সোলস বাংলাদেশের সঙ্গীত জগতে ভিন্নধারার ব্যান্ড। যারা লিরিকধর্মী গানকে প্রাধান্য দিয়ে থাকে। ১৯৭৩ সালে ‘সুরেলা’ ব্যান্ড নামে যার যাত্রা বন্দর নগরী চট্টগ্রাম থেকে। পরে হয় সোলস। ‘মাস্টারকার্ড প্রেজেন্টস সোলস আনপ্লাগড : ৫০ ইয়ার্স অব টাইমলেস মিউজিক’ শিরোনামে অনবদ্য কনসার্টের আয়োজন করে এম অ্যান্ড এম বিজনেস কমিউনিকেশনস।
গত ২ মে নগরীর পাঁচ তারকা হোটেল র্যাডিসন ব্লু চট্টগ্রাম বে ভিউতে কনসার্টে ছিলেন সোলসের প্রতিষ্ঠাকালীন সদস্যরা, ছিলেন বিভিন্ন সময়ের কাণ্ডারিরা। মাস্টারকার্ড বাংলাদেশের কান্ট্রি ম্যানেজার সৈয়দ মোহাম্মদ কামাল অনুষ্ঠানের শুরুতে তাঁর বক্তব্যে বলেন, বাংলাদেশের সংগীত ইতিহাসে সোলস–এর ভূমিকা অবিস্মরণীয়। এই অনুষ্ঠানকে স্পন্সর করতে পেরে আমরা গর্বিত।
আয়োজক এম অ্যান্ড এম বিজনেস কমিউনিকেশনসের সিইও মানজুমা মুরশেদ বলেন, সোলস আনপ্লাগড শুধু একটি অনুষ্ঠান নয়, এটি ছিল ভালোবাসা, স্মৃতি আর গর্বের এক অপূর্ব মিলন।
ঘড়িতে রাত ৮টা ছুঁইছুঁই। সোলসের পার্থ বড়ুয়ার দরাজ কণ্ঠ। না তিনি গান নয়, ছোট্ট একটা ডকুমেন্টারিতে সোলসের ৫২ বছেরের স্বপ্নযাত্রার কথা বলছিলেন। পার্থের ধারা বর্ণনার সময় পর্দায় ভেসে উঠছিল ব্যান্ডের নানা সময়ের সাথীদের প্রিয় মুখগুলো। সাজেদ উল আলম, নকীব খান, তপন চৌধুরী, লুলু, শাহবাজ খান পিলু, শাহেদ উল আলম, সুব্রত বড়ুয়া রনি, আহমেদ নেওয়াজ, আইয়ুব বাচ্চু। তাদের কেউ কেউ এখন পৃথিবীতে নেই। সবার অবদান কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করা হলো।
আর কথা নয়। এবার গানের পালা। প্রথমে পার্থ বড়ুয়া পরিবেশন করেন, ‘বন্ধ হয়ে গেছে সব ক্যাফে আর রেস্টুরেন্ট/ বৃষ্টি ভেজা রাস্তা, ফাঁকা হয়ে গেছে বাসস্ট্যান্ড।’ এটি সোলসের নতুন গান। ‘নিয়নের লাইটগুলো ঝিমিয়ে পড়েছে যেন, আলো দেয় ঘুম ঘুম চোখে/ কৈশোর চলে গেছে অভিমানে বহুদূরে আমাকে মাঝপথে রেখে’ –গানের কথাগুলো মিলে যায় সোলসের সঙ্গে। ‘আইয়োনা আইয়োনা আঁরার দেশত আইয়োনা আইয়োনা’ গানপ্রেমীদের আহ্বান জানালেন তার প্রাণের শহর চট্টগ্রামে। সুরে সুরে চট্টগ্রামের প্রশস্তি বর্ণনা করলেন, ‘পাহাড় আছে সাইগর আছে, মনের মইধ্যে রঙ/ উঁচা নিচা পথ আছে, আছে মারফতী গান/ অফুরান ভালোবাসা আছে তোয়ারাল্লাই’।
একটানা গান গেয়ে যাচ্ছিলেন পার্থ। ‘দেখা হবে বন্ধু কারণে অকারণে’ গানটির গীতিকার নুরের গল্প বললেন তিনি। ‘১০/১২ বছর আগের কথা। গানটি যেদিন রিলিজ হলো সেদিন আমি আমার বাসার নিচে দাঁড়িয়ে ছিলাম। বৃষ্টি হচ্ছিল। হঠাৎ দেখলাম নুর খালি পায়ে বৃষ্টি মাথায় হেঁটে যাচ্ছে। তাকে বললাম, নুর আজ তো তোমার লেখা আমার গাওয়া গানটি রিলিজ হয়েছে, তুমি কি শুনেছ? সে আমার দিকে কেমন করে যেন তাকাল, আর বলল–হ্যাঁ, গানটি আমি শুনেছি, তবে ভাল হয়নি। পার্থদা, তোমাকে আমি আর কোনো গান দেব না। এরপর তার সঙ্গে আমার আর কখনো দেখা হয়নি। ছেলেটার আসলে কিছুটা মানসিক সমস্যা ছিল। কিন্তু তার লেখা গানটি আমার ভীষণ প্রিয়।’
পার্থ শুধু নিজের নয়, শ্রোতাদের ভীষণ জনপ্রিয় গানগুলো করতে থাকলেন। ‘মন শুধু মন ছুঁয়েছে’ গানটি তো শিল্পী নকীব খানের কণ্ঠে দারুণ জনপ্রিয়। পার্থ বললেন, আমি নকীব ভাইয়ের সামনে তার গানটি করতে চাই, আশা করি বেয়াদবি নেবেন না। পর্দায় নকীব খানের হাসিমুখ ভেসে উঠতেই পার্থ গানটা ধরলেন, তখন মিলনায়তন মুখর করতালিতে। এরপর তপন চৌধুরীর কণ্ঠে বিখ্যাত ‘এ এমন পরিচয়, অনুমতি প্রার্থনা’ গেয়ে অন্যরকম আবেশ ছড়িয়ে দিলেন পার্থ। তিনি একা গাননি। মিলনায়তনজুড়ে সকল শ্রোতা পার্থের সাথে গলা মিলিয়ে গান করছিলেন।
এবার মঞ্চে এলেন নকীব খান। সোলসের শুরুর দিকের গল্প করলেন। গাইলেন, ‘নদী এসে পথ’। সেই গানটি সোলসের প্রথম অ্যালবামে ঝড় তুলেছিল। নকীব খান সেটি গাইলেন, উপরি হিসাবে শ্রোতারা তার কাছ থেকে পেলেন আরও একটি গান, ‘তোরে পুতুলের মতো করে সাজিয়ে’।
সুবীর সেনের ‘সারাদিন তোমায় ভেবে হলো না কোন কাজ’ গানটি কাভার করেছিল সোলস। সেটা দিয়ে আবার শুরু করলেন পার্থ বড়ুয়া। ‘চল না ঘুরে আসি অজানাতে’ গানে তো মিলনায়তনজুড়ে আনন্দের ঢেউ। গানে গানে সবাই ঘুরে আসছে সোলসের ৫০ বছরের ইতিহাসের বাঁকে। ‘বাঁশী শুনে আর কাজ নেই’ গেয়ে দর্শকদের উন্মাতাল করলেন পার্থ।
এরপর গাইলেন সোলসের দীর্ঘদিনের ভোকাল নাসিম আলী খান। তিনি গাইলেন ‘সাগরের ঐ প্রান্তরের’। পার্থ বড়ুয়া অরো গাইলেন ‘আবার এলো যে সন্ধ্যা’, ‘ডাকাতিয়া বাঁশী’, ‘হাজার বর্ষারাত’। আর শেষ করলেন ‘কেন এই নিঃসঙ্গতা’ গানটি দিয়ে। বললেন আবার দেখা হবে, ভালো থেক চট্টগ্রাম।’
সবশেষে মঞ্চে সোলসের নতুন পুরোনোদের মিলনমেলা। একে একে অনুভূতি জানালেন। ১৯৭৩ সালে মাত্র দুজন সদস্য নিয়ে সোলস প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, তাদের একজন লুলু। তিনি কথা বলতে গিয়ে আপ্লুত হলেন, বললেন-‘আমি নিশ্চিত সোলস শতায়ু হবে, কারণ সোলসে আইয়ুব বাচ্চুর মত লিডার ছিল, পার্থ বড়ুয়ার মতো কাণ্ডারী এখনো শক্ত করে হাল ধরে আছে। ভবিষ্যতে কেউ না কেউ আসবেই।’ সোলসের অনেক গানের গীতিকার শহীদ মাহমুদ জঙ্গী, মোহাম্মদ আলীও মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন। পিলু খান ফিরে গেলেন অতীতে। আহমেদ নেওয়াজ স্মরণ করলেন সতীর্থ প্রয়াত সুব্রত বড়ুয়া রনি, শাহেদ উল আলম, আইয়ুব বাচ্চুকে।
এবার যাবার পালা। নকীব খান, পিলু খান, পার্থ বড়ুয়া, নাসিম আলী খান–নতুন পুরোনো সবাই কণ্ঠ মিলিয়ে গাইলেন আলোড়ন সৃষ্টি করা সেই গানটি -‘এই মুখরিত জীবনের চলার বাঁকে’। অবশেষে সাঙ্গ হলো সুরেলা রাত। ঘড়ির কাঁটা ১২টার ঘরে, সুরের ভেলায় ভাসছিল, সেদিকটায় কারো খেয়াল নেই। তারপরও শেষ করতে হলো। এমন উপভোগ্য সুরের রাত উপহার দেয়ার জন্য এম অ্যান্ড এম বিজনেস কমিউনিকেশনস ধন্যবাদ জানালেন শ্রোতা–দর্শকরা।