রমজানকে সামনে রেখে ছোলা, চিনি, তেল, ডালসহ নিত্য প্রয়োজনীয় ছয়টি পণ্যের আমদানি স্বাভাবিকের চেয়ে বেড়েছে। নানা দেশ থেকে প্রচুর পণ্য আমদানি হয়েছে। দেশেও উৎপাদিত হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাজারে বিপুল পরিমাণ পণ্য আছে। তাই আসন্ন রমজানে কোনো পণ্যের সংকটের আশঙ্কা নেই। তেল নিয়ে কিছুটা তেলেসমাতি ঘটে গেলেও আসন্ন রমজানে বাজার পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে থাকবে বলে আশা করছেন তারা। কোনো ধরনের সিন্ডিকেট হলে জেলা প্রশাসনের পাশাপাশি বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও প্রধানমন্ত্রীর দফতর থেকে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
আর মাত্র ২৪ দিন পর শুরু হচ্ছে রমজান। করোনায় শঙ্কা থাকলেও বেশি আলোচনা হচ্ছে জিনিসপত্রের দাম নিয়ে। বাজারে এখন জিনিসপত্রের দাম বাড়তি। বিশ্ববাজারের দোহাই দিয়ে নানাভাবে দাম বাড়ানো হয়েছে। রমজানকে সামনে রেখে জিনিসপত্রের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে আবারও দাম বাড়ানো হচ্ছে কিনা তা নিয়ে শঙ্কা দেখা দিয়েছে।
তবে জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মমিনুর রহমান বলেছেন, কোনো ধরনের সংকট নেই। সব পণ্যই বিপুল পরিমাণে বাজারে রয়েছে। আমরা নিয়মিত বাজার মনিটরিং করছি। অ্যাকশন প্ল্যান তৈরি করেছি। টিম প্রস্তুত করেছি। দিনক্ষণও ঠিক করেছি। রমজানকে সামনে রেখে আগামী কয়েকদিনের মধ্যে বাজারে বড় পরিসরে সাঁড়াশি অভিযান পরিচালিত হবে। আমরা শুধু বাজার মনিটরিং নয়, নিয়ন্ত্রণও করব। কাউকে সিন্ডিকেট করার সুযোগ দেওয়া হবে না। বাজার নিয়ে কারসাজি করার কোনো সুযোগ নেই। একটি গোয়েন্দা সংস্থার শীর্ষ একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে গতকাল আজাদীকে বলেন, করোনার উদ্বেগ থাকলেও বাজার নিয়ে উদ্বেগের কিছু নেই। দেশে প্রচুর পণ্য রয়েছে। বিভিন্ন দেশ থেকে অনেক পণ্য আসছে। তাই বাজার নিয়ে সংকট সৃষ্টির সুযোগ নেই।
তিনি বলেন, চট্টগ্রামে জেলা প্রশাসন বাজার মনিটরিং করবে। এর পাশাপাশি বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এবং প্রধানমন্ত্রীর দফতর থেকেও বিশেষ নজরদারি থাকবে। গোয়েন্দা সংস্থাগুলোও মাঠে থাকবে। কোথাও সংকট সৃষ্টির চেষ্টা করা হলে কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হবে।
চাক্তাই ও খাতুনগঞ্জের একাধিক ব্যবসায়ী গতকাল জানান, রমজানে ভোজ্যতেল, চিনি, ডাল, ছোলা, পেঁয়াজ ও খেজুর-এই ছয়টি পণ্যই মূলত বেশি ব্যবহার হয়। এই ছয় পণ্যের আমদানি স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় অনেক বেড়েছে।
জানা যায়, দেশে ১৫ লাখ টন ভোজ্যতেল লাগে। প্রতি মাসে গড়ে ১ লাখ ১০ হাজার টন সয়াবিন ও পাম অয়েল লাগলেও রমজানে লাগে প্রায় আড়াই লাখ টন। বছরে ৮ থেকে সাড়ে ৮ লাখ টন ভোজ্যতেল আমদানি হয়। ৭ থেকে ৮ লাখ টন সরিষা দেশে উৎপাদিত হয়। চলতি বছর প্রায় ৯ লাখ টন ভোজ্যতেল আমদানি হয়েছে। পাইপ লাইনে ১ লাখ টন তেল রয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশে তেলের সংকটের আশঙ্কা নেই। বাজার নিয়ে একটি মহলের কারসাজি চলে। সাম্প্রতিক সময়ে চক্রটি তৎপরতা চালিয়েছে। তবে রমজানকে সামনে নিয়ে নতুন করে যাতে সংকট তৈরি করতে না পারে সেজন্য সরকার সজাগ রয়েছে।
রমজানে পেঁয়াজ বেশি ব্যবহার করা হয়। পেঁয়াজের বাজার অতীতে ভারত-নির্ভর ছিল। এখন বিভিন্ন উৎস থেকে আসছে। দেশীয় পেঁয়াজও রয়েছে বাজারে। দেশে বছরে ২২ লাখ টন পেঁয়াজ লাগে। শুধু রমজানে তিন লাখ টন পেঁয়াজ লাগে। এবার পেঁয়াজের প্রচুর মজুদ রয়েছে। বিকল্প নানা উৎস থাকায় পেঁয়াজের বাজার নিয়ে কারসাজি করার সুযোগ কেউ পাবে না।
দেশে বছরে প্রায় ২০ লাখ টন চিনির চাহিদা রয়েছে উল্লেখ করে সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলেছে, রোজার মাসে তিন লাখ টন চিনি লাগে। সরকারি চিনিকলগুলোতে প্রচুর চিনি রয়েছে। আমদানিও হয়েছে প্রচুর। সাম্প্রতিক মাসগুলোতে ৫ লাখ টন চিনি আমদানির রেকর্ড রয়েছে চট্টগ্রাম কাস্টমসে। এই চিনির একটি বড় অংশ বাজার ও বিভিন্ন বেসরকারি চিনিকলে মজুদ রয়েছে। রমজানে যাতে এগুলো নির্ঝঞ্ঝাটে বাজারে আসে সেদিকে সরকার সজাগ রয়েছে। প্রয়োজনের তুলনায় বেশি চিনি বাজারে রয়েছে উল্লেখ করে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চিনি নিয়ে কারসাজির শঙ্কা নেই।
দেশে প্রয়োজনের তুলনায় বেশি ডালের মজুদ রয়েছে উল্লেখ করে সূত্রটি জানায়, রমজানের সময় ৬০ হাজার টন ডাল লাগে। সাম্প্রতিক মাসগুলোতে চট্টগ্রাম কাস্টমস দিয়ে তিন লাখ টন ডাল (মটর, মশুর ও মুগ) আমদানি হয়েছে। এতে করে ডালের মজুদ চাহিদার চেয়ে অনেক বেশি রয়েছে।
রমজানকে সামনে রেখে ছোলা আমদানি বেড়েছে। পুরো বছরে ১ লাখ টন ছোলা ব্যবহৃত হয়। শুধু রমজানে চাহিদা প্রায় ৮০ হাজার টন। দেশে মাত্র ৭ হাজার টন ছোলা উৎপাদিত হয়। বাকিটা আমদানি করতে হয়। এবার রমজানকে সামনে রেখে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে অন্তত দেড় লাখ টন ছোলা আমদানি হয়েছে। চাহিদার দ্বিগুণ ছোলা মজুদ রয়েছে।
এদিকে, বছরে ২০ হাজার টন খেজুরের চাহিদা রয়েছে। তবে রমজানে ব্যবহার হয় প্রায় ১৮ হাজার টন। রমজানকে সামনে রেখে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে প্রচুর খেজুর আমদানি হয়েছে। গত বছরের খেজুরও রয়েছে। সবকিছু মিলে চাহিদার চেয়ে বেশি খেজুর মজুদ রয়েছে। তাই খেজুর নিয়ে সংকটের শঙ্কা নেই।
চাক্তাই খাতুনগঞ্জের শীর্ষ আমদানিকারকরা গতকাল আজাদীকে বলেন, প্রয়োজনীয় পণ্য মজুদ রয়েছে। তাই সংকটের আশঙ্কা নেই।
চট্টগ্রাম চেম্বার প্রেসিডেন্ট মাহবুবুল আলম বলেন, রমজানকে সামনে রেখে কোনো ধরনের কারসাজি হবে না। প্রচুর পণ্য মজুদ রয়েছে। বিশ্বের নানা দেশ থেকে প্রচুর পণ্য আমদানি হচ্ছে। পাইপ লাইনেও রয়েছে। করোনাকালে ঝুঁকি নিয়েও ব্যবসায়ীদের আগাম প্রস্তুতি প্রশংসার দাবিদার। পণ্যমূল্য নিয়ে কারসাজি হবে না উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমরা ব্যবসায়ীদের সাথে কথা বলেছি। আরো কথা বলব। প্রশাসনের সাথেও যোগাযোগ রয়েছে। নিয়মিত বাজার মনিটরিং করা হচ্ছে। এসব উদ্যোগের সুফল মিলবে।