চট্টগ্রাম নগরীর ‘ফুসফুস’ খ্যাত ঐতিহাসিক সিআরবি। এ ফুসফুসকে ধ্বংসের অংশ হিসেবে এখানে বড়সড় হাসপাতাল নির্মাণ প্রক্রিয়া শুরু করেছে বাংলাদেশ রেলওয়ে। পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপের (পিপিপি) ভিত্তিতে এ প্রকল্প জনগণকে ধোঁকা দেওয়ার জন্য করা হচ্ছে বলে মনে করেন বিশিষ্ট নাগরিকবৃন্দ। এ নিয়ে আজাদী কথা বলেছে কয়েকজন বিশিষ্ট ব্যক্তির সাথে। তারা বলেন, চট্টগ্রামকে বলা হতো প্রকৃতির লীলাভূমি। সেই চট্টগ্রামকে এখন জঞ্জালের শহরে পরিণত করার হীন চক্রান্ত চলছে। স্বাস্থ্যসেবার নামে ব্যবসায়িক ফায়দা লোটার এ অপচেষ্টা যেকোনো মূল্যে প্রতিরোধ করতে হবে।
বেগম মুশতারী শফী
যারা উদ্যোগ নিয়েছে তাদের বিরুদ্ধে তদন্তের দাবি জানাচ্ছি
লেখিকা, শহীদ জায়া বেগম মুশতারী শফী বলেন, সিআরবিতে হাসপাতাল নির্মাণের বিপক্ষে আমি। এ উদ্যোগ যারা নিয়েছে, যারা দিয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে তদন্তের দাবি জানাচ্ছি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে।
তিনি বলেন, মানুষের চলার পথ নেই। শ্বাস নেওয়ার জায়গা নেই। সমস্ত জায়গায় ঘরবাড়ি, বড় বড় দালানকোঠা তৈরি হয়েছে। ডিসি হিলের পাশাপাশি সিআরবিকে ঘিরে আমাদের সংস্কৃতির একটা প্রাণকেন্দ্র গড়ে উঠেছিল। তাও গ্রাস করে ফেলার চক্রান্ত চলছে। এত সুন্দর পরিবেশ কেন রুদ্ধ হবে? হাসপাতাল এখানে না করে, আরো তো জায়গা আছে, যেকোনো জায়গায় হোক। কিন্তু এখানে কোনোভাবেই নয়।
তিনি আরও বলেন, চট্টগ্রামের ঐতিহাসিক প্রাকৃতিক ঐতিহ্য, প্রাকৃতিক পরিবেশ, বন, পাহাড় ধ্বংস করে সিআরবিতে শুধু হাসপাতাল নয়, কোনো ধরনের স্থাপনাই করা যাবে না। হাসপাতাল, মেডিকেল কলেজ ও বিভিন্ন শিল্পের নামে পাহাড়, রেলওয়ের ভূমি দখলে ব্যবসায়ীদের ষড়যন্ত্র বন্ধ করতে হবে।
ড. অনুপম সেন
সিআরবি ধ্বংসের পাঁয়তারা প্রতিরোধ করতেই হবে
বিশিষ্ট সমাজবিজ্ঞানী প্রফেসর ড. অনুপম সেন বলেন, আমাদের শৈশব অর্থাৎ পঞ্চাশের দশক থেকে নগরীর সবচেয়ে দৃষ্টিনন্দন জায়গা হলো সিআরবি এবং এর আশেপাশের পাহাড়তলীর বেশ কিছুটা অঞ্চল। এক সময় সিআরবিতে প্রচুর লোক যেতেন, এখনও যান বিকেলের ভ্রমণে। বেড়ানোর জায়গা হিসেবে অনেকের কাছে পছন্দের জায়গা সিআরবি। আরেকটি ছিল পরীর পাহাড়। যেখানে উঠলে মনে হতো পুরো কর্ণফুলী নদীটা যেন চট্টগ্রাম শহরটাকে বেষ্টন করে রেখেছে। আরেকটা ছিল সদরঘাট, সাম্পানে করে মানুষ ঘুরতে যেত। পরীর পাহাড় আর সদরঘাট নষ্ট করে ফেলা হয়েছে।
তিনি বলেন, এখন শেষ যেটা আছে, সিআরবি, সেটাও ধ্বংস করার পাঁয়তারা চলছে। এরই মধ্যে ডিসি হিল অনুষ্ঠানের জন্য বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। সিআরবিতে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানগুলো হতো। অনুষ্ঠান করার মতো দৃষ্টিনন্দন এত বড় জায়গা তো চট্টগ্রামে আর নেই। আর যে হাসপাতাল করবে বলছে, এটা তো জনগণের হাসপাতাল নয়। এটা হবে ধনীদের হাসপাতাল। আমরা প্রতিনিয়ত পত্রিকায় পড়ি, ইউনাইটেডে লোক মারা যাচ্ছে। তারপরও ৫/৭ লাখ টাকা বিল না দিয়ে মরদেহ নিয়ে যেতে পারছে না। সিআরবিতে তো রেলওয়ে হাসপাতাল আছে। সেটাকে ঠিক করে নিক। এই একটিমাত্র জায়গা আছে, যেখানে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এখনও অবশিষ্ট আছে, যদিও এখন অনেকটা ম্লান। তারপরও যেটুকু আছে, এটিকে ধ্বংস করার জন্য কেন এই অপপ্রয়াস চালানো হচ্ছে?
ড. অনুপম বলেন, এ জায়গাটিকে চট্টগ্রাম শহরের ফুসফুস বলা হয়। এখানেই কিছু গাছ অবশিষ্ট আছে। আর সবখানে তো গাছের অস্তিত্বই চলে গেছে। চট্টগ্রামকে বলা হতো প্রকৃতির লীলাভূমি। যেখানে একই সাথে সাগর, নদী ও পাহাড় আছে। এ চট্টগ্রামে অনেকগুলো দীঘি ছিল, পুকুর ছিল। এখন নাই। চট্টগ্রাম শহরটাকে এখন একটা জঞ্জালের শহরে পরিণত করা হচ্ছে। ঢাকাতেও চট্টগ্রামের চেয়ে বেশি গাছ আছে এখন। চট্টগ্রামকে প্রকৃতির লীলাভূমি যে বলা হতো, তার কিছুটা টিকে রয়েছে সিআরবির কল্যাণে। সেটা ধ্বংস করার পাঁয়তারা যেকোনোভাবে প্রতিরোধ করতেই হবে।
মু. সিকান্দার খান
চরম আনইথিক্যাল জনগণকে ধোঁকা দেওয়া হচ্ছে
বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ প্রফেসর মু. সিকান্দার খান বলেন, এটা তো একটা জানা সমস্যা। অনেক দিন ধরে এরা এর পেছনে আছে। বাধা যে প্রথম আসছে বা তারা যে প্রথম উদ্যোগ নিচ্ছে তা না। বাধাগ্রস্ত হলে তারা কিছুদিন ঠান্ডা থাকে। এটা তাদের একটা কৌশল। আমরা দেখি এ কৌশলটা যারা নেন, সরকার সব সময় তাদের পক্ষে চলে যায়। পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপের নাম দিয়ে তারা করতে চাচ্ছে। এরা এ সমস্ত নতুন নতুন নাম দিয়ে করবে তো ইউনাইটেড। এ সমস্ত নাম দিয়ে আমাদের বোকা বানানোর চেষ্টা চলছে।
তিনি বলেন, সবাই ভাববে সরকারের সাথে পাবলিকের যোগসূত্র হচ্ছে, বিরাট ব্যাপার হতে চলেছে। কিন্তু এগুলো চোখে ধুলো দেওয়ার জন্য করা। তারা তো বাংলাদেশে বহু প্রজেক্ট করেছে। একটা উদাহরণ দিক তো, যেটা জনগণের কল্যাণে লেগেছে?
তিনি আরও বলেন, রেলওয়ের যারা কর্মকর্তা-কর্মচারী আছেন, তারাও বলছেন, রেলওয়ের তো নানা জায়গা নানা স্থানে পড়ে আছে। এত শান্ত পরিবেশটাকে নষ্ট করে কেন এই জায়গায় হাসপাতাল করার অনুমতি দেওয়া হচ্ছে? দেওয়া হচ্ছে, যাতে বড়লোকদের শহরের বাইরে যেতে না হয়। এখানে আপনি-আমি ভর্তি হতে পারব না। আমরা এর বিপক্ষে বলছি না। আমরা বলছি, রেলওয়ে তাদের অন্য কোনো জায়গায় এ ধরনের হাসপাতাল করার উদ্যোগ নিক। আমরা সকলেই যাব। কিন্তু তারা তা করছে না। আসল উদ্দেশ্য হচ্ছে স্বাস্থ্য ব্যবসা। এখন স্বাস্থ্য ব্যবসা, শিক্ষা ব্যবসা, নতুন কিছু ব্যবসা ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে, আগে যেগুলো ছিল না। এখন এগুলোই সবচেয়ে লাভজনক ব্যবসা।
সিকান্দার খান বলেন, ঠিক আছে হোক। কিন্তু এখানে কোনো মতেই নয়। আপনাকে ঘর থেকে বের করে দিয়ে, আমি আপনার ঘরে হাসপাতাল বানাব বললে হলো? জনগণের কথা বলে যে হাসপাতাল বানানোর কথা বলছেন, সেখানে আমজনতা যেতে পারবে না। এটা তো চরম আনইথিক্যাল একটা ব্যাপার। জনগণকে ধোঁকা দেওয়া হচ্ছে।
আবুল মোমেন
ইতিহাস ঐতিহ্যের অংশ, এখানে নতুন স্থাপনা নয়
কবি ও সাংবাদিক আবুল মোমেন বলেন, এখানে অনেকে মনে করছে যে, শতবর্ষী গাছ কাটা যাবে বলে আমরা আপত্তি করছি। বিষয়টা শুধু তা নয়। এখানে শতবর্ষী গাছগুলোসহ চট্টগ্রামের এই এলাকায় প্রাকৃতিক যে অবস্থান সেটি অক্ষুণ্ন রাখতে হবে। এখানে নতুন করে কোনো স্থাপনা নির্মাণ একেবারেই উচিত হবে না। সরকার যদি হাসপাতাল তৈরি করতে চায়, তাহলে সেখানে যে রেলওয়ে হাসপাতালটা আছে, নতুন কোনো স্থাপনা নির্মাণ বা নতুন জায়গায় না গিয়ে এই হাসপাতালটাকে আরও একটু উন্নয়ন করে পরিসরটা বাড়ানো যায়। সেখানে রেলওয়ের মানুষজন ছাড়াও সাধারণ মানুষকে সেবা দেওয়ার সুযোগ তৈরি করা উচিত।
তিনি বলেন, এ জায়গাটাতে প্রাকৃতিক পরিবেশটা একটা বড় ব্যাপার। আরেকটা হচ্ছে, এটার ঐতিহাসিক গুরুত্ব আছে। এটি ইতিহাস ঐতিহ্যের অংশ। এটাও রক্ষা করা দরকার আমাদের। হাসপাতাল হলে সেখানে বহু মানুষের সমাগম হবে। এ অঞ্চলের নির্জনতা, প্রাকৃতিক পরিবেশটা গাছ না কাটলেও বিনষ্ট হবে। সেখানে অ্যাম্বুলেন্স আসবে বিকট শব্দ করে, মানুষ আসবে রোগী নিয়ে, পাবলিক গাড়ি আসবে, আওয়াজ হবে। আর হাসপাতালকে কেন্দ্র করে সেখানে দোকানপাট গড়ে ওঠার সম্ভাবনাও রয়েছে। কারণ সব জায়গায় এটা দেখেছি। তৃতীয়ত হাসপাতালের বর্জ্য অপসারণের ভালো ব্যবস্থাপনা আমরা এখনও করতে পারছি না।
আবুল মোমেন বলেন, ইউনাইটেড যদি চট্টগ্রামে একটা হাসপাতাল করতেই চায়, সেক্ষেত্রে এভারকেয়ার যেমন শহরের এক প্রান্তে গিয়ে হাসপাতাল করেছে তাদেরও সেরকম করতে হবে। হাসপাতালের বিরোধী আমরা নই। হাসপাতাল হোক। কিন্তু এখানে নয়।