথম পিএইচডি ডিগ্রি প্রাপ্ত। তাঁর অভিজ্ঞতা, জ্ঞান, গবেষণা ও পাণ্ডিত্যে মুগ্ধ হয়ে ড. আবদুল করিম তাঁকে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসাবে নিযুক্তির সুপারিশ করেন। সেই থেকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের শিক্ষক হিসাবে তিনি তাঁর বাকী কর্মজীবন অতিবাহিত করেন, নিরন্তর ব্যাপৃত থাকেন গবেষণা ও ইতিহাসের উপর নানান গ্রন্থ রচনার কাজে। এর মধ্যে কিছুদিন তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েও শিক্ষকতা করেন।
সাম্প্রতিক সময়ে চরম সামাজিক অধোগতির মধ্যে আমাদের দেশে ইতিহাস, দর্শনের মত মানবিকী বিদ্যার চর্চা বলতে গেলে একেবারে সীমিত হয়ে পড়েছে। বিষয়গত ভাবনা, শিক্ষা বাণিজ্য, শিক্ষার প্রতি সাধারণের দৃষ্টিভঙ্গি, শিক্ষার্থী নির্বিশেষে যুক্তি ও জিজ্ঞাসার প্রতি অনাগ্রহ এ সবের জন্য দায়ী। এমনকি এখন বিজ্ঞান চর্চার ক্ষেত্রে বিজ্ঞান বিরোধী বিশ্বাস ও মনন সঠিক বিজ্ঞান চর্চাকে নিরন্তর নিরুৎসাহিত ও বিপথগামী করছে। গোষ্ঠী বিশেষের ইচ্ছা ও বিশ্বাস চাপিয়ে দেয়ার নিরন্তর অপচেষ্টা সমাজ ও শিক্ষার্থীদের ক্রমে পিছিয়ে দিচ্ছে। জিজ্ঞাসা, বিবর্তন ও পরিবর্তনের অনিবার্যতা বোধ ও মননের উদারতা যে প্রকৃত শিক্ষা, রাষ্ট্রনৈতিক ক্ষমতার সমীকরণে ক্রমে তা দুঃস্বপ্নে পরিণত হচ্ছে। ১৯৭০ এর দশকের প্রথমার্ধ পর্যন্ত মাধ্যমিক শিক্ষাক্রমে ইতিহাস, ভূগোল ও পৌরনীতি মিলিয়ে সমাজ বিদ্যা বা সোশ্যাল স্টাডিজ নামে একটি বাধ্যতামূলক বিষয় ছিল। দেখেছি শিক্ষকরা পৃথিবীর অক্ষাংশ ও দ্রাঘিমাংশ বুঝিয়ে নিজ দেশ ও মহাদেশগুলোর প্রকৃত অবস্থান, মহাসাগরগুলোর ব্যাপ্তি শিক্ষার্থীদের বুঝাবার জন্য শ্রেণিকক্ষে বড় বড় মাটির গ্লোব নিয়ে আসতেন। কিন্তু এখন প্রাযুক্তিক অগ্রগতি, ইন্টারনেট তা আরো সহজ ও প্রত্যক্ষ করেছে বটে, কিন্তু সমাজ, শিক্ষা ও মননের ক্রম পশ্চাদপদতা সেই প্রযুক্তিকে দুর্বলের কাছে দুঃস্বপ্নে পরিণত করেছে। ফেসবুক নামক সমাজ মাধ্যম এখন সুস্থ ও স্বাভাবিক মানুষের কাছে এক আতংকের নাম। এ সবের মূল কারণ পশ্চাদপদ চিন্তা, কুশিক্ষা ও অসহিষ্ণুতা, ইতিহাস ও বিজ্ঞান চর্চার অভাব। জীবন ও জগতের নৈর্ব্যক্তিক ও সমাজ নিরপেক্ষ বিকাশ সম্পর্কে অসচেতন বোধ। ‘ফল অব রোমান এম্পায়ার বা মুঘল এম্পায়ার’ এর কারণ, কাল ও দূরত্বের কারণে বিচ্ছিন্ন ঘটনা মনে হলেও তা যে সুনির্দিষ্ট কিছু মানবিক ও রাষ্ট্র নৈতিক কার্যকারণের পরিনতি তা ইতিহাসের প্রত্যেকটি ছাত্রের কাছে বোধগম্য করতে পারার মধ্যেই প্রকৃত ইতিহাস শিক্ষকের সাফল্য নিহিত। সূনীতি ভূষণ কানুনগো বা তাঁর উত্তরসূরীরা এ শিক্ষা প্রদানে যত্নবান ছিলেন। ‘ইতিহাসের বিজ্ঞান’ বা ‘বিজ্ঞানের ইতিহাস’ জানা ও পড়া এ জন্য প্রত্যেক শিক্ষার্থীর কাছে এক অবশ্য অধীত বিষয় হওয়া জরুরি। ইতিহাস তো শুধু অতীতের ঘটনার জানান দেয়ার বাপার নয়, নয় কোন রাজার রাজত্বের বর্ণনা। History is the unending dialogue between past and present. অতীতের সাথে বর্তমানের নিরন্তর সংযোগ, ভাব বিনিময় হল ইতিহাসের মর্মবস্তু। সুনীতিবাবু তাঁর গ্রন্থে বিশ্বস্তভাবে ইতিহাসের মূল উপাদান তথা তথ্যের নিমোর্হ উপস্থিতি নিশ্চিত করতে চেয়েছেন যথাসম্ভব, কেননা কালের গতির কারণে ইতিহাসের উপর পরিপূর্ণ, নিখুঁত সব তথ্য তথ্য ঐতিহাসিকের পক্ষে প্রদান সম্ভব নয়।
আমাদের দেশে ইতিহাস চর্চার বড় সংকট হলো সংকীর্ণ গোষ্ঠী, সাম্প্রদায়িক ও রাজনৈতিক চিন্তা থেকে ঐতিহ্যকে ক্রমাগত অস্বীকার করা। শুধু তাই নয় ইতিহাস চর্চাকে নিজেদের সুবিধামত সময়ের গণ্ডীতে নির্দিষ্ট করে খণ্ডিত বিচারের অবকাশ তৈরি করে দেয়া। এ ভূখণ্ডের কমপক্ষে দু হাজার বছরের ইতিহাসকে সোয়াশ থেকে দু’শ বছরের পটভূমিতে এমনকি অতি সম্প্রতি তা ’৪৭ পূর্বাপর সময়কে প্রাধান্য দিয়ে বিচারের প্রবণতা দেখা যায় যা সংকীর্ণ রাজনৈতিক স্বার্থ সিদ্ধিরই চুড়ান্ত বিচারে এক অক্ষম প্রয়াস।
সুনীতি বাবু সুলতানী আমলের পৃষ্ঠপোষকতায় বাংলার বৈষ্ণব আন্দোলনের বা চৈতন্যের আধ্যাত্মিক ভাবান্দোলনের বসু্তনিষ্ঠ মূল্যয়ন করেছেন একজন ঐতিহাসিকের দৃষ্টিভঙ্গী থেকে, ইতিহাসের সত্যাসত্য বিচার করে। ইতিহাসের অমোঘ গতি প্রবাহকে মেনে নিয়ে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় পরিবর্তনকে পাঠকের কাছে তুলে ধরার মধ্য দিয়ে একজন ইতিহাস গবেষক, সত্যদ্রষ্টা ঐতিহাসিক সমাজের প্রগতিশীল রূপান্তরে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারেন, বন্ধ করতে পারেন সময়ের রক্তক্ষরণ।
প্রফেসর ড. সুনীতি ভূষণ কানুনগো তাঁর দীর্ঘ ৯১ বছর জীবনে এ ভূখণ্ডের এক সংঘাত–দীর্ণ সময়ের, বলতে গেলে শতাব্দীর সাক্ষী ছিলেন। এ দেশে বারংবার সংঘটিত সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় বিপর্যয়ের ভুক্তভোগী একজন ইতিহাস গবেষক ও লেখক ছিলেন। অভিজ্ঞতা থেকেই তিনি ছিলেন সর্বদেশ দর্শী, সত্যসন্ধ ও নিরপেক্ষ। তাঁর বর্ণিত ইতিহাসের আঙ্গিক ছিল সহজসরল, অনাড়ম্বর অথচ সত্যের জ্যোতিতে প্রদীপ্ত। সেদিক থেকে তাঁর মৃত্যুতে দেশ হারাল একজন শ্রেষ্ঠ ঐতিহাসিক, নিবেদিতপ্রাণ গবেষক ও আদর্শ শিক্ষক। তাঁর স্মৃতির প্রতি জানাই প্রণতি।
লেখক : অবসরপ্রাপ্ত কলেজ শিক্ষক, প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট।