সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, স্বাধীনতার মহান স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক বজ্রকন্ঠের অলিখিত অনবদ্য ভাষণটি ইউনেস্কো (টঘঊঝঈঙ) কর্তৃক বিশ্বপ্রামাণ্য ঐতিহ্যের (ডড়ৎষফ’ং উড়পঁসবহঃধৎু ঐবৎরঃধমব) অংশ হিসেবে ঘোষণা করে এবং এর ঐতিহাসিক গুরুত্ব উপলব্ধি করে ভাষণটিকে গবসড়ৎু ড়ভ ঃযব ডড়ৎষফ’ং ওহঃবৎহধঃরড়হধষ জবমরংঃবৎ এ অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। বাঙালি জাতি এই ভাষণের মধ্য দিয়ে বিশ্ব ইতিহাসের এক গৌরবময় শিখরে পৌঁছে যায় এবং বিশ্ববাসীও এই স্বীকৃতির মাধ্যমে ঘোষণা করলো বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দূরদর্শী প্রজ্ঞাবান নেতৃত্বে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। উল্লেখ্য যে, ২০১৭ সালের ৩০ শে অক্টোবর সোমবার ইউনেস্কো কার্যালয়ে মহাপরিচালক ইরিনা বোকোভা এই ঐতিহাসিক ঘোষণা দেন। ওয়ার্ল্ড রেজিস্ট্রারে এই অসাধারণ ভাষণটির অন্তর্ভুক্তির জন্য ২০১৬ সাল থেকে বাংলাদেশ থেকে প্রক্রিয়া শুরু হয় এবং ২০১৭ সালের শেষ প্রান্তে এসে স্বীকৃতি আসে। এই অনন্যসাধারণ ভাষণের জন্য বঙ্গবন্ধুকে ‘রাজনীতির কবি’ হিসেবে নিউজউইক ম্যাগাজিন আখ্যা দেয়। বঙ্গবন্ধু কি রকম বিচক্ষণ বুদ্ধিদীপ্ত রাজনীতিবিদ ছিলেন তাঁর শেষ দুই লাইনের কবিতা দিয়েই বোঝা যায়। বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করলেন “এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম”। বাঙালি জাতি বুঝে গেলো বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ডাক দিলেন অথচ তিনি সরাসরি স্বাধীনতা ঘোষণা করলেন না। এই রাজনৈতিক প্রজ্ঞাই বিশ্ববাসীকে স্তম্ভিত করেছে। এই দুই লাইন কবিতায় স্পষ্ট হয়েছে স্বাধীনতার মাধ্যমে বাঙালি জাতি অর্থনৈতিক মুক্তি আনবে যা এখন বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা দেশরত্ন জননেত্রী শেখ হাসিনা করে যাচ্ছেন। সাড়ে সাতকোটি বাঙালিকে স্বাধীনতার জন্য তৈরী করতে তাঁর তেইশ বছরের সংগ্রামী জীবনে চৌদ্দ বৎসর জেল খাটতে হয়েছিল। মাত্র ৯ বৎসরের মধ্যে বঙ্গবন্ধু তাঁর রাজনৈতিক প্রজ্ঞা দূরদর্শিতা দিয়ে বাঙালি জাতিকে সংগ্রামী চেতনায় ঐক্যবদ্ধ করেছিলেন। তাঁর দেয়া ৬ দফা গ্রহণযোগ্য করে বাঙালিকে স্বাধীনতার চেতনায় উদ্বুদ্ধ করার জন্য টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া বহুবার ভ্রমণ করেছেন এবং শেষতক তিনি সফল হয়েছিলেন এবং বাঙালি জাতিকে একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র উপহার দিতে সক্ষম হয়েছিলেন। মূলত বাঙালি জাতি হাজার বছরের ইতিহাসে এই প্রথম একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র অর্জনে সক্ষম হল।
বঙ্গবন্ধু জাতির পিতা। তাই আমারও পিতা। ১৯৭৪ সালে বঙ্গবন্ধু আমাকে ভারতে পাঠিয়েছিলেন পদার্থবিদ্যায় ডক্টরেট ডিগ্রী নেয়ার জন্য। ১৯৮২ সালে পিএইচ.ডি ডিগ্রী লাভের পর বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং তৎপূর্ববর্তী বেসরকারী ও সরকারী কলেজে শিক্ষকতা জীবনসহ আমার পুরো জীবনের শিক্ষকতার বয়স সাড়ে বিয়াল্লিশ বৎসর। সুদীর্ঘ ৩৮ বৎসর পর ২০২০ সালে বঙ্গবন্ধু কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার হাত থেকে শিক্ষা ক্ষেত্রে অবদানের জন্য রাষ্ট্রের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পুরস্কার ‘একুশে পদক’ গ্রহণ করি। তাই পিতার কাছে আমি যেমন ঋণী, তেমনি আমার প্রিয় বোন শেখ হাসিনার কাছেও ঋণী। বঙ্গবন্ধু এই রকম আমার মতো বহু প্রতিভাবান সন্তানদেরকে উচ্চ শিক্ষা গ্রহণের জন্য বিদেশে বৃত্তির ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিলেন। তাঁরা উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ শেষে দেশে এসে দেশ গঠনে সহযোগিতা করবেন এ ছিল বঙ্গবন্ধুর উদ্দেশ্য। কারণ বঙ্গবন্ধু জানতেন পাক হানাদার বাহিনী আত্ম সমর্পণের আগে বহু বুদ্ধিজীবী হত্যা করে বাংলাদেশকে মেধাশূন্য করেছে। তাই তাঁর সন্তানদের উচ্চ শিক্ষার ব্যবস্থা করেছিলেন। অপর দিকে শেখ হাসিনা প্রতিভা ও মেধা সম্পন্ন ব্যক্তিদের মূল্যায়ন করছেন, সম্মানিত করছেন। পিতার সেই মহৎ ভাবনাকে কন্যা যথাযোগ্য মর্যাদা দিয়ে চলেছেন। আমার ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম হয়নি বলে আমি মনে করি।
যা হোক বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে সাম্রাজ্যবাদের দোসররা নির্মম নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করে বাংলাদেশকে একটি অরাজক রাজ্যে পরিণত করলো। সৌভাগ্যবশত জার্মানীতে থাকার কারণে শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা বেঁচে যান। এই বেঁচে যাওয়াটা বাংলাদেশের জনগণের জন্য, বাঙালি জাতির জন্য মহান আশীর্বাদ স্বরূপ হয়ে দাঁড়ালো। সেই আশীর্বাদের যাত্রা শুরু হলো তখনি যখন বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা শেখ হাসিনা প্রায় ৬ (ছয়) বৎসর বিদেশে নির্বাসনের পর ১৯৮১ সালের ১৭ই মে দেশে ফিরলেন। সেদিন ঢাকা আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরে লাখো লাখো বঙ্গবন্ধুর সৈনিক শেখ হাসিনাকে অন্তরের অর্ঘ্য দিয়ে বিপুলভাবে অভ্যর্থনা-অভিনন্দন জ্ঞাপন ছিল বাংলাদেশের সোনালী সূর্যের উত্থান।
১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা সংগ্রামের ডাক আর ১৯৮১ সালের ১৭ই মে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার লাখো জনতার সামনে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়ার দৃপ্ত শপথে স্বদেশ প্রত্যাবর্তন কালের প্রবাহে আমি মনে করি বিশ্ব রাজনীতির ইতিহাসে এক বিরাট বিস্ময়। শেখ হাসিনা স্বদেশে অসম সাহসিকতার সাথে ফেরৎ এসেছিলেন বলেই বাংলাদেশ আজ বিশ্বে রোল মডেল হয়ে দাঁড়িয়েছে। শেখ হাসিনাকে ধাপে ধাপে আন্দোলন ও আওয়ামীলীগকে সুসংগঠিত করে প্রায় পনের বছর লেগেছিল সরকার গঠন করতে। ১৯৯১ সালে বিরোধী দলীয় নেতা হিসেবে সঠিকভাবে দল পরিচালনা করতে পেরেছিলেন বলেই ১৯৯৬ সালে সরকার গঠন করতে সক্ষম হন। ২০০০ সালে পটপরিবর্তন হলে গণতান্ত্রিকভাবে তিনি ক্ষমতা ছেড়ে দিয়ে আবার বিরোধী দলীয় নেত্রী হন। ২০০৬ সালে ১/১১ এর ঘটনা সম্পর্কে আমরা সবাই জানি। নেত্রী আবার সংগ্রামে নেতৃত্ব দিলেন এবং ২০০৮ সালে পুনরায় সরকার গঠন করলেন। অদ্যাবধি তিনি সরকার চালাচ্ছেন অত্যন্ত সফলভাবে।
শেখ হাসিনার জীবনের সবচেয়ে বড়ো বৈশিষ্ট হলো জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে বাংলাদেশের মানুষকে তাঁর পিতার মতো অসীম মমতা স্নেহ দিয়ে তিনি ভালোবাসেন। তাই তিনি বাংলাদেশের সামগ্রিক উন্নয়ন ও কল্যাণে পরিশ্রম করে চলেছেন। জনসংখ্যাবহুল একটি দেশে সমস্যার অন্ত নেই। চারিদিকে সঠিক দৃষ্টি দিয়ে সেই সব সমস্যাগুলোর সমাধানে ধীরে ধীরে সামনের দিকে অগ্রসর হচ্ছেন। অথচ দেখা যাচ্ছে স্বার্থান্ধ ধর্মান্ধ ধর্মব্যবসায়ী কিছু রাজনীতিবিদের এই অগ্রযাত্রাকে কোনভাবেই পছন্দ হচ্ছে না। তারা অবিরাম সরকারের বিরোধীতায় লিপ্ত। অথচ নিজেরা অনুধাবন করতে চেষ্টা করছে না যে তারা অতীতে কি করেছে। বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গঠনের স্বপ্নকে ধুলিসাৎ করে দিয়ে তারা একটি অকার্যকর দেশে বাংলাদেশকে পরিণত করার জন্য উঠে পড়ে লেগেছিল এবং বর্তমানেও সেই অপচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। শেখ হাসিনা তাঁর পিতার মতো অসাধারণ সাহস মনোবল নিয়ে এইসব সাম্রাজ্যবাদ ও পাকিস্তানী প্রেতাত্মাদের মোকাবেলা করে বাংলাদেশকে বিশ্বে মর্যাদাপূর্ণ দেশে প্রতিষ্ঠিত করেছে এটি তাদের সহ্য হচ্ছে না। কথায় “যারে দেখতে নারে তার চলন বাঁকা”।
এই ধরণের ধর্ম ব্যবসায়ী রাজনীতিবিদদের বিরুদ্ধে যথ দ্রুত সম্ভব ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত। এরা সব সময় উদ্ধত ফনা বিস্তার করবেই। এদের ছাড় দিয়ে আশা করি নেত্রী ভুল করবেন না। সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে হবে। নেত্রীকে আরো কঠোর হতে হবে। গণতন্ত্র মানে সন্ত্রাসী বা জঙ্গী কর্মকাণ্ড নয়। গণতন্ত্র মানে সহনশীলতা, ধৈর্য্য, নিয়শ-শৃঙ্খলার প্রতি আনুগত্য থাকা। সরকার যদি কোথাও ভুল করে থাকে বা মানুষের কল্যাণের বিপরীতে কোন সিদ্ধান্ত নেয় তাহলে অবশ্যই সরকারের সমালোচনা করা যাবে। এটি সরকারকেও ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে দেখতে হবে। সরকার যেভাবে উন্নয়ন করে যাচ্ছেন সেটিরও তো প্রশংসা করতে হবে। অর্থাৎ আমরা আলোচনা-সমালোচনার একটা গণতান্ত্রিক পরিবেশ চাই। আমরা ধর্ম ব্যবসায়ীদের সন্ত্রাসী কর্মকান্ড, জঙ্গি তৎপরতা, ভাংচুর, জ্বালাও-পোড়াও ইত্যাদি ধ্বংসাত্মক কোনো কর্মকান্ড চাই না।
দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নই আমাদের কাম্য। বঙ্গবন্ধু বলেছেন, “এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম”। অর্থনৈতিক মুক্তি আসলেই তো আমরা বাঙালী জাতি বিশ্ব দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারবো। অর্থনৈতিক উন্নয়ন কর্মসূচীতে সরকারকে সহযোগিতা করা প্রত্যেক নাগরিকের দায়িত্ব ও কর্তব্য। সরকারের উচ্ছেদের পরিকল্পনা করা মানে দেশকে পিছিয়ে নেয়া এবং দেশের মধ্যে মাৎসন্যায় সৃষ্টি করা। এটা কোনো বৈধ সরকার মেনে নিতে পারে না। গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচনের মাধ্যমেই সরকার বদল হবে। জনগণ যাদেরকে চায় তারাই সরকার গঠন করবে।
আসুন আমরা ধৈর্য ধারণ করি এবং সহনশীল হই। বঙ্গবন্ধুর সামগ্রিক আন্দোলনে কোন সময়ই সহিংস রাজনীতির আশ্রয় নেননি। জনগণকে সুসংগঠিত করাই ছিল তাঁর লক্ষ্য। রাজনৈতিক দলগুলোকে অনুরোধ করবো জনগণের দুয়ারে যেতে। জনগণই এর প্রতিদান দিবে। রাজনীতিকে সুস্থির রাজনীতি দিয়ে মোকাবেলা করতে হবে অস্থির রাজনীতি দিয়ে নয়। জনগণের নিকট রাজনৈতিক মতাদর্শ ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন পরিকল্পনা তুলে ধরুন তাহলে একদিন না একদিন সফলকাম হবেন।
জনগণের কাছে বঙ্গবন্ধু ও শেখ হাসিনা যেতে পেরেছিলেন বলে তাঁরা সফল রাজনীতিবিদ। এই দু’য়ের সমন্বিত প্রয়াসেই বর্তমান বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা বাঙালি জাতির জন্য আশীর্বাদ। ৭ই মার্চের ভাষণের পর বাংলাদেশের জনগণ যেমন স্বাধীনতা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন তেমনিভাবে শেখ হাসিনার ১৭ই মে বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তন যুগান্তকারী সন্ধিক্ষণ হিসেবে বিশ্ব রাজনীতির ইতিহাসে বিবেচিত হবে ইহা আমি মনে করি। জয় বঙ্গবন্ধু, জয় শেখ হাসিনা।
লেখক: একুশে পদকপ্রাপ্ত ব্যক্তিত্ব, চ.বি এর পদার্থবিদ্যা বিভাগের
সাবেক চেয়ারম্যান।