আমরা দুই গৃহত্যাগী বেরিয়েছি পদব্রজে শ্রী লঙ্কার এমাথা থেকে ওমাথা ভ্রমণে। শ্রী লঙ্কার সর্ব উত্তরের বিন্দু পয়েন্ট পেড্রো থেকে যাত্রা শুরু করে নবম দিনে কেকিরাওয়া শহর হয়ে এগোচ্ছি সিগিরিয়া নামক পাথুরে বিস্ময় দেখতে। বলা হয়ে থাকে, শ্রী লঙ্কা এসে যদি কেউ একটা জায়গা দেখবে বলে মনস্থির করে, তবে সেই জায়গাটা অবশ্যই সিগিরিয়া হওয়া উচিত। অনেকে একে বলেন বিশ্বের অষ্টম আশ্চর্য! সিগিরিয়া এর বাংলা প্রতিশব্দ করলে অর্থ দাঁড়ায় সিংহের মতো দেখতে পাথর। ইংরেজিতে বলে লায়ন রক। প্রাচীন নগর পরিকল্পনার সবচেয়ে সুন্দর নিদর্শন হিসেবে এটি এখনো দাঁড়িয়ে আছে মাতালে জেলায়। এটির নির্মাতা রাজা কশ্যপ। যদিও অনেকে বলে থাকেন এর আগেও এখানে বসতি ছিল। বৌদ্ধ ভিক্ষুরা মঠ হিসেবে ব্যবহার করতেন এখানের নানান গুহাগুলো। সেটা প্রথম আর দ্বিতীয় শতাব্দীর কথা। প্রথম এবং দ্বিতীয় শতাব্দীতে ভিক্ষুদের বসবাস থাকলেও সিগিরিয়ার মূল প্রাসাদ, বাগান এবং অন্যান্য রাজকীয় প্রাসাদগুলো সব রাজা কশ্যপের আমলেই তৈরি হয়।
রাজা কশ্যপ পঞ্চম শতাব্দীতে অনুরাধাপুরা থেকে সরিয়ে এখানেই নতুন রাজধানী স্থাপন করেন। এর পেছনে অবশ্য কারণ আছে। নিজের পিতা ধাতুসেনা–কে সরিয়ে এবং সিংহাসনের মূল দাবিদার সৎ ভাই মোজ্ঞাল্লানা–কে বঞ্চিত করে সিংহাসনে আরোহণ করেন তিনি। কশ্যপ ছিলেন ধাতুসেনার দাসীর ঘরে জন্ম নেওয়া সন্তান। অন্যদিকে রাজা ধাতুসেনার স্বীকৃত রানির সন্তান ছিলেন মোজ্ঞাল্লানা। নিজের পিতাকে জীবন্ত অবস্থায় চারপাশে প্রাচীর বেষ্টিত করে হত্যা করেন কশ্যপ। অনেকটাই মোগল সম্রাট শাহজাহান আর তাঁর তৃতীয় পুত্র আওরঙ্গজেবের সেই স্নায়ু টানটান সম্পর্ক। এখানে দারা শিকো এর ভূমিকায় আছেন মোজ্ঞাল্লানা। সৎ ভাই কশ্যপের ভয়ে প্রাণভয়ে ভারতে পালিয়ে যান মোজ্ঞাল্লানা। তবে যাবার আগে প্রতিজ্ঞা করেন, ফিরে এসে সিংহাসন দখল করবেন। দারা শিকো–এর মতো ভাইয়ের হাতে প্রাণ দিতে হয়নি মোজ্ঞাল্লানা–কে। উলটো ভাইকে হটিয়ে নিজের প্রাপ্য ময়ূর সিংহাসন বুঝে নেন মোজ্ঞাল্লানা।
কশ্যপ ভাইয়ের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়ার সময় চড়ে বসেছিলেন হাতিতে। হাতি কৌশলগত কারণে দিক পরিবর্তন করলে পেছনের সৈন্যরা ধরে নেন সামনে শত্রুপক্ষের বিশাল বাহিনী আসছে। তারা রাজাকে ওখানেই ফেলে রেখে পালিয়ে যান। নিজের সৈন্যদলকে পশ্চাদপসরণ করতে দেখে কশ্যপ ওখানেই নিজের তরবারি দিয়ে আত্মহত্যা করেন। অবশ্য আমার মেডিকেল কলেজের অনুজ মাতালে জেলার সন্তান দুলহাজ গতকাল ভিন্ন একটা ঘটনা বলেছিল। স্কুলে ওর এক শিক্ষকের কাছে শোনা ঘটনাটা। যুদ্ধ যাত্রার সময় রাজা কশ্যপের হাতির সামনে বিশাল এক সাপ পড়েছিল। তাই দেখে হাতি উলটো পথে ফিরলে বিদায় ঘন্টা বাজে কশ্যপের শাসনের। অবশ্য মিথের সাথে মিথ্যার খানিকটা সম্পর্ক থাকতেই পারে! কশ্যপের রাজধানী পরিত্যক্ত হওয়ার পরে রাজা মোজ্ঞালান্না এটি সংঘকে দান করে দিলে ফের এখানে বৌদ্ধভিক্ষুরা থাকতে শুরু করেন।
সিগিরিয়া কম্পলেক্স ঢুকতেই চোখ পড়ে আয়তাকার জলাশয়ে। পুরো কম্পলেক্সের চারপাশ বেষ্টন করে আছে পরিখা। টিকেট কেটে মূল প্রাঙ্গণে ঢুকতেই প্রথমে ওয়াটার গার্ডেন। আর উপরে তাকালেই সেই অতিকায় লায়ন রক। প্রায় দুই হাজার বছরের কালের আঁচড় সামলে সটান দাঁড়িয়ে আছে। এখান থেকে চূড়ার উপরের গাছগুলোও দৃষ্টিসীমায়। মিরর গার্ডেনের লালচে দেয়ালও নিচ থেকে চোখ এড়ায় না। হাতের বামে অষ্টভুজাকৃতি পুকুর। বোধিঘর নামে একটা স্থাপনা আছে প্রবেশের অল্প পরেই। অশ্বত্থ তথা বোধিবৃক্ষের জন্যই বানানো পুরো স্থাপনাটি। অবশ্য বোধিদ্রুমটি এখন আর অবশিষ্ট নেই। ইটের তৈরি বিশাল প্ল্যাটফর্মটি অবশ্য টিকে আছে এখনো। ইমেজ হাউস আর স্তূপ দেখে পা রাখলাম বোল্ডার গার্ডেন। প্রাগৈতিহাসিক প্রাণীর অতিকায় ডিমের আকারের একেকটা বোল্ডার। এখানে একটা শান বাঁধানো পথের উপরে সাইনবোর্ডে লেখা– To the summit!
এবার টানা সিঁড়ি ভাঙার পালা। মাঝপথে লায়ন স্টেয়ারকেস। সিংহের পায়ের নখরসদৃশ এই দ্বার কাজ করত মধ্যবর্তী ফটক হিসেবে। কী নিখুঁত কাজ! এত বছর পরেও এর সুক্ষ্ম কারুকাজ দেখে অবাক হতে হয়। এরপরে আরো অনেকগুলো সিঁড়ির সোপান। ধাপে ধাপে উঠে যাওয়া মূল লায়ন রকের পানে। উপরে উঠে বামে গিয়েই পেলাম রাজা কশ্যপের সিংহাসন। একদমই সাদামাটা! এই সিংহাসনের জন্যই কী তবে এত কিছু! চাকরির জাঁতাকলে পিষ্ট বেশিরভাগ অফিসের কর্মকর্তার চেয়ারও এরচেয়ে আরামদায়ক! সামনেই এত উঁচুতেও বিশাল এক জলাধার। এককালে এই প্রাসাদের লোকেদের পানি জোগান দিলেও আজকাল সিগিরিয়ার বানরেরা পানি খায় মূলত এখানে। এত উঁচুতে পানির সরবরাহে কখনও প্রাসাদবাসীদের ঘাটতি হয় না। সিগিরিয়ার অনন্য বিস্ময়ের মধ্যে জলাশয়টি প্রথম সারিতেই থাকবে। এখান থেকে দূরের পাহাড়সারির দারুণ দৃশ্য দেখা যায়। এরপরে আছে প্রাসাদের ধ্বংসস্তূপ। সাউথ প্যালেস, ওয়েস্টার্ন প্যালেস, ইস্টার্ন প্যালেস ইত্যাদি। কোনোটিরই ছাদ আজ আর অবশিষ্ট নেই। প্রাসাদের কামরাগুলোর নিচের দিকের ভিত্তির কিছু পোড়ামাটির ইট কালের ধাক্কা সামলে টিকে আছে শুধু। এত উপরেও কুকুর উঠে পড়েছে। পার্শ্ববর্তী পিডুরাংগুলা রকের চূড়ার পাথরগুলো অবধি খুব ভালো দেখা যায় সিগিরিয়া টপ থেকে।
ড্রোণাচার্য বা ড্রোন অপারেটররা বোলতার মতো আওয়াজ তুলে ড্রোন উড়িয়ে দিয়েছে! অথচ সবখানেই সাবধানবাণী লেখা আছে– Be silent Wasps! দূরের পাহাড়গুলো ওদের দিক থেকে দৃষ্টি সরাতেই দিচ্ছে না। ঘন্টাখানেক চূড়ায় ঘুরে নামার সিঁড়ি ধরলাম। যাত্রাপথে মিরর হাউজ হয়ে কেভ পেইন্টিং এর গুহায়। ধারণা করা হয় সিগিরিয়া নামক পুরো পাথরটাই একটা অতিকায় চিত্রশালা ছিল একসময়। ১৯৬৭ সালে কে বা কারা একবার এখানে ভাংচুর করে অনেকগুলো চিত্রকর্ম নষ্ট করে দিয়েছিল। সেটার ছাপ এখনো রয়ে গেছে গুহার নানান চিত্রে। সিস্টার্ন রক দেখলাম নিচে নেমে। একটা বিশাল পাথরের মধ্যখানে আশ্চর্যজনক এক জলাশয়। জায়গাটা মুখপোড়া হনুমানদের অভয়ারণ্য। অডিয়েন্স হল, আসমা কেভ আর কোবরা হুড কেইভ দেখে মূল রাস্তায়। কোবরা হুড কেইভটা খুব মনে ধরল। ফণা তোলা গোখরার আকৃতির পাথর তো আর রোজ রোজ দেখার সৌভাগ্য হয় না। মুগ্ধ দৃষ্টিতে এই পাথুরে বিস্ময়কে শেষবারের মতো দেখে পা বাড়ালাম ফেরার পথে।