স্মৃতির শহর চট্টগ্রামের সিনেমার কথা ভাবতে গেলে পরাণের গহীণ ভিতরে আনন্দ, স্নেহ আর ভালোবাসা মিশ্রিত এক ভিন্নরকম অনুভূতির সৃষ্টি হয়। সিনেমা হারিয়ে গেছে আমার স্মৃতির শহর চট্টগ্রাম থেকে। চট্টগ্রামে সিনেমা হলের নামের কারণে অনেক রাস্তার নামও পরিবর্তন হয়ে যায়। যেমন চট্টগ্রাম নগরীর চকবাজার এলাকার গুলজার মোড়। এ নাম কেউ রাখেনি। সিনেমাপ্রেমিরা বলতে বলতে প্রচলন হয় এ নাম। ঠিক এমনই করে নামকরণ হয়েছে সিনেমা প্যালেস মোড়, আলমাস সিনেমার মোড়, লায়ন সিনেমার মোড়, খুরশীদমহল সিনেমার মোড়। খুরশীদমহল সিনেমার হলের মোড়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল চট্টগ্রামের প্রথম শহীদ মিনার ১৯৫২ সালের ২৩ ফ্রেবু্রয়ারি।
আমার প্রথম দেখা সিনেমার নাম ‘অশিক্ষিত’। এখনও আনমনে গেয়ে উঠি ‘অশিক্ষিত’ সিনেমার সে গান–‘লাল– লাল, নীল–নীল বাতি দেইখ্যা নয়ন জুরাইছে। ঢাকা শহর আইশা আমার আশা ফুরাইছে।’ ১৯৭৮ সালে ‘অশিক্ষিত’ সিনেমা দেখতে গিয়েছিলাম মায়ের হাত ধরে। রাজ্জাক, অঞ্জনা অভিনীত আংশিক রঙিন সিনেমাটা দেখেছিলাম লায়ন সিনেমায়। ১৯২৬ সালে প্রতিষ্ঠিত সদরঘাটের লায়ন সিনেমা চট্টগ্রামের প্রাচীনতম হল। এর আগে লায়ন সিনেমা কমলাকান্ত থিয়েটার হল নামে পরিচিত ছিল। চট্টগ্রামের বিখ্যাত ধনাঢ্য ব্যক্তি কমলাকান্ত সেন ছিলেন এ হলের মালিক। তৎকালীন সময়ে কোলকাতার বাইরে এটাই ছিল সবচেয়ে বড় হল। পরে বিশ্বম্ভর পাল এটা কিনলে নাম হয় বিশ্বম্ভর হল। তাঁর কাছ থেকে ঢাকার লায়ন থিয়েটারর মালিক মির্জা আবদুল ক্রয় করলে নাম হয় লায়ন সিনেমা।
লায়ন সিনেমায় আবার যাই ১৯৮০ সালে। আমার অধ্যাপক কাকা সরোজ বল পাঠিয়েছিলেন ছুটির ঘণ্টা সিনেমা দেখার জন্য। সঙ্গে ছিল আমার জেঠতুত ভাই। ছুটির ঘণ্টা ছিল একটি শিশুতোষ চলচ্চিত্র। ছবিটি পরিচালনা করেছেন আজিজুর রহমান। ছবির মূল ভূমিকায় অভিনয় করেছে শিশু শিল্পী সুমন ও অন্যান্য চরিত্রে নায়করাজ রাজ্জাক, শাবানা, সুজাতা, শওকত আকবর এবং এ টি এম শামসুজ্জামান। জাদু শিল্পী জুয়েল আইচ অভিনয় করেছিলেন। শৈশবে দেখা ছুটির ঘণ্টা সিনেমা মনে ভীষণ দাগ কেটে ছিল।
নিউ মার্কেটের উল্টো দিকে জুবলি রোডে ছিল জলসা সিনেমা। ওখানে দেখেছি ‘জীবন থেকে নেয়া’, ‘আগুনের পরশমনি’ সিনেমা। দুটোই ছিল মুক্তিযুদ্ধের প্রেরণা সঞ্চারি সিনেমা। ‘জীবন থেকে নেয়া’ সিনেমাটি দেখার জন্য টাকা দিয়েছিলেন আমার কাকিমা।
আগ্রাবাদ বনানী কমপ্লেঙে দেখতে গিয়েছিলাম ‘পদ্মা নদীর মাঝি’। ওটাই ছিল সিনেমা হলে গিয়ে সর্বশেষ সিনেমা দেখা। পদ্মানদীর মাঝি ১৯৯৩ সালের একটি বাংলা ভাষায় নির্মিত বাংলাদেশ এবং ভারতের যৌথভাবে নির্মিত চলচ্চিত্র। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাস অবলম্বনে গৌতম ঘোষ চলচ্চিত্রটি নির্মাণ করেন। এতে অভিনয় করেন– রাইসুল ইসলাম আসাদ, চম্পা, রূপা গঙ্গোপাধ্যায়, উৎপল দত্ত প্রমুখ। এ সিনেমা দেখার পর অনেকদিন কাউকে আসতে দেখলে বলতাম,‘আইলা মাঝি।’ এটা ছিল আসাদের উদ্দেশে রূপা গাঙ্গুলীর সংলাপ।
বনানী কমপ্লেঙ নিয়ে তখন অনেক রকমের গল্প চালু ছিল। সিনেমার পর্দাটা অনেক বড়। খুবই আধুনিক পর্দা। ছোঁয়া যায় না খালি হাতে। পয়সা ছুড়ে মারলে পর্দায় আগুন ধরে যেতে পারে। এ কারণে সামনের সারিতে যারা বসত তাদের পকেট চেক করত। পয়সা থাকলে নিয়ে নেওয়া হতো। ‘পদ্মা নদীর মাঝি’ যখন দেখতে গিয়েছি, এমন কোনো ঘটনাই চোখে পড়েনি। তখন বাংলাদেশের বৃহত্তম সিনেমা হল ছিল বনানী কমপ্লেঙ।
চট্টগ্রামে দ্বিতীয় প্রাচীন সিনেমা হলটির নাম হলো রঙ্গম সিনেমা হল প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৩৮ সালে। রঙ্গম সিনেমা হলের পূর্ব নাম ছিল লোটাস, জুবিলি ও নিরালা। রঙ্গম সিনেমার মালিক জহিরুল ইসলাম ছুট্টু সাহেব। চিরকালই লোকটা আমার কাছে রহস্যময় পুরুষ মনে হয়েছে। ‘মুখ ও মুখোশ’ পূর্ব পাকিস্তানে নির্মিত প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য সবাক চলচ্চিত্র। এটি চট্টগ্রামে রঙ্গম সিনেমা হলে মুক্তি পায়। তখন রঙ্গম সিনেমা হলের নাম ছিল নিরালা।
রঙ্গম সিনেমার দু’বছর পর প্রতিষ্ঠিত হয় সিনেমা প্যালেস। চট্টগ্রামে প্রথম শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত সিনেমা হল আলমাস। গত শতকের ষাট দশকের শেষ ভাগে প্রতিষ্ঠিত হয়। এছাড়াও ছিল–নুপুর, উপহার, ঝুমুর, উজালা, সাগরিকা, সানাই, কর্ণফুলী, আকাশ, মহল, অলংকার,সংগীত, গুলশান, রিদম, খুরশীদ মহল, দিনার, মেলোডি সিনেমা হল। মেলোডি আর দিনার হলে শুধু ইংলিশ সিনেমা চলত। এক সময় রবিবার মর্নিং শোতে ইংরেজি সিনেমা চলত। এছাড়াও আছে টাইগার পাশে নৌবাহিনীর সিনেমা হল, বন্দরে নেভি হল, পতেঙ্গায় বিমান বাহিনীর শাহীন হল, হালিশহরে বিডি আর হল, চট্টগ্রাম সেনানিবাসে গ্যারিসন সিনেমা হল। এসব হলেও নিয়মিত সিনেমা প্রদর্শিত হতো। ১৯৯৫ সালে সিনেমা হলের টিকেটের সর্বোচ্চ মূল্য ছিল ত্রিশ টাকা। ১৯৭০ সালে ছিল মাত্র ছয় টাকা। চট্টগ্রামে একসময় ৩৫টির অধিক সিনেমা হল ছিল।
চট্টগ্রামের মানুষের সিনেমার প্রতি ভালোবাসাটা একটু বেশিই ছিল। এদেশের প্রথম চলচ্চিত্র বিষয়ক পত্রিকা ‘উদয়ন’ চট্টগ্রাম থেকে ১৯৫০ সালে প্রকাশিত হয়। চট্টগ্রামে এফডিসি’র মতো একটা পূর্ণাঙ্গ চলচ্চিত্র স্টুডিও নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল ১৯৫৩ সালে। পাকিস্তান সরকারের অসহযোগিতার কারণে ব্যবসায়ী তারিক আহমদ চৌধুরীর এ উদ্যোগ সফল হয়নি। চট্টগ্রামের ধীরা চৌধুরী ভারতের মাদ্রাজে পূর্ণাঙ্গ চলচ্চিত্র স্টুডিও নির্মাণ করে খ্যাতি লাভ করেছেন।
দেশভাগের আগে ১৯৪৬ সালে চট্টগ্রামের নীরেন্দ্রনাথ সেন ‘দু–ধারা’ নামে একটি সিনেমা প্রযোজনা করেছেন। তাঁরই পথ ধরে যেসব চট্টল সন্তান চলচ্চিত্র প্রয়োজনায় এগিয়ে এসেছেন, তাঁরা হলেন– চিত্ত চৌধুরী (কবরীর স্বামী), ডা. হাবিবুল্লাহ খান, মঈনুল আলম, বি. আজাদ ইসলামাবাদী, গিয়াসউদ্দিন চৌধুরী, ফয়েজ চৌধুরী, রাশেদ আজগর চৌধুরী, গোলাম কবির, রমলা সাহা, বাবুল চৌধুরী, সাইফুল আলম কায়েস, মোস্তফা মাহমুদ, সৈয়দ সালাউদ্দিন জাকী, জাহাঙ্গীর আলম, নাসির উদ্দীন ইউসুফ, পঙ্কজ পালিত প্রমুখ। এঁদের মধ্যে সৈয়দ সালাউদ্দিন জাকী, নাসির উদ্দীন ইউসুফ সিনেমা পরিচালনাও করেছেন। ‘চট্টগ্রাম অস্রাগার লুন্ঠন’ নামে কোলকাতায় সিনেমা পরিচালনা করে খ্যাতি লাভ করেন চট্টগ্রামের নির্মল চৌধুরী। এছাড়াও ভারতে খ্যাতি অর্জন করেছেন চট্টগ্রামের নিত্যানন্দ দত্ত, দীনেশ রঞ্জন দাশ, সাধন রায়। সাধন রায় প্রথমে ক্যামেরাম্যান হিসেবে কাজ করেন। এরপরে সিনেমা পরিচালনায় আত্মনিয়োগ করেন। তবে বিশেষভাবে উল্লেখ করতে হয় চিদানন্দ দাশগুপ্তের কথা। তাঁর কন্যা অভিনেত্রী, চলচ্চিত্র পরিচালক অর্পণা সেন আজ ভারত বিখ্যাত। তিনি সানন্দা পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন।
চলচ্চিত্র আন্দোলনে চট্টগ্রামের জন্য সবচেয়ে উজ্জ্বল সময়টা ছিল গত শতকের ষাটের দশক। এসময় চট্টগ্রাম থেকে ‘হীরামন’ ও ‘মেঘ ভাঙ্গা রোদ’ নামে দুটি পূর্ণ দৈর্ঘ্য এবং কবিয়াল রমেশ শীলের গান নিয়ে একটি স্বল্প দৈর্ঘ্য সিনেমা নির্মাণ হয়। ‘হীরামন’–এর কাহিনী, চিত্রনাট্য রচনা করেন মাহবুবুল আলম ও মঈনুল আলম। প্রযোজক ও পরিচালনায় ছিলেন চিত্ত চৌধুরী, ডা. হাবিবুল্লাহ খান, মঈনুল আলম, বি, আজাদ ইসলামাবাদী। অভিনয়াংশে ছিলেন কবরী, আবুল মঞ্জুর রানা প্রমুখ। ‘মেঘ ভাঙ্গা রোদ’ পরিচালনা করেন কাজী খালেক। প্রযোজনা করেছেন জি.আর. জি. কর্পোরেশনের ব্যানারে গোরা, রুস্তম ও গিয়াস উদ্দিন। অভিনয়াংশে ছিলেন সুজাতা, শওকত আকবর প্রমুখ। রমেশ শীলের গান নিয়ে স্বল্প দৈর্ঘ্য সিনেমাটি নির্মাণ করেছিল প্রাদেশিক সমবায় পরিদপ্তর। স্বল্প দৈর্ঘ্য সিনেমা নির্মাণের ধারা পরবর্তীকালে অব্যাহত ছিল।
চলচ্চিত্রে বহুমাত্রিক অবদান রেখেছেন চট্টগ্রামের সন্তান সত্য সাহা। সত্য সাহা সুরকার, গীতিকার হিসেবে বিশেষভাবে পরিচিত। তিনি চলচ্চিত্রের কাহিনী, চিত্রনাট্য, পরিচালনা এবং প্রযোজনার কাজেও নিয়োজিত থেকে খ্যাতি অর্জন করেছেন। সত্য সাহা অনেকবার পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন খ্যাতি অর্জন আবুল মঞ্জুর রানা, পরিতোষ কানুনগো, আইয়ুব রানা, সুব্রত, সুমন, সালমান শাহ, সাদেক নবী, ওবায়দুল হক, নারায়ন চক্রবর্তী, স্বপন ভট্টাচার্য, জোবায়ের আলম, পংকজ পাল, সমীরণ চৌধুরী, পংকজ বৈদ্য (সুজন), দিপুল দেওয়ানজী এম.এ.সালাম, তন্দ্রা ইসলাম, জয়শ্রী কবির, সুমিতা চৌধুরী, শকুন্তলা বড়ুয়া, জয়ন্তী চক্রবর্তী, মিনা খান, খালেদা আক্তার কল্পনা, সেলিনা, শিলা মমতাজ, স্বপ্না প্রমুখ সবাই চট্টগ্রামের সন্তান। পূর্ব পাকিস্তানের প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য সবাক চলচ্চিত্র ‘মুখ ও মুখোশ’–এর নায়িকা পূর্ণিমা সেনগুপ্তা ছিলেন চট্টগ্রামের মেয়ে। এছাড়াও এদেশের চলচ্চিত্রাঙ্গণের কিংবদন্তী নায়িকা শাবানা, কবরী, অঞ্জু ঘোষ, অরুণা বিশ্বাস স্মৃতির শহর চট্টগ্রামের মেয়ে। আমরা তাঁদের উত্তরাধিকার। এঁদের মাধ্যমে সৃষ্টি হয়েছে অনেক দর্শক নন্দিত সিনেমা।
চলচ্চিত্র পরিবেশক প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করেছে উজালা ফিল্ম ডিস্ট্রিবিউটর, খুরশীদ মহল ফিল্ম ডিস্ট্রিবিউটর, বনানী কথাচিত্র। এসব তথ্য প্রমাণ করে বাংলা সিনেমার উন্নয়নকল্পে চট্টগ্রামের একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে।
তথ্য সহায়িকা : ১. হাজার বছরের চট্টগ্রাম, দৈনিক আজাদী, ৩৫ বর্ষপূর্তি বিশেষ সংখ্যা,২. দ্য ডেইলি স্টার (বাংলা), ডিসেম্বর ৫, ২০২২.৩. চলচ্চিত্র সংগঠক, পরিচালক শৈবাল চৌধুরী।
লেখক : প্রাবন্ধিক, কথাসাহিত্যিক, নাট্যকার