‘আমার পরিবার চাষা। আমার পক্ষে এটা ওভারলুক করা কষ্টকর, রঙ চড়িয়ে কিছু বলতে চাই না। আমার পূর্বপুরুষেরা সরাসরি কৃষি উৎপাদনের সাথে যুক্ত ছিল এই পরিচয় আমার অহংকার’– ‘বড়ো বড়ো নামকরা ইশকুলের বাচ্চারা বিদ্যার চেয়ে অহংকারটা বেশি শিখে।’ কথাসাহিত্যিক আহমদ ছফার কথাগুলো সত্যি হৃদয় স্পর্শ করে কতো দরদ দিয়ে তিনি গভীরভাবে সবকিছু নিয়ে ভাবতেন। বাংলার সক্রেটিস খ্যাত কথাসাহিত্যিক আহমদ ছফাকে আমরা কতটা মনে রেখেছি। অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় লেখকের গ্রামে তাঁর কোনো স্মৃতিচিহ্ন পর্যন্ত নেই।
লেখক আহমদ ছফাকে আমরা দেখতে পাই একজন প্রকৃত স্পষ্টবাদী ও শিশুপ্রেমী হিসেবে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তিনি প্রথম সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের নিয়ে কাজ করেছেন। সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের ইশকুল যাত্রা শুরু হয় ব্রিটিশ শাসনামলে ১৮১৮ সালে, নৈশবিদ্যালয়ে বয়স্কশিক্ষা কার্যক্রম চালুর মাধ্যমে বাংলাদেশে উপানুষ্ঠানিক শিক্ষার প্রথম উদ্যোগ নেওয়া হয় যা সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের জন্য শিক্ষার সুযোগ সৃষ্টি করে।
সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের জন্য বাংলাদেশে প্রথম ইশকুল প্রতিষ্ঠা নিয়ে কথা বলেছিলাম লেখক ও বুদ্ধিজীবী অধ্যাপক সলিমুল্লাহ খানের সাথে। তিনি জানান, ‘দেশে প্রথম কি না বলতে পারছি না। তবে এই ইশকুল তিনি শুরু করেন ১৯৭৬ সালের পরে। নাজিম উদ্দিন ছিলেন তাঁর প্রধান সহযোগী। শিল্পী সুলতান কর্ম ও শিক্ষাকেন্দ্র ছিল ইশকুলের আদি নাম। আহমদ ছফার জীবনাবসানের পর ইশকুলটির নাম রাখা হয় ‘সুলতান–ছফা পাঠশালা’।
আশির দশকেও ঢাকার কাঁটাবন এলাকায় সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের জন্য কাঁটাবন বস্তিতে ‘শিল্পী এসএম সুলতান কর্মশালা’ নামেও একটি ইশকুল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। কথাসাহিত্যিক আহমদ ছফা সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের নিয়ে বলেছিলেন, ‘আমরা ছেলেমেয়েদের যখন পড়াতে শুরু করলাম, আমাদের একটা কঠিন অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হতে হলো। বস্তির শিশুদের মুখ থেকে অনর্গল অশ্লীল বুলি নির্গত হয়। একজন আরেকজনকে মা–বাবা তুলে অশ্লীল ভাষায় গালাগাল করে যে, শুনলে কানে হাত দিতে হয়। এক শিশুকে জিগ্যেস করা হয় তার বাবা–মা কী করে? পাশের শিশু জবাব দেয় অর বাপ ছিঁচকা চোর। এক মেয়েকে জিগ্যেস করা হয় তার মা কী করে। পাশে বসা মেয়েটি কালবিলম্ব না করেই জবাব দিয়েছিল অর মা খারাপ কাম করে।’
গত ১৭ জানুয়ারি ২০২৫ সালে কথাসাহিত্যিক আহমদ ছফার পালিত পুত্র সুশীলচন্দ্র সিংহের তত্ত্বাবধানে সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের জন্য ‘আহমদ ছফা শিশু শিক্ষানিকেতন’ নামে নতুন করে যাত্রা শুরু করে ‘শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধ গেট মিরপুর–১’ এ। কথাসাহিত্যিক আহমদ ছফার পালক পুত্র সুশীল সহজসরল বিনয়ী মানুষ। একটা এনজিওতে কাজ করত। সুশীলের স্বপ্ন বিদ্যালয়টি একদিন প্রতিষ্ঠা পাবে। সুবিধাবঞ্চিত শিশুরা এই ইশকুল থেকে বিদ্যার্জন করবে। উদ্বোধক ছিলেন আহমদ ছফার ভাতিজা লেখক ও গবেষক নূরুল আনোয়ার, ড. চিন্ময় হাওলাদার ও সৌভাগ্যক্রমে আমিও দাওয়াত পেয়েছিলাম। কথাসাহিত্যিক আহমদ ছফার পালিত পুত্র সুশীলকে নিয়ে না বললেই নয়।
লেখক আহমদ ছফা আলমগীর নামে এক অনাথ শিশুকে বাড়ি কোথায় জিগ্যেস করলে সে বলত হাসপাতালে। বাবা–মা সবকিছু হাসপাতালে। আহমদ ছফার মায়া হলো তিন একসময় আলমগীরের জন্য তোশক কিনে দিলেন। জামাকাপড় বানিয়ে দিলেন, স্যান্ডেল কিনে দিলেন। আলমগীর মনের আনন্দে খাচ্ছে, ঘুমোচ্ছে, পাঠশালায় যাচ্ছে। আলমগীরকে কথাসাহিত্যিক আহমদ ছফা চোখে চোখে রাখতেন যেখানে যেতেন সঙ্গে করে নিয়ে যেতেন। সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের ইশকুল আরম্ভ করেছেন, মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি ইশকুল পরিচালনা করে গেছেন। পরবর্তীতে কথাসাহিত্যিক আহমদে ছফা না ফেরার দেশে যাওয়ার পর সেটির নামকরণ হয়েছিল ‘সুলতান–ছফা পাঠশালা’ এই পাঠশালার সাথে অনেক বড়ো বড়ো সাংবাদিক, সাহিত্যিক কবিরা জড়িত ছিলেন। কিন্তু পরবর্তীতে সেটি আর টিকিয়ে রাখা যায়নি।
প্রিয় লেখক আহমদ ছফা নেই, নিজের হাতে গড়া সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের ইশকুলও কালের বিবর্তনে হারিয়ে গেছে। কিন্তু পালকপুত্র সুশীলরা বেঁচে আছে বলে আজকের ‘আহমদ ছফা শিশু শিক্ষানিকেতন’ নতুন করে স্বপ্ন দেখে।
লেখক: প্রাবন্ধিক।