প্রশাসক খোরশেদ আলম সুজনের মেয়াদকালে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের (চসিক) লিজ দেওয়া জায়গা ও স্থাপনার বিষয়ে তদন্ত করা হবে। লিজ প্রক্রিয়ায় কোনো অনিয়ম হয়েছে কিনা তা তদন্তে কমিটি গঠনের জন্য সংস্থার প্রধান নির্বাহীকে নির্দেশ দিয়েছেন মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী।
গতকাল রোববার অনুষ্ঠিত চসিকের বর্তমান পর্ষদের তৃতীয় সাধারণ সভায় এ নির্দেশ দেন মেয়র। জুম অ্যাপের মাধ্যমে ভার্চুয়ালি অনুষ্ঠিত এ সভায় ১৯টি স্থায়ী কমিটি গঠন করা হয়। সভায় ডোর টু ডোর প্রকল্পে শ্রমিক পদে নিয়োগ পেলেও সুপারভাইজারের দায়িত্ব পালন নিয়ে প্রশ্ন তুলেন কাউন্সিলরগণ। আগামী বর্ষায় জলাবদ্ধতা নিয়েও শঙ্কা প্রকাশ করেন তারা।
সিটি মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী লিজ সংক্রান্ত তদন্ত কমিটি গঠনের বিষয়টি আজাদীকে নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলেন, আমরা আয়বর্ধক প্রকল্পের ওপর জোর দিচ্ছি। খালি জায়গায় প্রকল্প করব। সিটি কর্পোরেশনের অনেক জায়গা আছে, সেখানে আয়বর্ধক প্রকল্প করা যেতে পারে। কিন্তু অনেক জায়গা লিজ দিয়ে ফেলেছে। বিশেষ করে প্রশাসকের মেয়াদকালে অনেক জায়গা লিজ দিয়ে নষ্ট করে ফেলেছে। সেগুলো নিয়ে কানাঘুষা চলছে এবং নানা কথা হচ্ছে। তাই সেগুলো তদন্ত করার জন্য কমিটি হবে। আসলে সেখানে কী হয়েছে সবকিছু যাচাই-বাছাই করা হবে। খালি জায়গায় আমরা আয়বর্ধক প্রকল্প করে সিটি কর্পোরেশনকে স্বাবলম্বী করব।
তদন্ত কমিটি কখন গঠন করা হবে জানতে চাইলে চসিকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা কাজী মুহাম্মদ মোজাম্মেল হক আজাদীকে বলেন, সাধারণ সভার রেজ্যুলেশন বের হওয়ার পরই কমিটি গঠন করা হবে।
লিজ দেওয়া জায়গা ও সম্পত্তি : চসিক সূত্রে জানা গেছে, ১০টি জায়গা সেলামি ও মাসিক ভাড়ার বিনিময়ে ব্যবহারের অনুমতি ও বরাদ্দ দেওয়া হয়। এর মধ্যে পাঁচটি ২০২০ সালের ২২ ডিসেম্বর এবং পাঁচটি চলতি বছরের ২৮ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত বরাদ্দ কমিটির সভার সিদ্ধান্ত মোতাবেক চসিক কর্তৃপক্ষ কর্তৃক অনুমোদিত হয়েছে বলে বরাদ্দ ও ব্যবহারের অনুমতি পত্রে উল্লেখ করা হয়।
বরাদ্দ দেওয়া জায়গাগুলোর মধ্যে পোর্ট কানেকটিং রোডের চৌ-রাস্তার উত্তর-পূর্ব পাশে ৬০০ বর্গফুট খালি জায়গা বরাদ্দ দেওয়া হয় মীর আহমদকে। এজন্য সিটি কর্পোরেশন এককালীন পেয়েছে ছয় লাখ টাকা। প্রতি বর্গফুট মাসিক সাড়ে ৯ টাকা ভাড়ায় বিআরটিসি মার্কেট সংলগ্ন ভবঘুরে আশ্রয়কেন্দ্রের পাশে সেমিপাকা (২৮৯ বর্গফুট) ভবন বরাদ্দ দেওয়া হয় আকতার হোসেনকে। প্রতি বর্গফুট সাড়ে তিন টাকা মাসিক ভাড়ায় মাদারবাড়ি অ্যাপার্টমেন্ট সংলগ্ন একতলা ২০০ বর্গফুট (কম-বেশি) ভবনের বরাদ্দ দেওয়া হয় জুনায়েদ আহমদ চৌধুরীকে।
৪০ নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর অফিস ভবনের উত্তর ও পশ্চিম পাশে এক হাজার ৭৫৭ বর্গফুট খালি জায়গা সমীর মহাজন লিটনকে ব্যবহারে অনুমতি দেওয়া হয়। প্রতি বর্গফুটের মাসিক ভাড়া ধরা হয় ১০ টাকা। ইউনুছ মিয়া মেটারনিটি সংলগ্ন এক হাজার ৬৪ বর্গফুট খালি জায়গা প্রতি বর্গফুট মাসিক পাঁচ টাকা ভাড়ায় খলিলুর রহমান নাহিদকে, ঝুমুর সিনেমা হলের উত্তর পাশে জয় পাহাড় মৌজায় ৫৪০ বর্গফুট খালি জায়গা বর্গফুট প্রতি মাসিক পাঁচ টাকা ভাড়ায় রাবেয়া বেগমকে, প্রতি বর্গফুট ১০ টাকা মাসিক ভাড়ায় কেসিদে রোড গণশৌচাগারের পশ্চিম পাশে পরিত্যক্ত ৩৭৬ বর্গফুট খালি জায়গা জানে আলমকে, প্রতি বর্গফুট এক টাকা ৮০ পয়সা মাসিক ভাড়ায় মাদারবাড়ি ওয়ার্ড অফিস সংলগ্ন ৬ হাজার ৫৩৪ বর্গফুট খালি জায়গা খলিলুর রহমান নাহিদকে ব্যবহারের অনুমতি দেওয়া হয়।
এছাড়া শাহ আমানত মার্কেটের সিঁড়ির উত্তর পাশে বারান্দায় ১৫৩ বর্গফুট খালি জায়গা মাসিক দুই হাজার ২৯৫ টাকা ভাড়ায় এবং শাহ আমানত মার্কেটের সামনে আইএফসি ব্যাংকের বারান্দার প্রথম তলার ছাদের ওপর ৩৯০ ফুট জায়গা মাসিক পাঁচ হাজার ৮৫০ টাকা ভাড়ায় মো. শাহাজাহান চৌধুরীকে ব্যবহারের অনুমতি দেওয়া হয়।
প্রসঙ্গত, ১৮০ দিনের জন্য ২০২০ সালের ৬ আগস্ট প্রশাসকের দায়িত্ব নেন খোরশেদ আলম সুজন। চলতি বছরের ১ ফেব্রুয়ারি মেয়াদ পূর্ণ হয় তার। দায়িত্ব পালনকালে সাবেক মেয়র আ.জ.ম নাছির উদ্দীনের দায়িত্ব পালনকালে গৃহীত সৌন্দর্যবর্ধন প্রকল্পকে ঘিরে অনিয়মের দাবি করেন এবং এ বিষয়ে তদন্ত করেছিলেন চসিকের কর্মকর্তাদের দিয়ে।
১৯ স্থায়ী কমিটি গঠন : গঠিত ১৯ স্থায়ী কমিটির মধ্যে অর্থ ও সংস্থাপন বিষয়ক কমিটির সভাপতি করা হয় দক্ষিণ কাট্টলী ওয়ার্ড কাউন্সিলর মো. ইসমাইলকে। এছাড়া শিক্ষা বিষয়ক কমিটিতে উত্তর কাট্টলীর নিছার উদ্দীন আহমেদ মঞ্জু, স্বাস্থ্য বিষয়ক কমিটিতে আন্দরকিল্লার জহর লাল হাজারী, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিষয়ক কমিটিতে পশ্চিম ষোলশহরের মো. মোবারক আলী, নগর পরিকল্পনা বিষয়ক কমিটিতে পাহাড়তলীর মো. ওয়াসিম উদ্দীন চৌধুরীকে, নগর অবকাঠামো নির্মাণ বিষয়ক কমিটিতে দক্ষিণ পাহাড়তলীর গাজী মো. শফিউল আজিম, পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণ বিষয়ক কমিটিতে লালখান বাজারের আবুল হাসনাত মো. বেলাল, ক্রীড়া বিষয়ক কমিটিতে পূর্ব মাদারবাড়ীর আতাউল্লাহ চৌধুরী, পরিবেশ বিষয়ক কমিটিতে জামালখানের শৈবাল দাশ সুমন, আইন শৃঙ্খলা বিষয়ক কমিটিতে উত্তর আগ্রাবাদের নাজমুল হক ডিউক, যোগাযোগ বিষয়ক কমিটিতে উত্তর পতেঙ্গার আব্দুল বারেক, জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন বিষয়ক কমিটিতে উত্তর হালিশহরের মো. ইলিয়াস, হিসাব ও নিরীক্ষা বিষয়ক কমিটিতে মোহরার কাজী নুরুল আমিন, সমাজ কল্যাণ ও কমিউনিটি সেন্টার বিষয়ক কমিটিতে আলকরণের আবদুস সালাম মাসুম, বাজারমূল্য বিষয়ক কমিটিতে উত্তর মধ্যম হালিশহরের মো. আব্দুল মান্নান, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিষয়ক কমিটিতে উত্তর পাহাড়তলীর জহুরুল আলম জসিম, দরিদ্র হ্রাসকরণ বিষয়ক কমিটিতে এনায়েত বাজারের মো. সলিম উল্লাহ, পানি ও বিদ্যুৎ বিষয়ক কমিটিতে শুলকবহরের মো. মোর্শেদ আলম এবং নারী ও শিশু বিষয়ক স্থায়ী কমিটিতে সংরক্ষিত ওয়ার্ডের জেসমিন পারভীন জেসিকে সভাপতি করা হয়।
স্থানীয় সরকার আইন (সিটি কর্পোরেশন) ২০০৯-এর ৫০ ধারা অনুযায়ী, ১৪টি স্থায়ী কমিটি গঠনের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। এর বাইরেও কর্পোরেশনের সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী প্রয়োজনবোধে অন্য কোনো বিষয়ের জন্যও স্থায়ী কমিটি গঠন করা যাবে বলে আইনে উল্লেখ আছে। গতবার মোট ১৮টি স্থায়ী কমিটি গঠন করা হয়েছিল।
অন্যান্য : গতকাল অনুষ্ঠিত সভায় জলাবদ্ধতা বিষয়ে মতামত জানান অধিকাংশ কাউন্সিলর। তারা বলেন, বর্ষা ঘনিয়ে আসছে। এদিকে নগরে চলমান মেগা প্রকল্পের কারণে অনেক খালে এখনো বাঁধ। বাঁধগুলো দ্রুত অপসারণ করে পানি চলাচলের ব্যবস্থা না করলে ভারী বৃষ্টি হলে তীব্র জলাবদ্ধতা হওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করেন তারা।
সভায় কয়েকজন কাউন্সিলর বলেন, জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্প থেকে মাটি উত্তোলনের জন্য তিন কোটি টাকা বরাদ্দ পাওয়া গেছে। প্রতি ওয়ার্ডের জন্য ৮ লাখ ২৫ হাজার টাকা করে বণ্টনের জন্য বলেছেন মেয়র। কিন্তু এ বিষয়ে এখনো প্রকৌশল বিভাগ থেকে কোনো অগ্রগতি হচ্ছে না বলে অভিযোগ করা হয়।
সভায় ফিরিঙ্গিবাজার ওয়ার্ড কাউন্সিলর হাসান মুরাদ বিপ্লব প্রশ্ন করেন, ডোর টু ডোর প্রকল্পে শ্রমিক হিসেবে নিয়োগ পাওয়া অনেককে সুপারভাইজারের দায়িত্ব পালন করতে দেখা যায়। তাদেরকে সুপারভাইজার করা হয়েছে কিনা বা পদোন্নতি পেয়েছে কিনা তা অস্পষ্ট। বিষয়টি খতিয়ে দেখা উচিত। তা না হলে সমপদে নিয়োগ পেয়েও কেউ শ্রমিক এবং কেউ ওয়াকিটকি নিয়ে ঘুরবেন তা বেমানান।