বাংলাদেশে সুফিবাদ ও মাজার সংস্কৃতি ইসলামি আধ্যাত্মিকতার এক শক্তিশালী প্রবাহ, যা এই অঞ্চলের ধর্মীয় ও সামাজিক জীবনে গভীর প্রভাব ফেলেছে। সুফি সাধকগণ তাঁদের দাওয়াত, প্রেমময় বার্তা ও স্থানীয় সংস্কৃতির সাথে একাত্ম হওয়ার মাধ্যমে বাংলায় ইসলামের প্রচার ও প্রসার ঘটিয়েছেন। মাজারগুলো এখন শুধু পীর–দরবেশদের সমাধিস্থলই নয়, বরং শান্তি, সমপ্রীতি ও মুক্তির কেন্দ্র হিসেবে সকল ধর্ম–বর্ণের মানুষের মিলনস্থলে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশের সুফিবাদ ও মাজার সংস্কৃতিতে হযরত শাহজাহান শাহ্ (রঃ) একজন গুরুত্বপূর্ণ আধ্যাত্মিক ব্যক্তিত্ব, যিনি খ্রিস্টীয় পঞ্চদশ শতাব্দীতে ইয়েমেন থেকে চট্টগ্রামে এসে ইসলাম প্রচারে অবদান রাখেন। তাঁর মাজার ভক্তদের তীর্থস্থান হিসেবে মাজার যিয়ারত তথা মাজার পরিদর্শন করার রেওয়াজ প্রচলিত আছে। তিনি চট্টগ্রামে ইসলাম প্রচারকারী সুফী সাধকদের অন্যতম, এবং তাঁর মাজারটি ঐশী কল্যাণময়তার প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হয়। তাঁর মাজার চট্টগ্রাম জেলার হাটহাজারীর ২ নং ধলই ইউনিয়নের কাটিরহাটে অবস্থিত। তিনি বারো আউলিয়ার একজন হিসেবেও পরিচিত।
বাংলাদেশের সমাজ ও সাংস্কৃতিক গঠনে সুফিবাদ ও মাজার সংস্কৃতি একটি গভীর ও স্থায়ী প্রভাব বিস্তার করেছে। এটি কেবল ধর্মীয় বিশ্বাসের বিষয়ই নয়, বরং একটি সামগ্রিক সামাজিক ব্যবস্থা, যেখানে ক্ষমতা, অর্থনীতি, সংস্কৃতি ও সামাজিক একত্রীকরণের সম্পর্ক জড়িত। হযরত শাহজাহান শাহ্ (রঃ) –এর ব্যক্তিত্ব ও কর্মকাণ্ডকে এই বৃহত্তর সমাজতাত্ত্বিক প্রেক্ষাপটে বিশ্লেষণ করা যেতে পারে যা সাধারণের বাইরে অপেক্ষাকৃত একাডেমিক চিন্তুকদের চিন্তায় ভিন্ন মাত্রা দান করতে পারে বলে মনে করি। সমাজতত্ত্বের দৃষ্টিকোণ থেকে, সুফিবাদ ও মাজার সংস্কৃতিকে বেশ কিছু তাত্ত্বিক ধারণার মাধ্যমে বোঝার চেষ্টা করা যায়, যেমন–
১. সামষ্টিক চৈতন্য: সমাজতাত্ত্বিক এমিল ডুরখেইমের মতে, ধর্ম সামাজিক সংহতির একটি মৌলিক উপায়। মাজার কেন্দ্রিক অনুষ্ঠান, ওরস ও মিলাদ সামাজিক মেলবন্ধন সৃষ্টি করে। এটি একটি ‘সামষ্টিক চৈতন্য’ গঠনে সহায়তা করে, যেখানে বিভিন্ন শ্রেণি–পেশার মানুষ এক কাতারে এসে দাঁড়ায়। তিনি যুক্তি দেন যে ধর্মের প্রধান কাজ হল ‘সামাজিক সংহতি’– কে সুসংহত করা এবং একটি ‘সামষ্টিক চৈতন্য’ তৈরি করা, যা সমাজের সদস্যদের মধ্যে সামষ্টিক বিশ্বাস এবং মূল্যবোধ তৈরির একটি ব্যবস্থা। ধর্মীয় রীতি–নীতি ও অনুষ্ঠানসমূহ ব্যক্তিদের একত্রিত করে এই সংহতিকে শক্তিশালী করে এবং সামাজিক শৃঙ্খলা বজায় রাখে।
২. সাংস্কৃতিক সমন্বয়: বাংলায় সুফিবাদ একটি সাংস্কৃতিক সমন্বয়ের মডেল। এটি স্থানীয় (বৌদ্ধ, হিন্দু, আদিবাসী) দেবদেবী, উৎসব ও বিশ্বাস (যেমন, বটগাছের পূজা, নদীর দেবতা) এর সাথে ইসলামী তাওহীদ ও রাসূলের প্রতি ভালোবাসার এক অনন্য সমন্বয় ঘটিয়েছে। এই প্রক্রিয়ায় ইসলাম বাংলার মাটি ও মানুষের কাছে ‘বৈদেশিক’ ধর্ম না থেকে ‘আত্মীয়’ ধর্মে পরিণত হয়। তেমনি মাজার কেন্দ্রিক যে প্রার্থনা ও প্রত্যাশার মেলবন্ধন ও সাংস্কৃতিক সমন্বয়ধর্মী গঠন সুফিদের দেহাবসান পরবর্তী বাঙালি মাজার সংস্কৃতিতে দেখতে পাই, তা সাংস্কৃতিক মডেলের অনুরূপ, যেখানে জনসমষ্টিকে একটি সাধারণ ঐক্যানুভুতিতে গ্রথিত করে।
৩. সাংস্কৃতিক আধিপত্য: এন্তনিও গ্রামশি ‘সাংস্কৃতিক আধিপত্য’ ধারণাটির প্রবর্তন করেন, যার মাধ্যমে শাসক শ্রেণি তাদের নিজস্ব বিশ্বাস, মূল্যবোধ এবং আদর্শকে প্রভাবশালী বিশ্বদর্শন হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে, যাতে তারা ‘স্বাভাবিক’ এবং ‘অবিসংবাদী’ বলে মনে হয়। এই প্রেক্ষাপটে, স্থানীয় মাজার সংস্কৃতিকে রাষ্ট্রীয় ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান বা শহুরে এলিট আলেমদের প্রভাব–বলয়ের বিরুদ্ধে একটি ‘প্রতিদ্বন্দ্বী বা পাল্টা–আধিপত্য’ হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে, যা একটি বিকল্প আধ্যাত্মিক ও সামাজিক কর্তৃত্বের জগৎ সৃষ্টি করে। গ্রামশির ‘আধিপত্য’ তত্ত্ব অনুযায়ী, রাষ্ট্র বা শাসকগোষ্ঠী তাদের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ দ্বারা জনগণের উপর কর্তৃত্ব বজায় রাখে। বাংলায়, সুফি–দরবেশরা অনেক ক্ষেত্রে রাজকীয় ইসলামের (যা ছিল মূলত শহরকেন্দ্রিক ও এলিট শ্রেণির) বাইরে গিয়ে একটি ‘জনগণের ইসলাম’ এর বিকাশ ঘটান। এই জনগণের ইসলাম স্থানীয় ভাষা, সংস্কৃতি ও চাহিদার সাথে সম্পর্কিত, যা রাজকীয় আধিপত্যের একটি পাল্টা–বলয় তৈরি করে।
বাংলাদেশের সুফি–মাজার সংস্কৃতির সমগ্র চিত্রটি অসংখ্য স্থানীয় পীর–অলীদের জীবন ও কর্ম দ্বারা গঠিত, যারা জাতীয় পর্যায়ে যতটা না সুপরিচিত তার চাইতেও স্থানীয় সমাজ গঠনে গভীর প্রভাব রেখে গেছেন। চট্টগ্রাম জেলার হাটহাজারী উপজেলার ২ নং ধলই ইউনিয়নের কাটিরহাট এলাকার হযরত শাহজাহান শাহ্ (রঃ) এই ধরনেরই এক ব্যক্তিত্ব। তাঁর মাজার কেবল একটি ধর্মীয় স্থানই নয়, বরং একটি সক্রিয় সামাজিক প্রতিষ্ঠান যার মাধ্যমে ক্ষমতা, অর্থনীতি ও সাংস্কৃতিক পরিচয় পুনরুৎপাদন হয়। উপরোক্ত সমাজতাত্ত্বিক কাঠামোর আলোকে এই মাজার ও এর সামাজিক বাস্তবতাকে যদি বিশ্লেষণ করি তাহলে তার দৃশ্যপট এরকম দাঁড়ায় –
সামষ্টিক চৈতন্য ও হযরত শাহজাহান শাহ্ (রঃ): হযরত শাহজাহান শাহ্ (রঃ) –এর মাজার কাটিরহাট ও তার পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলোর জন্য একটি শক্তিশালী সামাজিক সংহতির কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে কাজ করে। দৈনন্দিন, সাপ্তাহিক, মাসিক কিংবা বাৎসরিক জিকির–মজলিস, বিশেষ করে বার্ষিক ‘ওরস শরীফ’ –এর মতো অনুষ্ঠানগুলো ডুরখেইম বর্ণিত ‘সামষ্টিক অনুষ্ঠান’ –এর ক্লাসিক উদাহরণ। একাধিক সুত্র থেকে জানা যায়, ওরসের সময় হাজারো মানুষ একত্রিত হয়ে যৌথ প্রার্থনা, রূহানী সঙ্গীত এবং সম্মিলিত উৎসবে অংশগ্রহণ করে। এই অভিজ্ঞতা অংশগ্রহণকারীদেরকে তাদের ব্যক্তিগত পরিচয় থেকে উত্তরণ ঘটিয়ে ‘কাটিরহাটের মাজারের সমপ্রদায়’ তথা সামষ্টিক চৈতন্যের অংশ হতে সাহায্য করে। এটি সমাজের মধ্যে একটি শক্তিশালী বন্ধন তথা সংহতি তৈরি করে এবং স্থানীয় পর্যায়ে সামাজিক একত্রীকরণ কে শক্তিশালী করে, যা ডুরখেইমের তত্ত্বের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
সাংস্কৃতিক সমন্বয় ও হযরত শাহজাহান শাহ্ (রঃ): হযরত শাহজাহান শাহ্ (রঃ) – এর জীবনী ও কর্মকাণ্ড স্থানীয় কিংবদন্তি ও লোককথায় সমৃদ্ধ। স্থানীয় জনশ্রুতি রয়েছে যে, তিনি হিন্দু সমপ্রদায়ের সাথেও সুসম্পর্ক বজায় রেখে চলতেন। এখনও তাঁর মাজারটি হিন্দু–মুসলমান উভয় সমপ্রদায়ের কাছেই একটি পবিত্র স্থান হিসেবে সমাদৃত। এটি সুফিবাদের সেই সমন্বয়শীল চরিত্রেরই প্রতিফলন, যা ধর্ম–বর্ণ–গোত্র নির্বিশেষে সকল মানুষকে একত্রিত করে। সুফিগণ শুধু আধ্যাত্মিক শিক্ষাই দেননি, তাঁরা সামাজিক কুসংস্কার, বর্ণপ্রথার কঠোরতা এবং সামপ্রদায়িক বিদ্বেষ দূর করতেও কাজ করেছেন। হযরত শাহজাহান শাহ্ (রঃ)-এর শিক্ষাও ছিল মানবতা, সহিষ্ণুতা ও নৈতিকতার ওপর ভিত্তিশীল। তিনি তাঁর অনুসারীদেরকে সৎ জীবনযাপন, পরোপকার ও আল্লাহর প্রতি আত্মসমর্পণের শিক্ষা দিয়েছেন, যা সামগ্রিকভাবে সমাজের নৈতিক ভিতকে শক্তিশালী করেছে। সুতরাং জাত, ধর্ম, শ্রেণি সীমার উচ্চে হযরত শাহজাহান শাহ্ (রঃ) এর মাজার হয়ে উঠে সাংস্কৃতিক সমন্বয়ের মূর্ত প্রতীক।
সাংস্কৃতিক আধিপত্য ও হযরত শাহজাহান শাহ্ (রঃ): কাটিরহাটের মাজারকে রাষ্ট্রীক বা প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মীয় কর্তৃত্বের বিরুদ্ধে একটি স্থানীয়ভাবে নির্মিত আধ্যাত্মিক আধিপত্য গড়ে তোলার উদাহরণ হিসেবে দেখা যায়। গ্রামশির মতে, আধিপত্য কেবল জবরদস্তিমূলক নয়, বরং সম্মতিমূলক। হযরত শাহজাহান শাহ্ (রঃ) – এর কর্তৃত্ব কোনো আনুষ্ঠানিক ধর্মীয় ডিগ্রি বা রাষ্ট্রীক আনুকূল্য থেকে উদ্ভূত হয়নি; বরং এটি স্থানীয় জনগণের স্বীকৃতি, তাঁর জীবনী ও অলৌকিক ক্ষমতার প্রতি বিশ্বাস থেকে উৎসারিত। এই মাজার তাই একটি ‘প্রতিদ্বন্দ্বী ক্ষেত্র’ তৈরি করেছে, যেখানে স্থানীয়ভাবে উৎপন্ন আধ্যাত্মিকতা, বিশ্বাস ও সমস্যা সমাধানের পদ্ধতি (যেমন, মানতের মাধ্যমে সমস্যার সমাধান খোঁজা) প্রাধান্য পায় এবং প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের আনুষ্ঠানিক কাঠামো– কে চ্যালেঞ্জ করে। সমাজতত্ত্বে, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানকে ক্ষমতা সম্পর্কের একটি ক্ষেত্র হিসেবে দেখা হয়। একজন সুফিসাধক এবং তাঁর পরবর্তীতে তাঁর মাজার, একটি আধ্যাত্মিক কর্তত্বের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়। এই কর্তৃত্ব অনেক সময় জমি–জমা, দান–খয়রাত এবং সামাজিক বিরোধ নিষ্পত্তির মতো বিষয়েও প্রভাব রাখত। হযরত শাহজাহান শাহ্ (র.)-এর মাজারও অনুরূপ একটি সামাজিক–আধ্যাত্মিক কর্তৃত্বের প্রতীক।
তথাপি, আধুনিক ও বিশ্বায়িত বাংলাদেশে মাজার কেন্দ্রিক এই সংস্কৃতি বর্তমানে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। মাজার যিয়ারত, মানত করা ইত্যাদিকে কিছু গোষ্ঠী শিরক ও বিদআত হিসেবে দেখে, যা এই সংস্কৃতির প্রতি মানুষের বিশ্বাসে প্রশ্ন তোলে। শুধু তাই নয়, সমসাময়িক বাংলাদেশে এসব মাজার একটি মহল কর্তৃক গুড়িয়ে দেওয়ার মতো ঘটনাও ঘটে চলছে। অপরদিকে, আধুনিক নগর জীবনে মানুষের সময়স্বল্পতা এবং ধর্মের ব্যক্তিগত ব্যাখ্যার প্রবণতা মাজারে যাওয়া ও সামাজিক মেলামেশার এই রীতিকে কিছুটা সীমিত করছে। তবুও, হযরত শাহজাহান শাহ্ (রঃ) – এর মাজারসহ অসংখ্য মাজার আজও তাঁদের প্রাসঙ্গিকতা বজায় রেখেছে। যুক্তিবাদী যুগেও মানুষের আধ্যাত্মিক চাহিদা, অনিশ্চয়তা ও দুঃখ–কষ্টে সান্ত্বনা খোঁজার প্রবণতা এই সকল স্থানকে টিকিয়ে রেখেছে। সমাজতাত্ত্বিক বিশ্লেষণে দেখা যায় যে, হযরত শাহজাহান শাহ্ (রঃ) – এর মতো সুফি সাধক এবং মাজার সংস্কৃতি বাংলার সমাজ গঠনে একটি বহুমাত্রিক ভূমিকা পালন করে চলেছে। এটি ধর্মীয় বিশ্বাসের জগতকে অতিক্রম করে সামাজিক সংহতি, সাংস্কৃতিক সমন্বয়, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড এবং ক্ষমতা সম্পর্কের একটি জটিল জাল তৈরি করে। বাংলার সমাজবিন্যাসে সুফিবাদ ও মাজার কোনো প্রত্নতাত্ত্বিক বস্তু নয়, বরং একটি সক্রিয় ও প্রাণবন্ত সামাজিক বাস্তবতা, যা আজও এই অঞ্চলের মানুষের জীবনকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে চলেছে।
লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, সমাজতত্ত্ব বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।