সুষ্ঠু গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় সুশীল সমাজের ভূমিকা

স.ম.জাফর উল্লাহ | বুধবার , ২ অক্টোবর, ২০২৪ at ৪:৫৩ পূর্বাহ্ণ

রাষ্ট্র পরিচালনা করে সরকার। সরকারের অগণতান্ত্রিক কর্মকাণ্ড সম্পর্কে সতর্ক ও সচেতন করার অলিখিত খবরদারির ক্ষমতার অধিকারি হচ্ছে সুশীল সমাজ। যে রাষ্ট্রের সুশীল সমাজ যত বেশি সংগঠিত ও শক্তিশালী সে রাষ্ট্রের গণতন্ত্র অধিক দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত। রাজনৈতিকভাবে সচেতন, ভদ্র, সুশিক্ষিত, প্রশিক্ষিত, আলোকিত, কথায় কাজে অবিচল, গণতান্ত্রিক মনমানসিকতা সম্পন্ন, আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল, সন্ত্রাস ও দুর্নীতিমুক্ত সমাজ বিনির্মাণে বদ্ধপরিকর, সহনশীলতা, মতামত প্রকাশে অবাধ স্বাধীনতায় বিশ্বাসী, সুষম অর্থনৈতিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় দৃঢ় প্রতিজ্ঞ, শিক্ষক, আইনজীবী, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, কবি, শিল্পী, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, শিক্ষাবিদ, ছাত্র যারা সক্রিয়ভাবে রাজনীতিতে জড়িত নয় এমন ব্যক্তি ও সমষ্টিকে সুশীল সমাজ বলা হয়। তাদের কাজ এবং অবস্থান রাষ্ট্র ও সমাজের বিপরীতমুখী নয় বরং সম্পূরক ও সহায়ক। ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত সরকারের অন্যায়, অবিচার, ঘুষ, দুর্নীতি, জনস্বার্থ পরিপন্থী কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে এ শ্রেণিই সবচেয়ে বেশি সোচ্চার এবং এ শ্রেণিকেই আন্দোলন সংগ্রামের মূল চালিকাশক্তি হিসাবে বিবেচনা করা হয়। অধিকার, আইনের শাসন, স্বাধীনতা ও নাগরিকত্ব যথার্থরূপে অর্জিত ও প্রতিষ্ঠিত হলেই সুশীল সমাজ রাষ্ট্রকে চ্যালেঞ্জ করার সামর্থ প্রদর্শন করতে পারে। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রতত্ত্বে সুশীল সমাজ অত্যন্ত সুবিধাজনক স্থান অধিকার করে আছে। গণতন্ত্রের অস্তিত্বের অপরিহার্য পূর্বশর্ত হচ্ছে সুশীল সমাজ। যার কারণে কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্র সুশীল সমাজকে সমীহ করে চলে, তাদের ভয় পায় এবং তাদের দুর্বল করার সতত অপপ্রয়াস চালায়। রাষ্ট্রের জবাবদিহিতা স্বয়ং সুশীল সমাজের আত্মসচেতনতা, আন্দোলন এবং রাজনৈতিক প্রজ্ঞার উপর নির্ভরশীল। রাজনৈতিকভাবে শক্তিশালী সক্রিয় ও আত্মসচেতন সুশীল সমাজই রাষ্ট্রশক্তিকে নিয়ন্ত্রণ রাখার সক্ষমতা প্রদর্শন করতে পারে। রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থা যেখানে জনগণের ভোটাধিকার হরণ করে কিংবা বহুল পরিমাণে খর্ব করে মানুষকে অরাজনৈতিক করে তুলতে উদ্ধত হয় সেখানে শক্তিশালী সুশীল সমাজ প্রতিষ্ঠা অপরিহার্য। রাষ্ট্রের সাথে সুশীল সমাজের গভীর সম্পর্ক রয়েছে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার সীমানা ও নিয়ন্ত্রণ রেখাকে নির্দিষ্ট করতে গিয়েই গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় সুশীল সমাজের বিকাশ ঘটে। উন্নয়নশীল দেশের আর্থ সামাজিক সমস্যা ও টানাপোড়েনের মধ্যে গণতন্ত্র প্রতিনিয়ত ঝুঁকির সম্মুখীন এর থেকে উত্তরণের জন্য সুশীল সমাজের প্রয়োজন। ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য ক্ষমতাসীন দল বিভিন্ন সময় সুশীল সমাজের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়। গণতন্ত্র জনগণের অধিকার ও জনমতের প্রতিফলন সংক্রান্ত বিষয়ে সুশীল সমাজ সরকারের উপর চাপ প্রয়োগ ও আন্দোলন সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়। সুশীল সমাজ তাদের মেধা গুণাবলির বিকাশ ও প্রত্যাশা, আকাঙ্ক্ষা পূরণের জন্য একত্রিত হয় ফলত রাষ্ট্রের আধিপত্য, বলপ্রয়োগ ও নিয়ন্ত্রণের মুখোমুখি হলে রাষ্ট্রযন্ত্র ও তার আচরণ, শাসন ব্যবস্থা ও প্রয়োগ চিন্তাধারা সম্প্রসারিত করতে থাকে। সরকারের কোনো কাজ জনস্বার্থ বিরোধী হলে সুশীল সমাজ তার বিরুদ্ধে আন্দোলন সহ বিভিন্ন কর্মসূচি প্রণয়ন করে। রাজনৈতিক দলগুলোকে শক্তিশালী করে গড়ে তোলা গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানসমূহকে স্থায়ী দৃঢ় ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠা করা, রাজনীতিতে দুর্বৃত্তায়ন, সন্ত্রাস কালো টাকার দৌরাত্ম্য রোধ ইত্যাদি বিষয়ে সুশীল সমাজের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যায় ক্ষমতাসীন দল বা সরকার ক্রমশ জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, দলীয়করণ, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি টেন্ডারবাজি ইত্যাদিতে ক্ষমতাসীন দল ও তার অঙ্গ সংগঠনের নেতা কর্মীরা নানা অপকর্মে জড়িয়ে পড়ে পাশাপাশি বিরোধী দলকে দমনপীড়ন মামলা মোকদ্দমায় চাপে রাখে। এমন পরিস্থিতিতে একমাত্র সুশীল সমাজই সরকারের বিরুদ্ধে চাপ প্রয়োগ করে তাদের অপকর্মের নানা চিত্র জনগণের সামনে তুলে ধরার প্রয়াস চালায়। সরকারের কৃতকর্মের বিরুদ্ধে রাজপথে যৌক্তিক নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন ও বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করে। যার ফলে ক্ষমতাসীনদের ভিত দুর্বল হয়ে পড়ে এবং পরবর্তীতে ক্ষমতায় আসীন হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ হয়ে উঠে। উন্নয়নশীল সমাজের গণতন্ত্র হল অনুদার গণতন্ত্র, যেখানে যথারীতি নির্বাচন হয় সংসদ থাকে, বিচার বিভাগ থাকে, নির্বাচিত প্রতিনিধিরা ক্ষমতায় আসে ও যায় কিন্তু আইনের শাসন, সুশাসন, নাগরিক অধিকার, উদার গণতন্ত্র ও মানবাধিকার ইত্যাদির প্রতি তাদের কর্ণপাত থাকে না। ফলে দেখা দেয় দমন, পীড়ন ক্ষমতার অপব্যবহার যাতে সংঘাত সৃষ্টির মাধ্যমে সামাজিক রাজনৈতিক অর্থনৈতিক স্থিতি ও শান্তি লোপ পেতে থাকে। এই প্রেক্ষিতে সুশীল সমাজ গণতান্ত্রিক কাঠামোর রীতিনীতি এবং বৈশিষ্ট্য সমূহ শক্তিশালী করতে চায়। ক্ষমতাসীনরা যাতে তথ্য বিনিময় স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও নাগরিকদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার উদ্যোগ নেয় সুশীল সমাজ এ ব্যাপারে সব সময় সচেষ্ট থাকে। পৃথিবীর প্রত্যেক রাষ্ট্রে সুশীল সমাজ তথা জাতির বিবেক বলে একটি শ্রেণি বিদ্যমান বাংলাদেশও এর থেকে ব্যতিক্রম নয় আমাদেরও একটি সুশীল সমাজ রয়েছে। এ দেশে সুষ্ঠু গণতন্ত্র চর্চা বারবার নির্দিষ্ট লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত হয়ে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় ব্যর্থ হচ্ছে। স্বাধীনতার পর যত সরকার এসেছে সঠিক গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় একটি ও শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়নি যার কারণে এদেশে রাজনৈতিক দলগুলো ভিন্ন পথে বা অগণতান্ত্রিক পন্থায় গণতন্ত্রের রূপ দিতে সচেষ্ট থাকে। বিশ্বে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সরকার বলিষ্ঠ ও সক্রিয় সুশীল সমাজের রাষ্ট্র ক্ষমতার উপর প্রভাব বিস্তারে এক প্রকার তটস্থ থাকে এতে প্রতীয়মান হয় যে সে সব রাষ্ট্রে সুশীল সমাজ সরকারের উপর নিয়ন্ত্রণ করে আর আমাদের দেশে সুশীল সমাজের ভূমিকা দেখে মনে হয় এ দেশে সরকার সুশীল সমাজকে নিয়ন্ত্রণ করে। যেহেতু এ দেশে সঠিক গণতান্ত্রিক পন্থায় কোনো সরকার শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়নি বা হয়ে থাকলেও সরকারের ক্ষমতার অপব্যবহার দুর্নীতি দেশ ও জাতির স্বার্থ পরিপন্থী কর্মকাণ্ড, বিরোধী দলের উপর দমনপীড়ন, মত প্রকাশে হস্তক্ষেপ, দলীয়করণ, সুষ্ঠু অবাধ শান্তিপূর্ণ নির্বাচনকে প্রভাবিত করে প্রহসনের মাধ্যমে ভোট কারচুপি ইত্যাদি নীরবে সহ্য করে মেনে নেয়া বা সমর্থন করা সুশীল সমাজের বৈশিষ্ট্যের পরিপন্থী। কোন দলের বা সরকারের লেজুড়বৃত্তি হয়ে স্বীয় স্বার্থে ক্ষমতার স্বাদ ও সরকারের নানা সুযোগ সুবিধা ভোগ করতে বেশি তৎপর দেখা যায় দেশের সুশীল সমাজকে। সরকারের রঙে রঙিন হয়ে সরকারের অনৈতিক কাজে বাহবা দিয়ে প্রশংসা কুড়াতে নীতি আর্দশ বিসর্জন দিতে দ্বিধা করে না। প্রত্যেক সরকারের সময়ে ক্ষমতাসীন দল যখন নির্বিঘ্নে স্বৈরাচার, কুশাসন, দারিদ্র্য, বৈষম্য, কালো টাকার প্রভাবে সামাজিক নিপীড়ন, সন্ত্রাস, ভিন্নমত দলন, পরিবেশ বিপন্নকরণ প্রভৃতি কর্মকাণ্ডে সরকার স্বেচ্ছাচারিতার আশ্রয় নেয় এর বিরুদ্ধে জনসমাজের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টির কোনো ভূমিকা সুশীল সমাজের ছিল না। আওয়ামী সরকারের ১৫ বছরের দুঃশাসনে দেশের মুষ্টিমেয় দুএক জন ছাড়া আর কেউ তাদের বিরুদ্ধে কথা বলতে দেখা যায়নি। তৎমধ্যে ড. মইনুল ইসলামকেই একমাত্র সরকারের নানা অপকর্মের ও জাতির স্বার্থ পরিপন্থী গৃহীত প্রকল্পের নেতিবাচক বিষয়ে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিতে সাহসী ভূমিকা রাখতে দেখা গেছে। দেশ ও জাতির বৃহত্তর স্বার্থে সুশীল সমাজ পক্ষপাতিত্ব এড়িয়ে রাজনৈতিক দলগুলোকে সঠিক গণতন্ত্র চর্চার বিকাশ ও পরিবেশ সৃষ্টিতে অবদান রাখবে এটাই জাতির প্রত্যাশা।

লেখক : প্রাবন্ধিক

পূর্ববর্তী নিবন্ধদূরের টানে বাহির পানে
পরবর্তী নিবন্ধতিন দশক পেরিয়ে আমিন খান