বন্ধুর বাসায় বেড়াতে গিয়ে গলির ভেতর পরিচিত মুখ রমজান আলী ভিক্ষুককে দেখে আমি হতবাক হলাম। যে প্রতিদিন হাতে পায়ে বেন্ডিস ও এক হাতে ওয়াকিং স্টিক নিয়ে পা বাঁকা করে ‘আমি রমজান আলী শারীরিক ভাবে অসুস্থ আমাকে যে–যা পারেন সাহায্য করেন’ বলে চিৎকার দিয়ে বাসাবাড়ি, অফিস আদালত, দোকানপাট ও রাস্তাঘাটে ভিক্ষা খুঁজে, অথচ আজ তাকে গলির ভেতর কাছে থেকে দেখে অবাক হলাম। যাকে আমরা প্রতিনিয়ত ভিক্ষা মানে টাকা–পয়সা দিয়ে সাহায্য করি, এ রমজান আলী শারীরিকভাবে সক্ষম দৃষ্টিশক্তি থাকা এবং পুরোদমে হাঁটাচলা করতে পারে এক ব্যক্তি, কেবল নামেই একজন ভিক্ষুক। সে আমাকে দেখে বিচলিত হয়ে বললো স্যার আমিতো আপনাকে চিনি। উত্তরে বললাম আমিও তোমাকে চিনি। ভিক্ষুক রমজান আলী কিনা তার সঠিকতা আবারও যাচাই করতে তার নাম ও বাড়ি কোথায় জিজ্ঞেস করলাম। একটু মুখ কালো করে বললো ‘আমার নাম রমজান আলী, বাড়ি কুমিল্লা।’ তুমিতো শারীরিকভাবে সুদর্শন সুস্থ–সবল উপার্জন সক্ষম মানুষ, তবে কেন বাড়িতে বাড়িতে রাস্তাঘাটে, দোকান পাটে এভাবে ছল–চাতুরী করে ভিক্ষাবৃত্তি করছো? উত্তরে বললো ‘না স্যার, এখন আমাকে একটু ভালো দেখছেন, আমার হাতে ও পায়ে অনেক সমস্যা আমি প্রায় অসুস্থ থাকি।’ মিথ্যা কথা তুমিতো মোটেই অসুস্থ নও, আমার চেয়েও সুস্থ। আমার নানান প্রশ্নের জালে জড়িয়ে বিচলিত হয়ে শেষমেশ স্বীকার করলো, স্যার কী করবো এটাইতো সহজ পথ। চার ছেলে–মেয়েসহ ছয় জনের সংসার চালাতে এর কোনও বিকল্প নেই। কোনও চিন্তাহীন, ভাবনাহীন, পুঁজিবিহীন এই ভিক্ষাবৃত্তির মাধ্যমে সহজে টাকা পাওয়া যায়। সহজ উপায়ে টাকা রোজগার করতে হলে একটুতো ছল–চাতুরী করতেই হয়। পরে একটু হেসে আমাকে জিজ্ঞেস করলো, স্যার কিছু মনে করবেন না, একটু চা খান। উত্তরে না বলে ফিরবার আগে রমজানকে বললাম শুন একাজ তোমার জন্য মঙ্গলদায়ক নয়। কারণ তুমি সত্যিই উপার্জন সক্ষমকারীদের মধ্যে একজন, ভিক্ষাবৃত্তি না করে ছোটখাটো ব্যবসা, হোটেল রেস্তোরাঁয় চাকরি, রিকসা, ভেন চলানো, গাড়ির হেলপার, নির্মাণ শ্রমিক বা দৈনিক ভিত্তিতে কাজ করে উপার্জন করতে পার। একটু মুচকি হাসি দিয়ে বললো, না স্যার এ কাজেই ভালো আছি। আবার কোনও লজ্জা সরম ত্যাগ করে বললো, স্যার অন্যান্য পেশার চেয়ে এ পেশাতে উপার্জন অনেক বেশি। ফিরে আসতেই আমাকে ফলো করা অপরিচিত এক ভদ্রলোক আমাকে উদ্দেশ্যে করে বললো এতক্ষণ যার সাথ কথা বলেছেন সে শুধু ভিক্ষুক নয় ভিক্ষুকদের লিডারও। এর নিয়ন্ত্রণে চলে অনেক ভিক্ষুক।
আমাদের সমাজে এই রমজান আলীর মতো হাজারো রমজান আলী আছে যাঁরা ভিক্ষাবৃত্তির আড়ালে নানান অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডেও জড়িত থাকে যেমন, ছিনতাই, চুরি, অপহরণ, মদক বহন, ইয়াবা পাচার ও ব্যবসাসহ নানা প্রকার কর্মকাণ্ড। পাশাপাশি তাদের ভাবসাব, পোশাক–আসাক, ছল–চাতুরী ও নিরীহ রূপ ধারণ করে প্রকৃত ভিক্ষুক সেজে এসমস্ত অপরাধমূলক কাজে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকেও ফাঁকি দিয়ে ভয়ংকর অপরাধজনক কাজে সফলতাও লাভ করে।
অথচ সামাজিকভাবে ভিক্ষা একটি নিকৃষ্ট পেশা, যা সামাজিক সমস্যা ও অপরাধ হিসাবে গণ্য হয়ে থাকে। ধর্মীয় ভাবেও ভিক্ষাবৃত্তিকে একেবারে নিকৃষ্ট কাজ ও সবধরনের ভিক্ষাবৃত্তি কঠোরভাবে নিষেধ থাকলেও কেবল একান্ত অপারগ অবস্থায় ভিক্ষার অবকাশ দেয়া হলেও তা পেশা হিসাবে গ্রহণ করা যাবে না বলে উল্লেখ আছে। তবে যারা শারীরিক অক্ষমতার কারণে আয়–রোজগার করার মতো অবস্থা নেই, অথবা একজন লোকের একদিনের চলার মতো খাদ্য সংরক্ষিত নেই কেবল তাদের বেলায় ভিক্ষাবৃত্তি কিছুটা গ্রহণ যোগ্যতা আছে অথচ কর্মক্ষম পেশাদার ভিক্ষুক এর উৎপাতে সাধারণ মানুষ অতিষ্ঠ। বিশেষ করে শহরের কর্মব্যস্ততা ও চলাচলের পথে, ট্রেনের বগিতে, বিভিন্ন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ও মাজারের জনসমাগমপূর্ণ স্থানে, দোকানপাটে, যানজটে ব্যক্তিগত গাড়িতে মানুষের কর্ম ও সময়ের গুরুত্ব না বুঝে নানান প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে ভিক্ষার জন্য দাঁড়িয়ে থাকে। এসংখ্যা ক্রমাগত বাড়তেই থাকবে।
অন্যদিকে তাদের দাপটে প্রকৃত ভিক্ষুক যেমন অন্ধ, কর্মক্ষম, হাঁটাচলা করতে পারে না, নিরীহ কিংবা প্রতিবন্ধী এক কথায় অসহায় মহিলা–পুরুষ ও শিশু কিশোররা ভিক্ষাবৃত্তিতে তেমন সুযোগ সুবিধাও করতে পারে না। কেন না অনেক এলাকায় রয়েছে তাদের শক্তিশালী সিন্ডিকেট। তারা নিয়ন্ত্রণ করে বিশেষ বিশেষ এলাকা। এরা টাকার বিনিময়ে দরিদ্র শিশু কিশোরদের ছেড়া কাপড়চোপড় পরিয়ে বা নানান কায়দায় রাস্তঘাটে সাধারণ মানুষের হাতে পায়ে তাদের গায়ের ময়লা কাপড়ে জড়িয়ে ধরে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলে টাকা আদায়ে বাধ্য করে। এই সিন্ডিকেট অনেক কোমলমতি শিশুদের আগামী ভবিষ্যতের কথা না ভেবে হাতপাতিয়ে ভিক্ষাবৃত্তি ও নানা অপকর্মেও ব্যবহার করে টাকার বিনিময়ে। তারা নবজাতক থেকে শুরু করে চলন শক্তিহীন বৃদ্ধদেরও ব্যবহার করে শুধু বেঁচে থাকা বা পেটের দায়ে নয়। এই সমস্ত ভিক্ষুক ও সিন্ডিকেট অনেক জায়গায় বাড়ি গাড়ি জায়গাজমি কেনার অবাক করা খবরও সম্প্রতি বিভিন্ন মিডিয়া ও পত্র পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। এমন কি তারা অবুঝ শিশু ও শারীরিক প্রতিবন্ধীদের কাজে লাগিয়ে হাতিয়ে নিচ্ছে লাখ লাখ টাকা। সুতরাং ধন সম্পদ বৃদ্ধির জন্য যারা ভিক্ষাবৃত্তি করে তাদের নিয়ন্ত্রণ বা আইনের আওতায় আনা এখন সময়েয় দাবি। ২০১১ সালের প্রণীত ‘ভবঘুরে নিয়ন্ত্রণ আইন’ কার্যকর করে কর্মক্ষম ব্যক্তিদের ভিক্ষাবৃত্তি বন্ধ করা জরুরি। না হয় পেশাদার কর্মক্ষম ভিক্ষুকের সংখ্যা দিন দিন বাড়তেই থাকবে।
লেখক : প্রাবন্ধিক, শিশুসংগঠক