(প্রথম পর্ব)
ঢাকা একটা ক্রেজিয়েস্ট শহর। এই একটা শহর যেখান মানুষ আর মানুষ, ছুটাছুটি, জ্যাম, হর্ণ, একের পর এক বিল্ডিং, ময়লার স্তূপ আর এসবের মধ্যে মানুষগুলো কিভাবে, কিসের আশায় দিব্যি বসবাস করছে সেটা একটা বড় রহস্য। নাকি বিখ্যাত গান Hotel California –এর শেষ লাইনটার মতো “You can check out any time you like , but you can never leave”। এসবের মধ্যেও আমি এই শহরে যতবার আসি ততবার তার সৌন্দর্য খোঁজার চেষ্টায় থাকি এবং বহুবার আসা–যাওয়ার পর আবিষ্কার করলাম এই শহরের আসল সৌন্দর্য হচ্ছে তার ভোরবেলা। এই শহরের ভোরটা হয় অসাধারণভাবে, খুব বেশী তেজ না নিয়ে সূর্যটা আস্তে আস্তে উঠতে থাকে, তার প্রথম কিরণে গাছের পাতাগুলোও নড়েচড়ে ঘুম থেকে জেগে উঠে, শহরের বড় বড় ফাঁকা সড়ক ধরে চলতে থাকা গাড়ি, নাইট ডিউটি শেষ করে ঘরের পথধরা মানুষ, পার্কে দৌড়তে থাকা বয়স্ক লোক, সদ্য খোলা টং–এর দোকান থেকে উড়তে থাকা চায়ের ধোঁয়া আর কুকুরগুলোর খুনসুটি স্লো মোশন–এর মতো ঢাকা শহরের এসব দৃশ্য আপনি অন্য সময় দেখতে পাবেন না, এটা কেবল ভোরবেলায় দেখবেন এটাই আমার কাছে ঢাকা শহরের আসল সৌন্দর্য। এই শহরের রাস্তাগুলো যে কত বড় সেটা ভোরবেলা ছাড়া বোঝা সম্ভব না।
এরকম এক ভোরবেলায় অদ্ভুত এই সৌন্দর্য দেখতে দেখতে শহরের বড় রাস্তা ধরে সোজা চলে আসলাম ঢাকা বিমানবন্দরে। দ্রুত বোর্ডিং পাস ও ইমিগ্রেশন শেষ করে অপেক্ষা করছি আমাদের বিমানের জন্য, খুব বেশী অপেক্ষাও করতে হলো না, ডাক পড়লো বিমানে উঠার। এই শহর পুরোপুরি জেগে উঠার আগেই আমাদের বিমান উড়াল দিলো আকাশে, এবার আমাদের গন্তব্য ভুটান যে দেশটাকে বলা হয় “Land of the thunder dragon” কিংবা “Land of happiness”। ড্রুক এয়ারের ছোট্ট একটা বিমানে (এটিআর ৪২–৬০০) চড়ে আগামী ১ঘন্টা ২০ মিনিট পর আমরা অবতরণ করবো পৃথিবীর অন্যতম ঝুঁকিপূর্ণ বিমানবন্দরে (পারো বিমানবন্দর)। কিছুক্ষণের মধ্যে আমাদের ছোট্ট বিমানটি ক্রেজিয়েস্ট ঢাকা শহরের আকাশও অতিক্রম করে ফেললো। জানালা দিয়ে সাদা সাদা মেঘের ভেলাগুলো দেখতে হঠাৎ চোখে পড়লো বরফে ঢাকা হিমালয় পর্বতের চূড়া। শুনলাম এই আকাশপথে নাকি এভারেস্টের চূড়া দেখা যায় আমরাও খুঁজতে লাগলাম কিন্তু চেষ্টা বৃথা গেলো। বিমানবালারা হাতে খাবারের প্যাকেট ধরিয়ে দিতে দিতে আমাদের ছোট্ট বিমানের পাইলট ঘোষণা দিলো অল্প সময়ের মধ্যে আমরা পারো বিমানবন্দরে অবতরণ করবো। পৃথিবীর যে অল্প কিছু বিমানবন্দর দেখার খুব আগ্রহ তার মধ্যে এই বিমানবন্দর শুরুর দিকে আছে ফলে আমার বুকের ধুপধুপানি যেনো আরো বেড়ে গেলো। আকাশের আঁকাবাঁকা পথ দিয়ে বিমানটা এগোতে থাকে বিমানবন্দরের দিকে, যখন জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখলাম তুষারে ঢাকা পর্বতগুলো বিমান থেকে খুব বেশী দূরে না বলতে গেলে এই তুষারে ঢাকা পর্বতগুলোর মাঝখান থেকেই পাইলটকে তার পথ বের করে নিতে হচ্ছে। চারপাশের দৃশ্যগুলো যেকোন সাহসী মানুষকে আতঙ্কিত করার জন্য যথেষ্ট, সেখানে আমার মতো মানুষজনের কথা বাদ দিলাম। যাত্রীদের আতঙ্ক দূর করার জন্য হয়তো বিমানের পাইলট খুব চমৎকার মিউজিক চালিয়ে দিয়েছে এটা কিছুটা মনের মধ্যে স্বস্তি নিয়ে আসছে আর এদিকে “যাক মরলেও এত সুন্দর মিউজিক শুনতে শুনতে মরতে পারবো” এটা ভেবে ভেবে আমি সিটবেল্ট পড়ে নিলাম। এতদিন দেখেছি আঁকাবাকা গাড়ির পথ আর এখন পাহাড়ের মাঝখান দিয়ে আঁকাবাঁকা পথ দিয়ে বিমানের অবতরণ এবং সে বিমানের যাত্রী হওয়া এক দারুণ অভিজ্ঞতা। সমস্ত উত্তেজনা নিয়ে আমরা পৃথিবীর অন্যতম ঝুঁকিপূর্ণ ও সুন্দর বিমানবন্দরে অবতরণ করলাম। চারপাশে উঁচু উঁচু পাহাড় তার মাঝখানে ছোট্ট একটা বিমানবন্দর, টার্মিনালটাও অসাধারণ। ইমিগ্রেশনের আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে আমরা বেরিয়ে পড়লাম Land of happiness এর দেশ ভুটানে।
Welcome to land of Happiness.
পারো এয়ারপোর্ট থেকে বের হয়ে আমাদের প্রথম গন্তব্য ভুটানের রাজধানী থিম্পু। ভুটানে আসতে হলে আপনাকে অবশ্যই ট্যুর গাইড এবং হোটেল সব আগে থেকে বুকিং দিয়ে রাখতে হবে। আমাদের গাইড এয়ারপোর্টে তাদের ঐতিহ্যবাহী স্কার্ফ দিয়ে আমাদের স্বাগতম জানালো, তাদের এই উষ্ণ অভ্যর্থনা ও প্রাথমিক পরিচয় পর্ব শেষ করে রওনা দিলাম থিম্পুর দিকে, আমাদের গাড়ি চলছে ভুটানের পাহাড়ের আঁকাবাঁকা রাস্তা ধরে। এয়ারপোর্ট থেকে বের হয়ে দেখলাম রাস্তাঘাট খুব সাজানো গোছানো প্রথম ভাবলাম হয়ত এয়ারপোর্ট এলাকা সেজন্য তারা একটু বাড়তি যত্ন করে রেখেছে কিছুক্ষণের মধ্যে আমার ভাবনাটা ভুল প্রামাণিত হলো পুরো থিম্পু পর্যন্ত রাস্তাটা খুবই পরিস্কার এবং সাজানো–গোছানো। সবচেয়ে অবাক করার বিষয় হচ্ছে পারো বিমানবন্দর থেকে থিম্পু পর্যন্ত প্রায় ১ঘন্টা ১০ মিনিটের যাত্রায় আমাদের ড্রাইভার কোন হর্ণ বাজায় নাই এবং আমি অন্য ড্রাইভারদেরও বাজাতে শুনলাম না। আমাদের গাইড ও ড্রাইভারকে জিজ্ঞাস করলাম তারা জানালো ভুটানে হর্ন বাজানো নিয়ে নিয়ম আছে স্কুল, হাসপাতাল, সরকারি ভবনের সামনে ও শহরের মধ্যে হর্ন বাজানো নিষেধ এবং হাইওয়েতে বেশী প্রয়োজন না হলে হর্ণ বাজানো যাবে না। ফলে তারা সবাই এই নিয়ম মেনে চলে। আসলে গত ২ দিন ধরে থিম্পুতে থাকার অভিজ্ঞতাও তাই বললো। ভুটান খুবই ছোট একটা দেশ, তার রাজধানীও খুব বেশী বড় না আমাদের বড় কোনো জেলার শহরের চেয়ে একটু বড় হতে পারে। চারপাশে উঁচু উঁচু পর্বত তার মাঝখানে ছোট্ট রাজধানী শহর, বছর দুয়েক আগেও নাকি এই শহরে স্নোফল হতো কিন্তু এখন আর হচ্ছে না। শহরে যেদিকেই যাবেন, যা দেখবেন সবকিছুই যেনো খুব যত্ন ও দরদ বানানো হয়েছে। শহরের প্রতিটা বিল্ডিং–দোকান–অফিস সব একই ডিজাইন, নিজেদের ঐতিহ্য, সংস্কৃতির ছোঁয়া সবকিছুতে, ভুটানের রাজা নাকি সব স্থাপনা নির্মাণের ক্ষেত্রে এই নিয়ম বেঁধে দিয়েছে। এই সুন্দর ভবন, দোকানপাট আপনার চোখের ও মনের তৃপ্তি নিয়ে আসবে আর পুরো শহর জুড়ে এত এত গাছ, ফুলের বাগান মনে হবে আপনি কোনো একটা পার্কের মধ্যে দিয়ে হাঁটছেন। গাড়ির কোনো হর্ন নাই, নেই কোন জ্যাম, রাস্তাঘাটে নেই কোন ময়লার স্তূপ আর যেখানে সেখানে থুথু ফেলার কোনো চিহ্ন পর্যন্ত নাই। আমরা গত ২ দিনে থিম্পু শহরের Simply Bhutan, বুদ্ধ পয়েন্টসহ নানা জায়গায় ঢুঁ মেরেছি সবকিছু পর্যটকদের জন্য খুব সুন্দর করে সাজিয়ে রাখা হয়েছে। আপনি টাকা দিয়ে ঢুকবেন আর তারা আপনাকে তার বিনিময় সর্বোচ্চ সেবাটা দিবেন, আপনি একটা চমৎকার অভিজ্ঞতা নিয়ে এসব জায়গায় থেকে বের হবেন। Simply Bhutan নামে একটা অসাধারণ মিউজিয়াম আছে থিম্পু শহরে যেখানে ভুটানের ইতিহাস–ঐতিহ্য–সংস্কৃতি সম্পর্কে আপনাকে চমৎকার ধারণা দিবে। গত ২ দিন ধরে থিম্পু শহরে যেখানে গিয়েছি, যার সাথেই কথা বলেছি সেটা হোক গাড়ির ড্রাইভার কিংবা ছোট্ট কোনো দোকানদার সবার ইংরেজি আমার চেয়ে বেশ ভালো যেটা আমাকে বেশ অবাক করে দিয়েছে। সন্ধ্যার সময় শহরটা হেঁটে হেঁটে দেখার চেষ্টা করলাম বুঝলাম শহরটা খুব বেশী রাত জাগে না ৭–৮ টার মধ্যে শহরটা বেশ নিরব হয়ে যায়। দূরের উঁচু উঁচু পাহাড়ধারের ঘরগুলোতে জ্বলতে থাকা বাতিগুলো দেখতে দেখতে যখন আপনি আপনার রুমে ফিরবেন তখন এই শহর আপনাকে আরেকবার তার প্রেমে পড়তে বাধ্য করবে। ঢাকা থেকে থিম্পু আসতে ১ ঘন্টা ১০ মিনিটের আশেপাশে সময় লাগে এটা খুব বেশী সময় না কিন্তু আমি যেনো একেবারে পৃথিবীর অন্যকোনো প্রান্তে চলে এসেছি।
থিম্পু শহরকে বিদায় দিয়ে আমরা রওনা দিলাম ভুটানের পুরাতন রাজধানী পুনাকার দিকে। এই শহরের দিকে যাত্রায় আমরা অতিক্রম করবো ভুটানের অন্যতম উঁচু পাস “দোচুলা পাস” যেটা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৩১০০ মিটার (১০,১০০ ফুট) উঁচুতে অবস্থিত। পাহাড়ের আঁকাবাঁকা পথে দিয়ে আমাদের গাড়ি ছুটতে লাগলো কিছুটা যাওয়ার পর দেখা মিলল পাহাড়ের পাথুরে নদী, পাহাড়ের আঁকাবাঁকা পথ দিয়ে নদীটা আমাদের বেশ কিছুদূর এগিয়ে দিলো। মার্চের মাঝামাঝি সময় থেকে ভুটানের পাহাড়গুলোতে নানা রং এর ফুল ফুটতে শুরু করে যেটা এপ্রিলে গিয়ে পুরো পাহাড়গুলোকে ঢেকে ফেলে সেটা দেখতেই নাকি প্রচুর পর্যটক ভীড় করে। দোচুলা পাসের দিকে যেতে যেতে দেখলাম পাহাড়ের গায়ে নানা রং এর ফুল ফুটতে শুরু করছে তবে আমাদের চোখ আটকে গেলো “রোডোডেনড্রন” গাছে। আমাদের মতো সমুদ্র পাড়ে বসবাস করা লোকদের কাছে এই রোডোডেনড্রন ফুল গাছের দেখা পাওয়া যেনো আজীবন মনে রাখার মত একটা ঘটনা।
এই ফুলের গাছ সাধারণত সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৮ হাজার থেকে ১০ হাজার ফুট উচ্চতায় জন্মায়, দক্ষিণ এশিয়া হিমালয় পর্বতমালায় এই ফুলের দেখা মেলে। জবা ফুলের মতো দেখতে এই ফুল বেশ ভালো রকম ফুটেছে এই সময়, গাড়ির জানাল দিয়ে পাহাড়ের যেদিকেই তাকাই এই ফুল যেনো সবার আগে নজর কেড়ে নিচ্ছে। এই ফুল দেখতে দেখতে আমরা পৌঁছে গেলাম ভুটানের অন্যতম উঁচু পাস দোচুলা পাসে। গাড়ি থেকে নেমে প্রথমে চোখে পড়লো বরফে ঢাকা দূরের পর্বতগুলোতে। এখানে বেশ সুন্দর করে একটা পার্ক বানানো হয়েছে যেখানে ১৬টি গুহা রয়েছে ধ্যান করার জন্য আর পার্কজুড়ে রয়েছে রোডোডেনড্রন গাছ, পার্কের পাশেই নির্মাণ করা হয়েছে ১০৮ স্তুপা। এই স্তুপাগুলো নির্মাণ করার পিছনে বেশ ভালো গল্প রয়েছে আপাততে সেই দিকে নাই যায় তবে জায়গাটা ছবি তোলার জন্য বেশ ভালো। আমরা বেশ কিছুক্ষণ ঘুরেটুরে রওনা দিলাম পুনাকার দিকে, অল্প সময়ের মধ্য পৌঁছেও গেলাম। দোচুলা পাস থেকে বেশী সময় লাগলো না হয়ত চারপাশের সৌন্দর্য দেখতে দেখতে সময়টা কম মনে হয়েছে। পুনাকাতে পৌঁছে সোজা চলে গেলাম ঝুলন্ত ব্রিজ দেখতে, ভুটানে যারাই ঘুরতে আসে সবাই এখানে আসে, বেশ লম্বা ঝুলন্ত ব্রিজটা দেখা শেষ করে সোজা চলে আসলাম হোটেলে।
পুনাকাতে আসার আরেকটা কারণ পুবজিকা ভ্যালি। পরের দিন সকালের নাস্তা সেরে রওনা দিলাম পুবজিকা ভ্যালির দিকে। আবারও আমাদের গাড়ি রওনা দিলো পাহাড়ের আঁকাবাঁকা রাস্তা ধরে, এই রাস্তায়ও রোডোডেনড্রন গাছের আধিক্য। আমরা উঁচু থেকে আরো উঁচুতে উঠছি, ঠান্ডার মাত্রাও বাড়ছে, কিছুদূর পরপর খুব সুন্দর সাজানো গোছানো চায়ের দোকানগুলোও আপনাকে আহ্বান জানাবে শরীরটা উষ্ণ করার জন্য চা পান করতে। ঘন্টাখানেক পর এই পথে আমাদের সঙ্গী হলো হিমালয়ের পর্বতগুলো, একদিকে বরফে ঢাকা সাদা পর্বত অন্যদিকে লাল রোডোডেনড্রন ফুল আর এসব দৃশ্য নিয়ে আপনি যখন ছুটে চলবেন পাহাড়ের আঁকাবাঁকা পথ দিয়ে তখন আপনি বাধ্য হবেন Louis Armstrong এর গলার সাথে গলা মিলিয়ে গেয়ে উঠতে “What a wonderful world”। অনেক উঁচুতে উঠার পর এবার আমরা নিচে নামতে শুরু করলাম, নিচের দিকে নামতে নামতে দূর থেকে দেখা মিলল একটা গ্রামের, এটাই পুবজিকা ভ্যালি। দুই পাশে উচুঁ উঁচু পর্বত, পর্বতের ঢাল বেয়ে বেয়ে দাঁড়িয়ে থাকা পাইন–উক গাছগুলো যে জায়গায় এসে থেমে গেছে সেখান থেকে শুরু সবুজ ঘাসের, এটা দেখে মনে হবে প্রকৃতির উপরে কোন শিল্পী নাই। ক্যালেন্ডারে আমরা যেরকম ভ্যালির ছবি দেখতে অভ্যস্ত এটা যেনো সেরকম। এই ভ্যালিতে যারা বসবাস করে তারাও এমনভাবে বাস করছে যেনো এই প্রকৃতি বিরক্ত না হয়। বেশ কিছুক্ষণ সময় কাটিয়ে ফেরার মত পথ ধরলাম, যদি কখনো সময়–সুযোগ তাহলে আবার আসবো নিজেকে সে আশ্বাস দিয়ে।