আমাকে সকলে মিলে ধরে ধরে বেশ কয়েকতলা উপরে, জাহাজের সিক–বে (হাসপাতালে) নিয়ে আসার অল্পক্ষণের মধ্যেই, আচমকা দুর্ঘটনার শকে এবং অবসন্ন দুর্বল শরীরে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। ঘন্টাখানেক পরে চোখ মেলে দেখি ক্যাপ্টেন আর চিফ ইঞ্জিনিয়ারের স্ত্রী দুজনেই আমার বিছানার পাশে উৎকণ্ঠার সঙ্গে বসে আছে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে। দুজনেই ভারতীয়। আমি চোখ মেলতেই ওনারা তড়াক করে লাফিয়ে উঠে আমার কিছু লাগবে কিনা জিজ্ঞেস করলেন। একজন ছুটে গেলেন ক্যাপ্টেন ও অন্য সবাইকে জানাতে। মিনিটের মধ্যেই ক্যাপ্টেন, চিফ–ইঞ্জিনিয়ার সেকেন্ড–অফিসার এসে হাজির। সকলেই আমাকে সাহস ও সান্ত্বনা দিতে থাকলেন। জানালেন যে, তারা চারিদিকেই কথাবার্তা বলছেন। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো যে, অফিসের নির্দেশে লোকাল এজেন্টের মাধ্যমে ডাক্তারের সঙ্গেও আমার শারীরিক অবস্থা নিয়ে কথা হয়েছে তাদের। ডাক্তার তাদের নির্দেশ দিয়েছে কী কী করতে হবে। আমি ঘোরের মাঝে ঘুমাচ্ছিলাম, তাই তারা আমাকে ডিস্টার্ব করে নাই। এখন সকলে আমি কেমন আছি, কেমন অনুভব করছি, কিছু খাবো কিনা ইত্যাদি যাবতীয় প্রশ্ন করতে থাকলো।
আমি নিজেও আঁচ করার চেষ্টা করলাম, কতটুকু ক্ষতি হয়েছে। বামদিকের গলা–কাঁধ, বাঁ–হাত, খুবই জ্বলছে, ঘাড় ঘুরাতেও পারছি না। মুখ–কপাল–ঠোঁটেও চিটচিটে সেই হেভি–অয়েল লেগে আছে বুঝছি। বাম কানের ভিতরেও বেশ খানিকটা গরম তেল ঢুকেছে। সেকেন্ড অফিসার (জাহাজের ডেজিগ্নেটেড ডাক্তার) জানালো বন্দরের ডাক্তার বলেছে সাবধানে সব তেল মুছে দিতে, আর ক্ষতজায়গায় এন্টিসেপ্টিক ও সিলভাডিন ক্রিম লাগাতে। প্রয়োজন হলে ব্যাথার আর ঘুমের ঔষধ দিতে। আগুন, গরম তেল–পানি–বাষ্প বা যে কোনো কিছুতেই বেশী পুড়ে গেলে, ফোস্কা হয়, সেগুলো ফেটে গিয়ে ইনফেকশানের সম্ভাবনা থাকে। আর হেভি ক্রুডঅয়েল নিজেই তো নানান ক্ষতিকর কেমিক্যালে ভরপুর। সেগুলোও আমার চামড়া ভেদ করে শরীরে ঢুকে যেতে পারে। তাই যতরকমের সাবধানতা নেওয়া সম্ভব নিতে হবে। পুড়ে গেলে, শরীরে অনেক ফ্লুইড–লস্ হয়। তার ফলে শক বা জ্ঞান হারানো অনেক কিছুই হতে পারে। বন্দরের ডাক্তারের নির্দেশ যে, তার সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে হবে; এবং একটু পরপর তাকে আমার আপডেট জানাতে হবে। যদি সে আমার অবস্থা সংকটাপন্ন মনে করে তাহলে জরুরী ভিত্তিতে হাসপাতালে নিতে হবে। সেক্ষেত্রে হেলিকপ্টার পাঠাতে হবে জাহাজে; কারণ সবচেয়ে নিকটবর্তী বন্দরে জাহাজ নিয়ে পৌঁছতেও আমাদের একদিনের বেশী লাগবে। এবং জাহাজ সেখানেই যাচ্ছে এখন অ্যামেরিকার ভার্জিনিয়া স্টেটের নিউপোর্ট নিউজ বন্দরে। আমার এই এক্সিডেন্টের জন্যে, জাহাজ টেক্সাসের বদলে সবচেয়ে কাছের পোর্টের দিকে মুখ ঘুরিয়েছে।
আমার কাছে মনে হলো, অনেকটা পুড়ে গেলেও আমি সংকটাপন্ন অবস্থা কাটিয়ে উঠেছি। ইমার্জেন্সি বেসিসে কিছুই করতে হবে না। ক্ষত পরিষ্কার, এন্টিসেপ্টিক আর ঠান্ডা–মোলায়েম সিলভাডিন ক্রিম এগুলো কাজ করলে, আমি বাকিটুকু সহ্য করে যেতে পারবো। একটা চেয়ারে বসিয়ে, দুইতিনজন মিলে আমার সারা শরীর হাল্কা হাল্কা করে পরিষ্কার করতে থাকলো। আমার মাঝে মাঝেই ভীষণ ঠান্ডা লাগছিলো সারা শরীর কাঁপুনি দিয়ে দিয়ে উঠছিলো। এতে করে তারাও ভয় পেয়ে যাচ্ছিলো। আমি মনের ভরসা বাড়ানোর জন্যে একজনের হাত শক্ত করে আঁকড়ে ধরে রেখেছিলাম। জাহাজে কেউই ডাক্তার নয়, ফার্স্ট–এইডে ট্রেইন্ড মাত্র, তাই সকলেই ভয়ে ভয়ে কাজ করছিলো। এবং আলতো করে পরিষ্কার করেছিলো; অনেক জায়গাতেই তেল রয়ে গিয়েছিলো। খুব অসহায় লাগছিলো নিজেকে; খারাপও লাগছিলো। আমি ছাব্বিশ বছরের জোয়ান–তাগড়া যুবক, অথচ দুর্ঘটনায় পড়ে এখন অন্যের উপরে নির্ভরশীল হয়ে গেছি। সকলকে কত কষ্ট দিচ্ছি, দুশ্চিন্তায় ফেলেছি, জাহাজের দিক ঘুরানো মানে অনেক খরচের ব্যাপার হলো, শুধুমাত্র আমার কারণেই।
যতটুকু সম্ভব তেল পরিষ্কার করে, জ্বালা–পোড়ার মলম সিলভাডিন অনেক অনেক পরিমাণে দিয়ে ক্ষতস্থানগুলো লেপে দিলো। এর মধ্যেই চারিদিকে ফোস্কা উঠা শুরু হয়ে গিয়েছে সেগুলোই বিপজ্জনক। শরীরের পানি ড্রেন হয়ে যায়, আর ইনফেকশানও হয়ে যেতে পারে সেখানে। এটুকু করতে করতেই আমার দুর্বল শরীরে আবারো ঘুম পেয়ে গেলো। আমি চেয়ারেই ঝিমিয়ে পড়ছিলাম দেখে, তারা সকলে আবার বিছানায় শুইয়ে দিলো। স্লিপিং পিলের কারণেই হয়তো, আমিও গভীর ঘুমে চলে গেলাম। ক্যাপ্টেনের নির্দেশে, আমার বিছানার পাশে সবসময় একজন করে থাকবে, আমার দিকে নজর রাখার জন্যে, আর কিছু প্রয়োজন হলে সেটা করার জন্যে। আমি তখন নিজে একা বিছানা থেকে নেমে বাথরুমেও যেতে পারছিলাম না কারো না কারো সাহায্য লাগছিলো। নিজহাতে খেতে পারছিলাম না, মুখে তুলে খাইয়ে দিয়েছিলো। পালা করে করে অনেকেই ছিলো। দিনেরবেলা ভাবীরা দুইজন থাকলেন, এরপরে অফিসার ক্রু মিলিয়ে অনেকেই ছিলো। এছাড়াও, কিছু পরপরই কেউ না কেউ এসে আমাকে দেখে যাচ্ছিলো, খবর নিচ্ছিলো। সকলেই, এরকম এক্সিডেন্টের জন্যে সমবেদনা জানাচ্ছে। আমি তাদের ধন্যবাদ জানিয়ে, দোয়া করতে বললাম।
অন্যদিকে, আমাকে নিয়ে কী করা হবে সে ব্যাপারে হেড–অফিস, লোকাল এজেন্ট, বন্দরের ডাক্তারের সঙ্গে ক্রমাগত আলাপ চালিয়ে যাচ্ছে ক্যাপ্টেন ও চিফ ইঞ্জিনিয়ার। ডাক্তারের পরামর্শে, আমাকে নিকতবর্তী পোর্ট ভার্জিনিয়া স্টেটের নিউপোর্ট নিউজে শহরের হাসপাতালে নেওয়া হবে ঠিক করা হয়েছে। জাহাজ সেখানে আগামীকাল দুপুরে পৌঁছাবে। জাহাজে আমার সমবয়সী কলকাতার একজন জুনিয়র ইঞ্জিনিয়ার ছিলো। বাংলা বলার সুবাদে, আমাদের দুজনের বেশ ভালো সম্পর্ক। তাকে দিয়ে আমার কেবিনে গিয়ে জিনিসপত্র স্যুটকেসে ভরা হলো। জাহাজে আমরা মাত্র কয়েকমাসের জন্যে যাই। র্যাঙ্ক অনুযায়ী সকলেরই কেবিন ঠিক করা থাকে। আগেরজন চলে গেলে আমি আমার জিনিসপত্র নিয়ে সেই কেবিনে সেটআপ করে থাকি। আবার আমার কন্ট্রাক্ট শেষে আমার জিনিস নিয়ে বের হয়ে এসে পরের জনের জন্য খালি কেবিন রেখে দেই। সবাই মোটামুটি এভাবেই অভ্যস্থ। সেজন্যে, সেই জুনিয়ার ইঞ্জিনিয়ারের পক্ষে আমার স্যুটকেস গুছাতে অসুবিধা হয় নাই।
সন্ধ্যার পরে আমাকে আরেকবার ঔষধ দিয়ে রাতের মত ঘুম পাড়িয়ে দিলো। পরদিন (অক্টোবর ১০, ১৯৯০) সকাল দশটা–এগারোটার দিকে জাহাজ নিউপোর্ট নিউজে ভিড়ছে যখন, তখনই লোকাল এজেন্ট সেখানে অপেক্ষা করছে। আমাকেও সকালে ঘুম থেকে উঠার পরে, যথাসম্ভব রেডি করে ফেলা হয়েছিলো। আমার সঙ্গে জাহাজের একজন ফিলিপিনো জুনিয়র অফিসারকে নিয়ে এজেন্ট সঙ্গে সঙ্গেই ডাক্তারখানার দিকে রওনা দিলো। ততক্ষণে দুর্ঘটনার চব্বিশ ঘন্টা পার হয়েছে, জ্বালা–পোড়া একটু কমলেও, ব্যথা,অস্বস্তি, ঘাড়–গলা–হাত নাড়াচাঁড়ায় লিমিটেশান রয়ে গেছে। আর সবচেয়ে অস্বস্তিকর হলো সেই চিট্িচটে জঘন্য হেভি–অয়েলের দুর্গন্ধ ও আঠা আঠা ভাব।
ডাক্তারের অফিসে আমাদের দুইজনকে নামিয়ে এজেন্ট অন্য কাজে চলে গেলো। ডাক্তার এসে আমার ক্ষতস্থান পরিষ্কার করলো। উফ্ফ্! কী নিষ্ঠুর রে বাবা! একটা তোয়ালে বা ব্যান্ডেজের মত গজ নিয়ে সে ক্ষতস্থানগুলোতে ঘষাঘষি শুরু করলো। আমি তো ব্যথায় কঁকিয়ে উঠছি, চিল্লাচ্ছি, আমার জাহাজী ফিলিপিনোর হাত চিপে ধরে আছি। সে আমার কষ্ট সহ্য করতে না পেরে, অন্যদিকে তাকিয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরে ভরসা দিচ্ছে। একটু পরে ডাক্তারে খেমা দিয়ে একটা ইঞ্জেকশান দিয়ে বললো তোমরা দুইজন এখানে অপেক্ষা করো। আমি রূগী পরীক্ষার বিছানায় বসলাম, এরপরে আর কিছুই মনে নাই। ঘুম যখন ভাঙলো, নিজেকে একটা হাসপাতালের কেবিনে আবিষ্কার করলাম। কয়টা বাজে, তারিখ কত, আজ সপ্তাহের কোন্ বার এসব কিছুই জানি না। মাথা ঘুরিয়ে সেই ডাক্তারকে খুঁজলাম, আমার জাহাজের ফিলিপিনো শিপমেটকে খুঁজলাম। নাহ্ কেউই নাই; এবং এটা সম্পূর্ণ অন্যজায়গা। ডাক্তারখানাটা ছিলো একতলা অফিস; আর এখন একটা কেবিনের বিছানায় শুয়ে আছি। এবং জানালার বাইরে তাকিয়ে বুঝতে পারলাম, আমি বড় কোনো বিল্ডিং–এর অনেক উপরের তলায়।
নার্স স্টেশান থেকে নিশ্চয়ই আমার দিকে খেয়াল রাখছিলো। আমার নড়াচড়া টের পেয়ে একজন নার্স কেবিনে এসে একমুখ হাসি দিয়ে বললো, কেমন আছো? আমি অনেক কষ্টে শুকনা গলায় ভালো বলে, পানি চাইলাম। অনেক কসরত করে স্ট্র দিয়ে সে আমাকে পানি দিলো অনেকখানি। আমি আমার ফিলিপিনো বন্ধুর কথা জিজ্ঞেস করায়, সে বললো, এখানে তো সেরকম কেউ নেই বা আমার সঙ্গে আসে নাই। আমাকে ডাক্তারের অফিস থেকে এম্বুলেন্সে এখানে নিয়ে আসা হয়েছে।
আমি: তাহলে, এটা কোথায়?
নার্স: এটা নিউপোর্ট নিউজের রিভারসাইড হাসপাতাল।
(চলবে)
টলিডো, ওহাইও, ২০২৩
rafayet@yahoo.com