সাহসের উৎস : শহীদ আসাদ-মতিয়ুর

রেজাউল করিম | বুধবার , ২৭ জানুয়ারি, ২০২১ at ৭:৫২ পূর্বাহ্ণ

বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনে কিছু ধাপ রয়েছে। ’৫২, ’৬২, ’৬৬, ’৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থানের সিঁড়ি বেয়ে আসে ’৭০-এর নির্বাচন। আর ’৭১-এ নয় মাসের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মাধ্যমে আসে স্বাধীনতা।
’৬৯-এ আসাদ ও মতিয়ুর আমাদের স্বাধীনতাকে যথেষ্ট বেগবান করেছে। ‘গুচ্ছ গুচ্ছ রক্তকরবীর মতো কিংবা সূর্যাস্তের/ জ্বলন্ত মেঘের মতো আসাদের শার্ট/ উড়ছে হাওয়ায় নীলিমায়/ বোন তার ভায়ের অম্লান শার্টে দিয়েছে লাগিয়ে/ নক্ষত্রের মতো কিছু বোতাম কখনো/ হৃদয়ের সোনালী তন্তুর সূক্ষতায়
বর্ষীয়সী জননী সে-শার্ট/ উঠোনের রৌদ্রে দিয়েছেন মেলে কতদিন স্নেহের বিন্যাসে/ ডালিম গাছের মৃদু ছায়া আর রোদ্দুর- শোভিত/ মায়ের উঠোন ছেড়ে এখন সে-শার্ট/ শহরের প্রধান সড়কে/ কারখানার চিমনি-চূড়োয়/ গমগমে এভেন্যুর আনাচে কানাচে/ উড়ছে, উড়ছে অবিরাম/ আমাদের হৃদয়ের রৌদ্র-ঝলসিত প্রতিধ্বনিময় মাঠে/ চৈতন্যের প্রতিটি মোর্চায়/ আমাদের দুর্বলতা, ভীরুতা কলুষ আর লজ্জা/ সমস্ত দিয়েছে ঢেকে একখণ্ড বস্ত্র মানবিক / আসাদের শার্ট আজ আমাদের প্রাণের পতাকা।’ (আসাদের শার্ট ঃ শামসুর রাহমান)।
জানুয়ারি ২০, ১৯৬৯।
এদিন ছাত্র সংগ্রাম কমিটির ১১ দফা আদায়ের মিছিলে পুলিশের গুলিতে শহীদ হন আসাদ। তাঁর মৃত্যু ঊনসত্তরের ছাত্র-গণআন্দোলনের মোড় ঘুরে যায়। আইয়ুব খানের শাসন ও নিপীড়নমূলক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে গণঅভ্যুত্থানে পরিণত হয়।
আসাদ ছিলেন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের হল শাখার সভাপতি। ১৭ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলার সমাবেশ থেকে ১১ দফার বাস্তবায়ন এবং ছাত্র-জনতার ওপর পুলিশ ও ইপিআর বাহিনীর নির্যাতন ও বিশ্ববিদ্যালয়ের পবিত্রতা লঙ্ঘনের প্রতিবাদে কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম কমিটি ২০ জানুয়ারি পূর্ব পাকিস্তানের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পূর্ণ ধর্মঘট পালনের আহ্বান জানিয়েছিল। এ ধর্মঘট মোকাবিলার জন্য প্রশাসনের পক্ষ থেকে জারি করা হয় ১৪৪ ধারা। বিভিন্ন কলেজের ছাত্ররা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গনে সমবেত হয় এবং বেলা ১২টার দিকে বটতলায় এক সংক্ষিপ্ত সভা শেষে প্রায় দশহাজার ছাত্রের একটি মিছিল ১৪৪ ধারা ভেঙ্গে রাজপথে পা বাড়ায়। মিছিলটি চাঁনখা’র পুলের নিকটে তখনকার পোস্ট গ্রাজুয়েট মেডিক্যাল কলেজের কাছাকাছি এলে এর ওপর পুলিশ হামলা চালায়।
প্রায় ঘন্টাখানেক সংঘর্ষ চলার পর আসাদসহ কয়েকজন ছাত্রনেতা মিছিলটিকে ঢাকা হলের পাশ দিয়ে শহরের কেন্দ্রস্থলের দিকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলে একজন পুলিশ কর্মকর্তা খুব কাছ থেকে রিভলবারের গুলি ছুঁড়ে আসাদকে হত্যা করে। আসাদের মুত্যুর প্রতিক্রিয়ায় তাৎক্ষণিকভাবে বের হওয়া প্রায় দুমাইল দীর্ঘ মিছিলটি শহরের বিভিন্ন রাস্তা প্রদক্ষিণ করে শহীদ মিনারে এসে শেষ হয়।
আসাদের মৃত্যুতে কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম কমিটি গোটা পূর্ব পাকিস্তানে তিনদিনব্যাপী শোক ঘোষণা করে। এ ছাড়া কমিটি ঢাকা শহরে হরতাল এবং পরবর্তী চার দিন প্রতিবাদ মিছিলসহ নানা কর্মসূচি পালন করে। ২৪ জানুয়ারি হরতালে গুলি চললে ঢাকার পরিস্থিতি গভর্নর মোনেম খানের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। সরকারের দমন নীতি জনতাকে দাবিয়ে রাখতে পারে নি এবং শেষাবধি প্রেসিডেন্ট আইয়ুবের পতন ঘটে।
আসাদের শহীদান ঊনসত্তরের গণআন্দোলন গণঅভ্যুত্থানে রূপ নেয়। অনেক জায়গায় জনতা স্বতঃস্ফূর্তভাবে আইয়ুবের নামফলক নামিয়ে আসাদের নাম উৎকীর্ণ করে। এভাবে ‘আইয়ুব গেট’ হয়ে যায় ‘আসাদ গেট’, ‘আইয়ুব এভিনিউ’ নামান্তরিত হয়ে হয় ‘আসাদ এভিনিউ’। তখন থেকে আসাদের নাম হয়ে ওঠে নিপীড়নের বিরুদ্ধে সংগ্রামের মূর্ত প্রতীক।
আসাদ কেবল একজন ছাত্র সংগঠকই ছিলেন না, তিনি ছিলেন একজন কৃষক সংগঠকও। নরসিংদীর শিবপুর-হাতিরদিয়া-মনোহরদি ও পার্শ্ববর্তী এলাকাসমূহে তিনি একটি শক্তিশালী কৃষক সংগঠন গড়ে তুলেছিলেন। তিনি ছাত্র ইউনিয়নের কর্মীদের নিয়ে শিবপুরে একটি নৈশ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন।
শুধু ছাত্র ও কৃষক সংগঠনে অথবা গণশিক্ষা কার্যক্রমের মধ্যেই আসাদের রাজনৈতিক চিন্তা ও তৎপরতা সীমিত ছিল না। তিনি উন্নত রাজনৈতিকে আদর্শ বহনকারী একটি পার্টির প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল ছিলেন। ১৯৬৮ সালে লিখিত তাঁর ব্যক্তিগত ডায়েরিতে সর্বহারা শ্রেণির রাজনীতি পরিচালনার জন্য সংক্ষিপ্তভাবে স্টাডি সার্কেল গঠন করার কথা লেখা আছে। তিনি ছিলেন কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের পূর্ব বাংলার সমন্বয় কমিটির একজন অগ্রণী সংগঠক, যারা ১৯৬৮ সাল থেকেই সার্বভৌম ও শ্রেণিশোষণমুক্ত একটি দেশ গড়ার লক্ষ্যে কাজ করছিলেন।
জানুয়ারি ২৪, ১৯৬৯।
আসাদের মৃত্যুর মিছিলে ছিলেন মতিয়ুর। ষোল বছরের কিশোর, বাংলাদেশের ইতিহাসের সঙ্গে নিজের নাম লেখাল। এই কিশোর দেশের জন্য জীবন উৎসর্গ করল। দিনটি গণ-অভ্যুত্থানের দিন। এই দিনেই পাকিস্তানি স্বৈরশাসকের পেটুয়াবাহিনীর নির্মম বুলেটের আঘাতে ঢাকার রাজপথে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে এই সাহসী কিশোর। তার লাশ নিয়ে মিছিল হয়, ফুঁসে ওঠে পূর্ববাংলা।
যে বাংলাদেশ নির্যাতিত হয়ে, অত্যাচারিত হয়ে, সন্তান হারানোর বেদনায় কেঁদে কেঁদে চোখের জলবিধৌত যমুনা, পদ্মা আর মেঘনার সঙ্গে গড়িয়ে গড়িয়ে নেমে গেছে বঙ্গোপসাগরে! এই হারানো সন্তানেরই একজন এই অমর বালক মতিয়ুর। ‘ট্রাক ! ট্রাক ! ট্রাক/ শুয়োরমুখো ট্রাক আসবে/ দুয়োর বেঁধে রাখ/ কেন বাঁধবো দোর জানালা/ তুলবো কেন খিল / আসাদ গেছে মিছিল নিয়ে/ ফিরবে সে মিছিল/ ট্রাক ! ট্রাক ! ট্রাক / ট্রাকের মুখে আগুন দিতে/ মতিয়ুরকে ডাক/ কোথায় পাবো মতিয়ুরকে/ ঘুমিয়ে আছে সে / তোরাই তবে সোনামানিক/ আগুন জ্বেলে দে।’ (ঊনসত্তরের ছড়া ঃ আল মাহমুদ)।
বা-মা এই বালককে আদর করে ডাকতেন ‘মতি’। পুরো নাম মতিউর রহমান মল্লিক। জন্ম ঢাকায়। ১৯৫৩ সালের ২৪ জানুয়ারি। আশ্চর্য হচ্ছে মৃত্যুদিনও ২৪ জানুয়ারি। বাবা আজহার আলী মল্লিক। নিজের নামের শেষ অংশ পুত্রের নামের সাথে যুক্ত করে দিয়েছিলেন। বাবা ছোট্ট একটি চাকরি করতেন-ব্যাংক কর্মচারী। সামান্য বেতন। দারিদ্র্যের সংসার। তবু সন্তানদের শিক্ষিত করার অটুট মনোবাসনা তার। আদরের মতিকেও তিনি উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করার বাসনা নিয়ে বিদ্যালয়ে ভর্তি করিয়ে দিলেন। শ্যামলা রঙের পাতলা গড়নের ছোট্ট মতিউর ভর্তি হলেন নবকুমার ইন্সটিটিউশনে। দেখতে দেখতে সে উঠে গেল নবম শ্রেণিতে। পড়াশোনায় অত্যন্ত মেধাবী। মেধাবীরা বিজ্ঞান বিষয়ে পড়াশোনা করে। মতিউরও নবম শ্রেণিতে উঠে বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হলো। তখন বাংলাদেশে চলছে রাজনীতির উত্তাল সময়। মতিউর, শৈশব থেকেই দেখে আসছে ঢাকার রাজপথের উত্তাল তরঙ্গ। দেশের বিভিন্ন জায়গায় ভাষা শহীদদের স্মরণে প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে শহীদ মিনার, আর সেগুলো গুড়িয়ে দিচ্ছে পাকিস্তানি স্বৈরশাসক।
আসাদ-মতিয়ুর ইতিহাসের বিস্মৃত অধ্যায় নয়। তাদের রক্তের ধারাবাহিকতায় আসে বাংলাদেশের স্বাধীনতা। এই দুই বীরসৈনিককে জানাই গভীর শ্রদ্ধা। তাদের আদর্শ সোনার বাংলা বিনির্মাণে সাহস যোগায়।

পূর্ববর্তী নিবন্ধনতুন বছরের কবিতা
পরবর্তী নিবন্ধলুটেরা কারা, সংসদে প্রশ্ন জাপা এমপির