সিরিয়ার বিদ্রোহী কারা,কেন এই যুদ্ধ

আসাদকে দেশছাড়া করার নেপথ্যে কে এই জুলানি

| সোমবার , ৯ ডিসেম্বর, ২০২৪ at ৬:৪০ পূর্বাহ্ণ

পনের দিনেরও কম সময়ে। এর মধ্যেই বিস্ময়করভাবেই দৃশ্যপটে সিরিয়ার বিদ্রোহী বাহিনী। একে একে চারটি মূল শহর দখলের পর অনেকটা বিনাযুদ্ধেই রাজধানী দামেস্কের দখল নিয়েছে তারা। বিদ্রোহী বাহিনীর অগ্রগতির মধ্যেই দেশ ছেড়ে অজ্ঞাত স্থানে পালিয়ে গেছেন দেশটির প্রেসিডেন্ট বাশার আলআসাদ। এর মধ্যে দিয়ে আসাদ পরিবারের দীর্ঘদিনের লৌহকঠিন শাসনের অবসান ঘটল বলে ধারণা করা হচ্ছে।

সিরিয়ার বিদ্রোহী বাহিনী নভেম্বরের শেষ দিকে উত্তরাঞ্চলীয় শহর আলেপ্পোর নিয়ন্ত্রণ নেয়, এরপর একে একে আরো দুটি গুরুত্বপূর্ণ শহর হামা ও হোম বিদ্রোহীদের কব্জায় চলে আসে। তিনটি শহরই সরকারি বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে ছিল। অন্যদিকে সিরিয়ার দক্ষিণাঞ্চলে জর্ডান সীমান্তের কাছে স্থানীয় বিদ্রোহীরা দেরা অঞ্চলের দখল নেয়। আসাদবিরোধী বিদ্রোহের জন্ম হয়েছিল এই অঞ্চল থেকেই। বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে দাবি করা হয়েছে, বিদ্রোহীদের অভিযানের মুখে বেশিরভাগ স্থানেই সরকারি বাহিনী তাদের অবস্থান ছেড়ে চলে গেছে নয়ত বিদ্রোহীদের সঙ্গে যোগ দিয়েছে। খবর বিডিনিউজের।

বিদ্রোহীদের নতুন এই অভিযানের প্রাথমিক নেতৃত্ব দিয়েছে ইসলামি জঙ্গি সংগঠন হায়াত তাহরির আলশাম (এইচটিএস), যাদের সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে লড়াই করার লম্বা ইতিহাস রয়েছে। এইচটিএসকে এর আগে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে ঘোষণা করেছিল জাতিসংঘ, যুক্তরাষ্ট্র, তুরস্ক এবং আরো কয়েকটি দেশ।

হায়াত তাহরির আলশাম কারা : এইচটিএসের জন্ম ২০১১ সালে, জাবহাত আলনুসরা নামে, যাদের সরাসরি সংযোগ ছিল আল কায়েদার সঙ্গে। জঙ্গি গোষ্ঠী ইসলামিক স্টেটের (আইএস) স্বঘোষিত নেতা আবু বকর আলবাগদাদি জড়িত ছিলেন সংগঠনটির প্রতিষ্ঠায়। বাশাল আলআসাদ বিরোধী সংঘাতে জাবহাত আলনুসরাকে সবচেয়ে কার্যকর এবং ভয়ঙ্কর সংগঠন হিসেবে মনে করা হয়। কিন্তু একটা সময় বিপ্লবী ভূমিকার চেয়ে এর জিহাদী মতাদর্শে পরিচালিত হতে থাকে সংগঠনটি। আর এটিই পরে ‘ফ্রি সিরিয়া’ ব্যানারে থাকা বিদ্রোহীদের সঙ্গে মতবিরোধের কারণ হয়ে উঠে।

২০১৬ সালে সংগঠনটির নেতা আবু মোহামেদ আলজুলানি প্রকাশ্যে আল কায়েদার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন এবং জাবহাত আলনুসরা বিলুপ্ত করেন। পরে তিনি নতুন সংগঠন গড়ে তোলেন, যেটি এক বছর সমমনা আরো কয়েকটি বিদ্রোহী দলে সঙ্গে একীভূত হয়। বিদ্রোহীদের এই জোটই হায়াত তাহরির আলশাম নামে পরিচিত। আমেরিকা ‘সন্ত্রাসবাদী’ বলে আলজুলানিকে চিহ্নিত করেছিল ২০১৮ সালে। তার মাথার দাম ধার্য করেছিল এক কোটি ডলার। এইচটিএসকেও ‘বিদেশি সন্ত্রাসবাদী সংগঠন’ ঘোষণা করেছিল। পরে আমেরিকার সংবাদমাধ্যমে তিনিই দাবি করেছিলেন, নিরীহদের খুনকে তিনি কখনওই সমর্থন করেন না। সেই জুলানির বাহিনী এখন দখল নিয়েছে সিরিয়ার রাজধানী দামেস্কের।

এইচটিএস কিছুদিনের জন্য সিরিয়ার উত্তরপশ্চিমাঞ্চলীয় প্রদেশ ইদলিবে ঘাঁটি গেড়ে কার্যত নিজেদের শাসন চালু করেছিল। কিন্তু সেখানে তাদের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ ওঠায় সেই শাসনের আইনি বৈধতা নিয়ে পরে প্রশ্ন দেখা দেয়। তাছাড়া ইদলিবে এই বিদ্রোহী জোটের অন্য কয়েকটি দলের সঙ্গে সংঘাতে জড়ানোর অভিযোগও রয়েছে। আল কায়েদার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করার পর থেকে এইচটিএসের এর লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায় সিরিয়ায় বৃহত্তর খিলাফতের পরিবর্তে মৌলবাদী ইসলামিক শাসন প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করা। আইএসও একই চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছে। সিরিয়ার সংঘাতকে বড় রূপ দেওয়া এবং দেশের বেশিরভাগ অংশে আসাদের শাসনকে চ্যালেঞ্জ করার মতো উদ্যোগ খুব কমই নিতে দেখা গেছে এইচটিএসকে।

কেন এই যুদ্ধ : প্রতিবেশী কয়েকটি দেশের শাসকদের বিরুদ্ধে বিক্ষোভের অনুপ্রেরণায় সিরিয়ায়তেও গণতন্ত্রপন্থি আন্দোলনের সূত্রপাত ২০১১ সালে দক্ষিণাঞ্চলীয় শহর দেরায়। সেই বিক্ষোভ দমনে সরকারি বাহিনী কঠোর শক্তিপ্রয়োগ করলে প্রেসিডেন্টের পদত্যাগের দাবি ছড়িয়ে পরে দেশজুড়ে। তারপরও হাল ছাড়েনি আসাদ বাহিনী। বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে সরকারি বাহিনীর দমনও বাড়তে থাকে। প্রথম আত্মরক্ষার বাধ্য হয়েই অস্ত্র হাতে তুলে নেন বিরোধী সমর্থকরা। পরে তাদের লক্ষ্য হয় সরকারি বাহিনীর হাত থেকে নিজেদের এলাকা মুক্ত করা। প্রেসিডেন্ট আসাদ বিদ্রোহীদেরকে ‘বিদেশিসমর্থিত সন্ত্রাসবাদ’ আখ্যায়িত করেছেন তাদের কঠোর হাতে দমনের অঙ্গীকার করেন। ধীরে ধীরে সরকারি বাহিনীর বিরুদ্ধে শত শত বিদ্রোহী উপদল গড়ে ওঠে। বিভিন্ন বিদেশী শক্তিও এসব উপদলের পক্ষ নিতে শুরু করে এবং আইএস ও আলকায়েদার মতো চরমপন্থী জিহাদি সংগঠনগুলো সিরিয়ার সংঘাতে জড়িত পড়ে। ধীরে সহিংসতা বাড়তে থাকলে একটা পর্যায়ে পুরোপুরি গৃহযুদ্ধের মধ্যে ঢুকে যায় দেশটি, যা আঞ্চলিক এবং আন্তর্জাতিক মনোযোগের কারণে হয়ে দাঁড়ায়। সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে এ পর্যন্ত ৫ লাখ মানুষের মৃত্যু এবং এক কোটি ২০ লাখ মানুষ ঘরবাড়ি হারিয়েছে। গৃহযুদ্ধের কারণে সিরিয়ার ৫০ লাখ মানুষ দেশ ছেড়ে অন্য দেশে আশ্রয়প্রার্থী হয়েছে।

সমপ্রতি লেবাননে ইসরায়েলের আক্রমণে হিজবুল্লাহর শক্তিক্ষয়, সিরিয়ায় ইরানের সামরিক কমান্ডারদের ওপর ইসরায়েলি হামলা যে ইদলিবের বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোকে আলেপ্পোতে আকস্মিক হামলা চালাতে উৎসাহ জুগিয়েছে, তাতে খুব একটা সন্দেহ নেই। গত কয়েক মাসে ইসরায়েল ইরান সমর্থিত সশস্ত্র দলগুলো এবং তাদের সরবরাহ ব্যবস্থার ওপর হামলা জোরদার করেছে। ইসরায়েলের এসব হামলায় সিরিয়ায় হিজবুল্লাহসহ মিলিশিয়াদের নেটওয়ার্ক মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বলাই বাহুল্য, এতে প্রেসিডেন্ট আসাদের বাহিনীর দুর্বলতাও প্রকাশ হয়ে পড়েছে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধপালিয়ে মস্কোয় আশ্রয় নিলেন আসাদ
পরবর্তী নিবন্ধচোখের ডাক্তার থেকে কর্তৃত্ববাদী প্রেসিডেন্ট