সিকস্তি ও পয়স্তি

| সোমবার , ৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪ at ৭:২৩ পূর্বাহ্ণ

এম. আনোয়ার হোসেন

সিকস্তিকে ইংরেজিতে বলা হয় অষষাঁরড়হ (এলুভিয়ন) এবং পয়স্তিকে বলা হয় উরষাঁরড়হ (ডিলুভিয়ন/ডাইলুভিয়ন)। সিকস্তি শব্দের শাব্দিক অর্থ হলো ভাঙা এবং পয়স্তি শব্দের শাব্দিক অর্থ হলো সংযুক্ত বা একীভূত হওয়া। সিকস্তি এবং পয়স্তি শব্দগুলো হচ্ছে আমাদের দেশে আইনি ভাষা। তবে শব্দ দুটি ফার্সী শব্দ। পারিভাষিক অর্থে সিকস্তি হলোনদীতে জমি ভেঙে যাওয়া। আর পয়স্তি হলোনদীতে ভেঙে যাওয়া জমি পুনরায় চরজমি হিসেবে উত্থিত হওয়া। (সি.ও প. আইন এর বি. পৃ.- ২৩২৪)

পয়স্তি জমির সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, – পলিমাটিজাত পয়ন্তি জমি হইলে নদী বা সাগর হইতে জাগিয়া ওঠা ভূমি। The Alluvial Lands Act, 1820 এর ২ () ধারা অনুযায়ী নদী বা সাগর গর্ভ হইতে যে ভুমি জাগিয়া উঠিয়াছে তাহাই পয়স্তি (reformation in situ) ও ইহার অন্তর্ভুক্ত হইবে। The State Acquisition and Tenancy Act, 1950 এর ৮৭ ধারা অনুযায়ী নদী অথবা সাগর দূরে সরিয়া যাইবার কারণে যখন পরিবৃদ্ধিপ্রাপ্ত অবস্থায় কোন জমি পাওয়া যায় তখন তাহাকে সংযুক্ত জোত বা প্রজাস্বত্তের পরিবৃদ্ধিপ্রাপ্ত জমি হিসেবে গণ্য করা যাইবে না, ইহা চূড়ান্তভাবে সরকারের উপর ন্যস্ত হইয়া যাইবে এবং ইহার কর্তৃত্ব সরকারে ন্যস্ত হইবে।

পয়স্তি (সর্বশেষ বলা হয়েছে), পানিবাহিত মৃত্তিকা, কর্দম অথবা অন্য কোনো বস্তুর সঞ্চয়। ভুমি আইনে চলন্ত পানিবাহিত বস্তুর সঞ্চয় দ্বারা সৃষ্ট অতিরিক্ত জমি, যাহা যে জমির সহিত যুক্ত হয়, তাহার মালিকের সম্পত্তি হইয়া যায়।

সিকস্তির সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, পাললিক জমি (Diluviated Land) – পাললিক জমি The State Acquisition and Tenancy Act, 1950 এর পঞ্চম ভাগ বলবৎ হইবার পরে যে পাললিক জমির পুনরাবির্ভাব ঘটে, তাহাতে জমির মূল মালিকের অধিকার, স্বত্ব ও স্বার্থ লুপ্ত হইয়া যায়। ঐ অধিকার, স্বত্ব ও স্বার্থ সরকারে অর্পিত হয়। সর্বশেষ বলা হয়েছে, অধিক বৃষ্টিপাত ও মারাত্মক বন্যায় নদীতে পানির প্রবাহ প্রবল হইবার ফলে অনেক সময় নদীর গাঙের জমি ভাঙিয়া নদী গর্ভে পড়িয়া বিলুপ্ত হইয়া যায়। এইভাবে জমি নদী গর্ভে বিলুপ্ত হওয়াকে বলে সিকস্তি। পৃ.২৩

পয়স্তি ও সিকস্তির ধরনঃ পয়স্তি জমি দুই ধরনের হতে পারে। () ভেঙে যাওয়া জমি পুনরায় জেগে ওঠা এবং () নতুন কোনো জমি জেগে ওঠা। (পৃ২৭)। আর সিকস্তির ধরন একটি। যেহেতু সিকস্তির সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, জমি নদী গর্ভে বিলুপ্ত হওয়া। তাই ব্যক্তি মালিকানা কিংবা খাস ভুমি ভেঙে যাওয়ার ধরন এখানে শুধুমাত্র ভাঙা বা বিলুপ্ত হওয়া।

অধিকারসিকস্তি ও পয়স্তি আইন এর বিধানাবলী গ্রন্থের প্রথম অধ্যায়ে ‘নদী ভাঙন ও আইনগত অধিকার’ এ ১৮৫৯ সালের বঙীয় খাজনা আইন থেকে শুরু করে বঙীয় প্রজাস্বত্ব আইন, ১৮৮৫্থর ৫২ ধারা, ৮৬ ধারা, ১৯৩৮ সালে এই বিধানকে পুনরায় সংশোধন, ১৯৫০ সালের আইনের ৮৬ ধারা, ১৮২৫ সালের ১১ নং নিয়ামক ধারা, ১৯৭২ সালের ৪ আগষ্ট রাষ্ট্রপতির ১৩৫ নং আদেশ, ১৯৯৪ সালের The State Acquisition and Tenancy (Amendment) Act, 1994 তুলনামুলক ও বিশ্লেষণমুলক আলোচনা শেষে বলা হয়,- ১৯৯৪ সালের ১৫ নম্বর আইন সংশোধনের মাধ্যমে যেভাবে নিষ্পত্তি করা হয় সেভাবেই জমির মুল অবস্থানে পুনর্গঠিত জমির মালিকানার অধিকার সম্পর্কিত বর্তমান আইনগত অবস্থানও বিন্যস্ত। অর্থাৎ জমির সিকস্তি ঘটলে ঐ জমির মালিকানা পাবে প্রজা এবং ৩০ বছর পর যদি মূল অবস্থানে ভূমি পুনর্গঠিত হয় তাহলে সেই জমি হবে সরকারের সম্পত্তি। মালিক শনাক্ত করার সুবিধার জন্য রাজস্ব কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে খাজনা হ্রাস সংক্রান্ত একটি প্রত্যয়নপত্রের প্রয়োজন হবে। এ ছাড়াও এখানে বলা হয়েছে, –পয়স্তি জমি (সংযুক্ত বা একীভূত জমি) মালিকানার বেলায় সাধারণ আইন হচ্ছে, অলক্ষ্যে ও ধীর গতিতে চর গঠিত হলে তার অর্থ হবে এই যে, এটি সংশ্লিষ্ট নদী বা সমুদ্রে নিজ জমির সম্প্রসারণ হিসেবে পরিগণ্য। তবে এ ধরনের চরকে জমির মূল অবস্থানে ভূমির পুনর্গঠন বা পুনরাবির্ভাব হিসেবে দাবি করা যাবে না। (পৃ১৭১৮)। এ অধ্যায়ের ‘চর গঠন ও আইনগত অধিকার, এর তৃতীয় প্যারায় বলা হয়েছে-’ একইভাবে নদী তীরবর্তী মালিক নতুন চরের জমি দখলে নেওয়ারও অধিকারী যদি ঐ নতুন চর ধীরে ক্রমান্বয়ে তার জমির সাথে লাগোয়া আকারে গড়ে ওঠে। ( পৃ২০) এ ক্ষেত্রে তার একটি মাত্র দায়িত্ব রয়েছে, আর সেটি হলো কর বা খাজনা প্রদান করা। সম্পত্তিতে এই রদঅযোগ্য অধিকারের ভিত্তি সর্বজনীন আইন ও ন্যায়বিচারের বুনিয়াদে প্রতিষ্ঠিত বলে উল্লেখ করা হয়ে থাকে যা ১৮২৫ সালের নিয়ামক প্রবিধানে বিধিবদ্ধ। প্রথম অধ্যায়ের ‘সিকস্তি ও পয়স্তি সংক্রান্ত অধিকার’ এর ‘বর্তমান বাংলাদেশে যে আইনটি প্রচলিত আছে’, এতে বলা হয়েছে১৩ই জুলাই ১৯৯৪ সনের পর থেকে ভেঙে যাওয়া বা নদী গর্ভে বিলীন হয়ে যাওয়া জমি ৩০ বছরের মধ্যে জেগে ওঠলে পূর্বের মালিক তথা ভেঙে যাওয়ার আগের মালিক জমি ফেরত পাবেন, তবে যে মালিকের জমি ৬০ বিঘা বা তার বেশি পরিমাণ জমি আছে তারা ভেঙে যাওয়া জমি ফেরত পাবেন না। তবে ৬০ বিঘার কম জমি থাকলে ৬০ বিঘা পূরণ করতে যতটুকু জমির প্রয়োজন ততটুকু জমি ফেরত পাবেন এবং ৬০ বিঘা জমি পূরণ করে যদি কোনো জমি অবশিষ্ট থাকে তাহলে তা খাস জমি হিসাবে গণ্য হইবে। (পৃ৩০)। বিদ্যমান আইনে এটি থাকলেও পয়স্তির সংজ্ঞায় দেখা যায়, ভূমি আইনের চলন্ত পানিবাহিত বস্তুর সঞ্চয় দ্বারা সৃষ্ট অতিরিক্ত জমি, যাহা যে জমির সহিত যুক্ত হয়, তাহার মালিকের সম্পত্তি হইয়া যায়। (পৃ২৩)। অর্থাৎ রেকর্ডীয় মালিকের খতিয়ানভুক্ত দাগের সাথে লাগোয়াভাবে জেগে ওঠা চর এই মালিকেরই প্রাপ্য। এবং যদি সেটি নদী থেকে সম্পূর্ণ নতুন চর জাগে তবে অন্যান্য আইনের ব্যত্যয় না হলে তার অধিকারের ক্ষেত্রে আর কোনো অসুবিধা থাকে না।

সমুদ্র, নদী ও খাল বিভিন্ন সময় বিভিন্ন কারণে ভেঙে যায়। আবার কোথাও ভেঙে যাওয়া জমি ভরে ওঠে বা ভরাট হয় প্রকৃতির নিয়মে। আবার কোথাও কোথাও একেবারে নতুন চর জেগে ওঠে। ফলে দেশের বিভিন্ন স্থানে এ নিয়ে হানাহানি, মারামারি হয় কিংবা সংঘর্ষজনিত কারণে প্রাণহানিও ঘটে থাকে। তাই সিকস্তি পয়স্তির গুরুত্ব অনুধাবন করে এ বিষয়ে জনসচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে ‘সিকস্তি ও পয়স্তি আইন এর বিধানাবলী’ গ্রন্থ থেকে উপরোক্ত আলোচনা করা হয়েছে। আইনের এ গ্রন্থটি সংকলন করেছেন সাইফুল ইসলাম ফকির। রহিম ল বুক হাউস এটি প্রকাশ করেছে। এর দাম ৬০০ টাকা রাখা হলেও এটি ৩০০ টাকায়ও পাওয়া যায়। মুদ্রণ করেছে পানিনী প্রিন্টিং প্রেস। জানুয়ারি ২০২৩ এর প্রথম প্রকাশ। গ্রন্থের ভুমিকায় সংকলক লিখেছেন, – ‘গ্রন্থটি সংকলনে বিভিন্ন সরকারিবেসরকারি নথি, ওয়েব সাইট, লেখকের বই ও অনলাইন আইন সাময়িকীর সহায়তা নেয়া হয়েছে। ‘অবশ্য সিকস্তি পয়স্তি বিষয়ক আইনের গ্রন্থ বাজারে নেই বললেই চলে। তাই অত্র গ্রন্থটি সংশ্লিষ্ট বিষয়ের একটি চমৎকার ও প্রধান গ্রন্থ বলে মনে হয়েছে। এ গ্রন্থটি তিনটি অধ্যায়ভুক্ত ২৩৮ পৃষ্ঠার একটি আইনের সংকলন বই। প্রথম অধ্যায়ে পয়স্তি ও সিকস্তির ঐতিহাসিক পর্যালোচনা, দ্বিতীয় অধ্যায়ে সিকস্তি পয়স্তি সংশ্লিষ্ট আইন ও বিধি এবং তৃতীয় অধ্যায় ভূমি উন্নয়ন কর সংশ্লিষ্ট আইন ও বিধিবিধান সম্বলিত সূচিপত্র।

গ্রন্থের তৃতীয় অধ্যায়ভুক্ত ‘হাওর, বাঁওড়, খাল, বিলসহ সকল সরকারি জলাভূমি বা জলাশয়ের সংরক্ষণ’– (পৃ২০৩) এর () এ বলা হয়েছে,- এই সকল ভূমিতে সরকার কর্তৃক নির্ধারিত মেয়াদে ও শর্তে মাছ ধরিবার বা কৃষি আবাদ করিবার অধিকার ব্যতীত কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের অন্য কোনো প্রকার অধিকার বা স্বত্ব থাকিবে না এবং এইরূপ কোনো প্রকার অধিকার বা স্বত্ব বিদ্যমান থাকিলে এই আইন কার্যকর হইবার সঙ্গে সঙ্গে ক্ষতিপূরণসহ বা প্রযোজ্য ক্ষেত্রে ক্ষতিপূরণ ব্যতিরেকে উহা বিলুপ্ত হইবে।

লেখক: প্রাবন্ধিক

পূর্ববর্তী নিবন্ধদুরন্ত অষ্টাদশ
পরবর্তী নিবন্ধশিক্ষার্থীদের সৃজনশীলতা ও নতুন শিক্ষাক্রম