সুদিন ফিরুক মৃৎশিল্পের

রতন কুমার তুরী | শনিবার , ১৫ জুলাই, ২০২৩ at ৭:১১ পূর্বাহ্ণ

দূর অতীতে মাটির তৈরি হাতলবিহীন চায়ের কাপ, থালা, হাড়ি, বদনা, গাবলা, কলসি, ধান রাখার জন্য মটকা আর পানি রাখার জন্য গজি ইত্যাদির প্রচলন ছিল। এসব জিনিস পাড়ার কুমোররা মাটি দিয়ে তৈরি করে তা বাজারে বিক্রি করতেন। তখন দেশের প্রতিটি বাজারে কুমোরদের মাটির তৈরি তৈজসপত্রের আলাদা জায়গা ছিল। বাজার বারের দিন দেখা যেতো হাটুরেদের কারো হাতে মাটির হাড়ি, কারো হাতে মাটির ব্যাংক আবার কারো হাতে পানি রাখার বড় গজি। অবশ্য এসব মাটির তৈরি তৈজসপত্র ব্যবহারের দিন অনেক আগেই শেষ হয়ে গেছে। এগুলো এখন বিভিন্ন রঙে মেলায় এবং অভিজাত এলাকার বিশেষ জায়গায় ছাড়া পাওয়া যায় না।

এখন অবশ্য কুমোরদের মধ্যে অনেকেই তাদের পেশার পরিবর্তন করেছে। কেউ কেউ লেখাপড়া শিখে চাকরি বাকরিতে ঢুকে পড়েছে। কেউ কেউ কামার, নাপিত, কিংবা চাষাভুষার কাজ করছে। মোটকথা জীবন ধারনের জন্য এরা বিভিন্ন পেশা গ্রহণ করেছে। সংখ্যায় কম হলেও অনেকে আবার এখনও এপেশাটিকে ধরে রেখেছে পরম মমতায়। এদের একটিই কথা বাপ দাদার পেশা ছাড়ি কীভাবে। এসব পেশাদার মৃৎশিল্পীদের মধ্যে কেউ কেউ আবার যুগের চাহিদা অনুযায়ী মাটির তৈরি জিনিসপত্রকে বিভিন্ন শৈল্পিক ছোঁয়া দিয়ে বাজারজাত করে চলেছে। আসল কুমোর পাড়ার প্রকৃত কুমোররা খুব একটা ভালো জীবনযাপন না করলেও মাটির জিনিসপত্রকে নিজেদের হাতের শৈল্পিক ছোঁয়ায় নান্দনিক করে তোলা মৃৎশিল্পীরা এখন মোটামুটি ভালোই আছে বলা চলে। মূলত কালের বিবর্তনে মাটির তৈরি জিনিষপত্রের ব্যবহার অনেকটাই হারিয়ে গেছে। এসব জিনিসের জায়গায় স্থান দখল করে নিয়েছে বিভিন্ন কোম্পানির ম্যালামাইন, সিরামিক, স্টীলের তৈরি দ্রব্যসামগ্রী। মাটির তৈরি তৈজসপত্র হারিয়ে যাওয়ার প্রধান কারণ হলো প্রথমত সিলভারের তৈজসপত্র বাজারের স্থান করে নেয়া। সিলভারের পর ম্যালামাইন, সিরামিক অনেকটা সুলভমূল্য হওয়ায় এবং এসব জিনিষ বিভিন্ন ডিজাইনের বাজারে পাওয়া যাওয়ায় সিলভারের তৈজসপত্রের প্রতিও মানুষের আকর্ষণ কমতে থাকে। সিলভারের হান্ডি ডেকসি, কড়াইয়ের এখনও প্রচলন থাকলেও বাসন, গ্লাস, চায়ের কাপ, সুপ বাটি ইত্যাদি জিনিসপত্র তেমন একটা দেখা যায় না। বাড়ির নিত্য ব্যবহার্য তৈজসপত্রের মধ্যে বেশিরভাগই এখন ম্যালামাইন, সিরামিক এবং স্টিলের দখলে। প্রকৃতপক্ষে দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশ হচ্ছে রূপ বৈচিত্র্যের দেশ। এদেশে অতীত কাল থেকেই হাজার ধরনের সংস্কৃতি পালন করে আসছে। এসমস্ত সংস্কৃতির একটি নিদর্শন হলো মৃৎশিল্প। বাংলাদেশের মৃৎশিল্পের এক সমৃদ্ধ ঐতিহ্য রয়েছে। ‘মৃৎ মানে মাটি আর শিল্প মানে সুন্দর সৃষ্টিশীল বস্তু। তাই মাটি দিয়ে তৈরি শিল্পকর্মকে মৃৎশিল্প’ বলা হয়ে থাকে এবং যারা এই শিল্পকর্মের সাথে জড়িত তাদেরকে বলা হয় কুমোর। কুমোররা শৈল্পিক দক্ষতার সাথে বাড়ির নিত্যপ্রয়োজনীয় মাটির জিনিসপত্র তৈরি করে থাকেন। এই শিল্পটি হলো বাংলাদেশের সবচেয়ে প্রাচীন ও অন্যতম একটি শিল্প যা বাংলাদেশের ঐতিহ্য বহন করে। এটি মূলতঃ এদেশের হাজার বছরের একটি ঐতিহ্য। যে ঐতিহ্যের সাথে জড়িয়ে আছে পুরো একটি সমপ্রদায়, যে সমপ্রদায়ের ইতিহাস অতি প্রাচীন।

কালের বিবর্তনে, শিল্পায়নের যুগে ধীরে ধীরে বিলীন হয়ে যাচ্ছে গ্রাম বাংলার ঐতিহ্য এই মৃৎ শিল্প। বাজারে যথেষ্ট চাহিদা না থাকা, সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে কাজের পরিধি পরিবর্তন না করা, কাজে নতুনত্বের অভাব, আয়ের সঙ্গে ব্যয়ের অসঙ্গতি, কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহৃত মাটির মূল্য বৃদ্ধি, কাঁচামাল ও উৎপাদিত সামগ্রী পরিবহনে সমস্যা নানা কারণে মুখ থুবড়ে পড়েছে। বাংলার বহু বছরের এই ঐতিহ্যবাহী শিল্প। এমনটা হওয়ার মূল কারণ হচ্ছে জীবন যাপনে আধুনিকতার ছোঁয়া এবং বিজ্ঞানের উৎকর্ষতা।

বর্তমানে আধুনিকতার ছোঁয়া লাগায় এই শিল্পে অনেকটা ভাটা পড়লেও নতুন করে মৃৎশিল্পের আর একটি শাখা উন্মোচিত হয়েছে। সেটি হলো নান্দনিক মৃৎশিল্প। এ শাখার মৃৎশিল্পীরা মাটি দিয়ে বিভিন্ন শৌখিনসামগ্রী ও শিল্পকর্ম তৈরি করে থাকেন, ইংরেজিতে একে বলা হয় পটারি শিল্প। এরা টেরাকোটা বা মৃৎফলকে খোদাই করে সুন্দর সুন্দর শোপিস তৈরি করেন। এছাড়া বিভিন্ন মূর্তি, অলঙ্কার, নকশি পাত্র, ঘণ্টা ইত্যাদি তৈরি করছেন। ঢাকা, চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন বিভাগীয় শহরের অনেক দোকানে এসব শৌখিন মৃৎসামগ্রী বিক্রি হচ্ছে। পটারি শিল্পের এসব জিনিসপত্র বিদেশেও রপ্তানি হচ্ছে। সত্যি কথা বলতে কী মাটির টেরাকোটা শিল্পের মাধ্যমে মৃৎশিল্প আজ অনেকদূর এগিয়ে গেছে। তবে এখনও কুমোর পাড়ার মানুষদের সুদিন ফিরেনি। এখনও আমাদের দেশে যেসমস্ত কুমোররা মৃৎশিল্পটিকে ধরে আছে তাদের প্রত্যেককে পটারি শিল্পের বিষয়ে হাতে কলমে শিক্ষা দিতে হবে, এতে করে এরা তাদের মাটির তৈরি তৈজসপত্রে শৈল্পিক এবং নান্দনিকতার ছোঁয়া দিতে পারবে এবং এতে তাদের তৈরি জিনিসপত্রেরও বাজারে চাহিদা থাকবে তারা এর অধিকমূল্যও পাবে। অর্থনৈতিক টানাপোড়নে ধুকতে থাকা কুমোরদেরও অর্থনৈতিক চাকা সচল থাকবে। মূলত এখনও কিছু কুমোরকে গ্রামেগঞ্জে মেলা কিংবা বাজারে কাঁধে করে নিয়ে যাওয়া তাদের কষ্টে তৈরি করা মাটির জিনিসপত্র বিক্রি করতে দেখা যায়। তাতে থাকে মাটির রঙবেরঙএর ব্যাংক, ফুলদানি, ছোট ছেলে মেয়েদের খেলনা, পুতুল ইত্যাদি। এগুলো তৈরি করতে পরিশ্রম এবং এর কাঁচামালের দাম বেশি বিধায় অনেক সময় কুমোররা এসব জিনিসপত্রের দাম বেশি হাঁকে আর এতে করে এদের বেচাবিক্রি কম হয়। অনেক সময় মেলার শেষদিন এসে এরা কম মূল্যে এসব মাটির তৈরি জিনিসপত্র বিক্রি করে দেয়। আমরা প্রত্যাশা করবো প্রাচীন এই মৃৎশিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে সরকার এগিয়ে আসবেন এবং দেশের সকল মৃৎশিল্পীদের সঠিক সংখ্যা নিরূপণের মাধ্যমে তাদের আর্থিক সহায়তা প্রদান করে তাদের শিল্পীসত্তাকে বাঁচিয়ে রাখবেন। শুধু সরকার নয় বেসরকারি কোম্পানি বা এনজিও সংস্থাগুলোও মৃৎশিল্পের প্রসারে এগিয়ে আসতে পারেন তাতে করে অবশ্যই মৃৎশিল্পের সুদিন ফিরবে।

লেখক : কলেজ শিক্ষক, প্রাবন্ধিক

পূর্ববর্তী নিবন্ধকৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ জ্ঞাপন চর্চা
পরবর্তী নিবন্ধহল্যান্ড থেকে