সরকারি চাকরিতে কোটা আন্দোলনের মধ্যে নজিরবিহীন সহিংসতার পর অর্থনীতি নিয়ে তৈরি হওয়া নতুন উদ্বেগের পাশাপাশি ও ইন্টারনেট সীমিত করার প্রভাব পড়েছে পুঁজিবাজারে। গত রোববার থেকে মঙ্গলবার পর্যন্ত সাধারণ ছুটি ঘোষণার পর গতকাল বুধবার পুঁজিবাজার খুললেও তাতে ব্রোকারেজ হাউজগুলোতে উপস্থিতি ছিল কম, মোবাইল ইন্টারনেট না থাকায় অ্যাপে যোগাযোগ করার সুযোগও ছিল না। বাসাবাড়িতে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট না থাকায় বিনিয়োগকারীরা শেয়ার দরের উত্থান পতন দেখে ক্রয় বা বিক্রয়ের আদেশ দেওয়ার সুযোগও পাননি। এর প্রভাবে লেনদেন তলানিতে নেমেছে। হাতবদল হওয়া কোম্পানিগুলোর মধ্যে আড়াইশটিরও বেশির দর কমেছে পতনের সর্বোচ্চ সীমা বা সার্কিট ব্রেকার ছুঁয়ে। হাতবদল হওয়া ৩৮৯টি কোম্পানির মধ্যে দর বাড়ে কেবল ২৫টির, আগের দিনের দরে লেনদেন হয় ১৭টির, কমেছে বাকি ৩৪৭টির দর, এর মধ্যে ২টির দরই কমেছে ২ শতাংশ বা তার বেশি। খবর বিডিনিউজের।
নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির সিদ্ধান্তে এখন দরপতনের সর্বোচ্চ সীমা ৩ শতাংশ, এর মধ্যেও ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ বা ডিএসই প্রধান সূচক ডিএসইএঙ এর ৯৫ পয়েন্ট বা এক দশমিক ৭৫ শতাংশ পতন ঘটেছে। দিন শেষে প্রধান সূচক দাঁড়ায় ৫ হাজার ৩৫০ পয়েন্টে। আগের দিন লেনদেন শেষ করেছিল ৫ হাজার ৪৪৬ পয়েন্টে। দিনভর লেনদেন হয়েছে ১৫৯ কোটি ৩৭ লাখ টাকা যা গত দেড় বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। ২০২৩ সালের ২ জানুয়ারি ১৪৬ কোটি ৫১ লাখ টাকার শেয়ার হাতবদল হয়েছিল।
সকাল ১০টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত কারফিউ শিথিলের মধ্যে ব্যাংক–বীমা থেকে শুরু করে অফিস সময় ছিল সকাল ১১টা থেকে বেলা ৩টা পর্যন্ত। পুঁজিবাজার খোলা ছিল ১১টা থেকে ২টা পর্যন্ত, তবে শেয়ার কেনা–বেচা হয়েছে ১টা ৫০ মিনিট পর্যন্ত। সামগ্রিক পরিস্থিতি নিয়ে পুঁজিবাজারে যে শঙ্কা ছিল, তার প্রভাব দেখা যায় লেনদেনের শুরতেই। প্রথম তিন মিনিটেই সূচক পড়ে যায় ৪৫ পয়েন্ট। স্পষ্ট হয় বিনিয়োগকারীরা এক ধরনের শঙ্কার মধ্যে আছেন। পড়তি বাজারে সুযোগ নিয়ে শেয়ার কেনার মত সুযোগ না থাকায় এই পতন কেবল বাড়তেই থাকে।
বিক্রয় চাপ বাড়তে থাকলে বেলা ১২ টা ৫৫ মিনিটে সূচক হারিয়ে ফেলে ১০৮ পয়েন্ট। এর পর সেখান থেকে ১৩ পয়েন্ট উদ্ধার হয়। সবচেয়ে বেশি ২৪ শতাংশ লেনদেন হয়েছে ওষুধ ও রসায়ন খাতে। তবে ৩টির দর বেড়ে কমেছে ৩১টির দর। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ১৩ শতাংশ লেনদেন হয়েছে ব্যাংক খাতে। দীর্ঘদিন পর এই খাতটিকে আগ্রহ দেখা গেল। এই খাতের ৩৬টি কোম্পানির মধ্যে চারটির দর বেড়েছে, কমেছে ২৮টির। বাকি ৪টি ছিল আগের দিনের দরে। তবে ব্যাংক খাতে দর হারানোর হার খুব একটা বেশি ছিল না। তৃতীয় অবস্থানে ছিল খাদ্য ও আনুষঙ্গিক খাত, মোট লেনদেনের প্রায় ১৩ শতাংশ ছিল এই খাতে। এই খাতের দুটির দর বেড়েছে, কমেছে ১৯টির।
দর বৃদ্ধির সর্বোচ্চ সীমা বা সার্কিট ব্রেকার ছুঁয়ে হাতবদল হয়েছে নতুন তালিকাভুক্ত টেকনো ড্রাগস লিমিটেড। আগের কার্যদিবসের তুলনায় ৩ টাকা ৫০ পয়সা বেড়ে সবশেষ লেনদেন হয় ৩৮ টাকা ৫০ পয়সা। তবে হাতবদল হয়েছে কেবল ৪ হাজার ১২১টি শেয়ার। দর বৃদ্ধির দ্বিতীয় স্থানে উঠেছে লিব্রা ইনফিউশনস, বেড়েছে ৬ দশমিক ৭৪ শতাংশ। পরের অবস্থানে ছিল রংপুর ফাউন্ড্রি ও সিলকো ফার্মা। এদিন কেবল ১২টি কোম্পানির দর ১ শতাংশের বেশি বেড়েছে।
দরপতনের শীর্ষে ছিল জনতা ইন্স্যুরেন্স ও কোহিনুর কেমিকেলস, যে দুটির দর ৩ শতাংশ করে কমেছে। তবে ভগ্নাংশের হিসাবে কিছুটা কম কমেছে মুন্নু অ্যাগ্রো, ওয়ালটন হাইটেক, লিনডে বিডি, সমতা লেদার, রূপালী লাইফ, সোনালী লাইফ, এপেঙ ফুডস, মোজাফফর হোসেন স্পিনিং মিলস।
যা বলছেন বাজার সংশ্লিষ্টরা : আইএফআইসি ব্যাংক সিকিউরিটিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাকসুদুর রহমান বলেন, লেনদেন সময় তো দেড় ঘণ্টা কমানো হয়েছে। বিনিয়োগকারীরাও আসেনি খুব একটা। তারা আসলে সূচক পড়লেও লেনদেন বাড়ত। আতঙ্কের মধ্যে যারা এসেছেন, তারাও যানজটের কারণে বাজার খোলার এক থেকে দেড় ঘণ্টা পরে পৌঁছেছেন। পতন দেখে অনেকেই শেয়ার কেনাবেচা করেনি। এতেও প্রভাব পড়েছে বাজারে।
লেনদেন কমার আরেকটি কারণ হিসেবে উঠে এসেছে ইন্টারনেটের ধীরগতি। ডিএসই ব্রোকার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ডিবিএ) সভাপতি সাইফুল ইসলাম বলেন, নেট তো খুবই স্লো গিয়েছে। সেটেলমেন্ট (নিষ্পত্তি) হতে অনেক সময় লেগেছে। এমনিতে সময় কম ছিল, তারপরে নেট স্লো তাই লেনদেন কম হয়েছে। মানুষ গত কয়েকদিন তো আটকা ছিল। কারফিউ শিথিল করায় নানা প্রয়োজন মেটাতে শুরু করেছেন। কারফিউ না উঠানো পর্যন্ত স্বাভাবিক সময়ের লেনদেনে ফেরা কঠিন হতে পারে।
বিনিয়োগকারী নজরুল ইসলাম বলেন, কারফিউতে হাতে থাকা টাকা শেষ। কিছু লাভের শেয়ার ছিল, ভাবছিলাম বিক্রি করব। যেভাবে দরপতন হল, তাতে বিক্রি না করে অপেক্ষার করার সিদ্ধান্ত নিলাম। আজ কোনো কেনা–বেচাই করিনি।
পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন, বিএসইসির চেয়ারম্যান শিবলী রুবাইয়াত–উল–ইসলাম বলেন, কারফিউর মধ্যে বাজারে আসেননি অনেকে। তারা মোবাইলেও লেনদেন করতে পারেননি। রাত থেকে মোবাইল ডেটা সচল হবে আশা করছি। তখন শেয়ার কেনা–বেচা বাড়বে।