সার্কিট হাউজ সংলগ্ন মাঠকে সর্বজনীন নাগরিক মুক্তাঙ্গন ঘোষণার দাবি

পরিকল্পিত চট্টগ্রাম ফোরামের সংবাদ সম্মেলন

আজাদী প্রতিবেদন | মঙ্গলবার , ১৩ মে, ২০২৫ at ৫:৪৭ পূর্বাহ্ণ

উচ্ছেদ হওয়া নগরের কাজীর দেউড়ি সার্কিট হাউজ সংলগ্ন শিশু পার্কটির মাঠটিকে ‘সর্বজনীন নাগরিক মুক্তাঙ্গন’ ঘোষণার দাবি জানিয়েছে পরিকল্পিত চট্টগ্রাম ফোরাম। সংগঠনটির নেতৃবৃন্দ বলছেন, নগরের গোড়া পত্তনের সময় থেকে দীর্ঘকাল এই পরিসর উন্মুক্ত ছিল এবং নাগরিক জীবনের অংশ হিসেবে ভবিষ্যতেও এটি উন্মুক্ত থাকার দাবিদার।

গতকাল সোমবার চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে এ দাবি জানানো হয়। এতে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন ফোরামের সাধারণ সম্পাদক স্থপতি জেরিনা হোসেন। বক্তব্য রাখেন ফোরামের সভাপতি ইস্ট ডেল্টা ইউনিভার্সিটির সাবেক ভিসি মুহাম্মদ সিকান্দার খান, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ মনজুরুল কিবরিয়া ও অবসরপ্রাপ্ত অতিরিক্ত সচিব জাফর আলম।

জানা গেছে, ২০২৩ সালের ২৩ অক্টোবর পার্কটি সীলগালা করে জমির মালিক প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়কে বুঝিয়ে দেয় জেলা প্রশাসন। এর ১৩ মাস পর ২০২৪ সালের অক্টোবরে পার্কের জায়গাটিকে সবুজায়নের মাধ্যমে থিমপার্ক করার আগ্রহ দেখিয়ে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের (চসিক) অনুকূলে বরাদ্দ চেয়ে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব দেন মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেন। তবে এ ব্যাপারে এখনো সাড়া মেলেনি। এদিকে গতকাল সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে বলা হয়, অতি সমপ্রতি আমরা অত্যন্ত উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ্য করছি, এই মুক্তাঙ্গণের সীমানার ভেতরে মালিকানা দাবিমূলক কর্তৃত্ব এবং জনসাধারণের প্রবেশাধিকারের উপর নিয়ন্ত্রণমূলক নির্দেশনা রয়েছে। এরকম পরিস্থিতিতে নাগরিক হিসাবে আমরা শঙ্কিত বোধ করছি, কারণ জনপরিসরে এই ধরনের নির্দেশনা মনস্তাত্ত্বিক ভীতির সঞ্চার করে।

লিখিত বক্তব্যে বলা হয়, ১৯১৩ সালে ব্রিটিশ শাসনামলে নির্মিত সার্কিট হাউজের উন্মুক্ত পরিসরটি একটা সুচিন্তিত পরিকল্পনার মাধ্যমে, একটি জনবান্ধব নাগরিক মুক্তাঙ্গণে পরিণত করা হোক। সঙ্গত কারণেই সার্কিট হাউজের ঐতিহাসিক চত্বরে কোনরকম স্থাপনা নির্মাণ না করে একটা সর্বজনীন মুক্তাঙ্গণ হিসাবে ঘোষণা দেওয়া হোক।

জেরিনা হোসেন বলেন, চট্টগ্রাম মহানগরের জনসংখ্যার অনুপাতে উন্মুক্ত পরিসর উদ্বেগজনকভাবে সীমিত। ১৯৬১ সাল থেকে আজ পর্যন্ত প্রণীত সবগুলো মহাপরিকল্পনায় উন্মুক্ত পরিসরের পরিধি বাড়ানো ও এর যথাযথ সংরক্ষণের নির্দেশনা দেয়া রয়েছে। কারণ পার্ক ও অন্যান্য উন্মুক্ত পরিসর জীবনধারণের জন্য অতি প্রয়োজনীয় নগর সংযোজন। সার্কিট হাউজের সম্মুখ চত্বরটি মহাপরিকল্পনায় উল্লেখিত সেই ধরনের একটি উন্মুক্ত পরিসরযা জনস্বার্থেই উন্মুক্ত ও অবিকৃত রাখা প্রয়োজন। তিনি বলেন, এই পরিসর চট্টগ্রাম মহানগরের কেন্দ্র। এর অসাধারণ অবস্থান ও প্রকৃতিগত নগর সম্পদ হিসেবেও এর অপরিসীম গুরুত্ব রয়েছে। এটি চট্টগ্রাম নগরের একটি উল্লেখযোগ্য ল্যান্ডমার্ক হিসেবে গণ্য, যা একটি নগরের ভিজিবল ইমেজ হিসাবে নন্দিত ও পর্যটনে বিশেষ গুরুত্ব বহন করে।

লিখিত বক্তব্যে বলা হয়, সার্কিট হাউজ ও স্টেডিয়াম এলাকা ঘিরে চট্টগ্রামে যে সামাজিক মিথষ্ক্রিয়া পরিবেশ ছিল, অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনকভাবে ১৯৯৩ সালে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের এক অনাকাঙ্ক্ষিত সিদ্ধান্তের মাধ্যমে স্থানটি ব্যবসায়িক ভিত্তিতে ইজারা প্রদান করা হয়। সীমানা প্রাচীর ও স্থাপনা নির্মাণের মাধ্যমে এটি ধ্বংস হয়ে যায়। চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক কর্তৃক সেইসব অপরিকল্পিত স্থাপনা অপসারণ করা হলে জঞ্জালমুক্ত সার্কিট হাউজ ময়দান নিশ্চিতভাবে আবারও নগরবাসীকে উদ্বেলিত করেছিল। স্বাভাবিকভাবেই চট্টগ্রামবাসী পুনরায় পূর্বের সামাজিক মিথষ্ক্রিয়া ফিরে পাবার স্বপ্ন দেখেছে।

জেরিনা হোসেন বলেন, জেলা প্রশাসন অপরিকল্পিত স্থাপনা উচ্ছেদ করলে নগরবাসী আশাবাদী হয়েছিল। তখন পরিকল্পিত চট্টগ্রাম ফোরামের পক্ষ থেকেও স্থানটিকে উন্মুক্ত পরিসরে পরিণত করার অনুরোধ জানানো হয়েছিল।

মু সিকান্দার খান বলেন, শৈশব থেকে আমরা দেখেছি এটি ছিল উন্মুক্ত জনপরিসর। সব বয়সী মানুষ মুক্তির খোঁজে এখানে আসতেন। মাঝে পার্কের নামে এটি দখলে ছিল বলে এখন আর কেউ তা দখলে রাখবে, সেটা হয় না। তিনি বলেন, মালিকানা মানে সরকারিভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করার দায়িত্ব; যা কখনো উন্মুক্ত ছিল তা কেউ বন্ধ করতে পারে না। এটা সবার জন্য উন্মুক্ত রাখতে হবে। এখন যারা সরকারে আছেন, তাদের মধ্যে প্রধান উপদেষ্টাসহ অনেকেই এই মাঠের গুরুত্ব সম্পর্কে জানেন।

সিকান্দার খান বলেন, সেখানে আজ ঘেরা, কাল ফটক দেওয়া হচ্ছেএই খেলার দরকার নেই। তারা জনগণের পক্ষে থাকবেন এটাই আশা করব। এই শহরের সব জনপরিসর উন্মুক্ত করা হোক, শুরু হোক এই মাঠ দিয়ে।

জাফর আলম বলেন, মুক্তাঙ্গন ও জলাধার সংরক্ষণ আইন অনুসারে উন্মুক্ত স্থানগুলো মহাপরিকল্পনায় চিহ্নিত। চট্টগ্রাম নগরীর যত মহাপরিকল্পনা হয়েছে সবগুলো সরকারি গেজেটেড। আইন অনুসারে এসব জনপরিসরের শ্রেণি পরিবর্তন করা যাবে না। এটা আইনত অপরাধ। এমনকি ব্যক্তি মালিকানার জমিও যদি জনগণের ব্যবহারের জন্য উন্মুক্ত কখনো থেকে থাকে সেটাকে পরে বন্ধ করা যায় না।

সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন প্রকৌশলী এবিএমএ বাসেত, স্থপতি আহমেদ জিল্লুর চৌধুরী, অধ্যাপক নাজিম উদ্দিন, প্রকৌশলী শহীদুল ইসলাম ও পরিবেশবিদ তসলিমা মুনা।

জানা গেছে, জায়গাটির (শিশু পার্ক যেখানে গড়ে উঠে) আয়তন তিন একর। এর মূল মালিক প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়। ১৯৯২ সালের ১৩ জুলাই এটি চসিককে ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব প্রদান করা হয়। এরপর ১৯৯২ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর ‘ভায়া মিডিয়া বিজনেস সার্ভিসেস’ নামে একটি প্রতিষ্ঠানকে ২৫ বছরের জন্য ইজারা দেয় চসিক। তারা সেখানে শিশু পার্ক করে। ওই চুক্তির মেয়াদ শেষ হলে ২০২০ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি ১৫ বছরের জন্য ঢাকার ওই একই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ১৫ বছরের চুক্তি নবায়ন করে চসিক। মাঝখানে ২০০৮ সালের ২৮ জানুয়ারি প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় নিজেদের জমি ফেরত চান। সর্বশেষ চুক্তির শর্ত ভঙ করায় চসিককে জায়গাটি ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব প্রদান করে যে অনুমোদন দেয়া হয় তা ২০২৩ সালের ১৯ অক্টোবর বাতিল করে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়।

এরপর একই বছরের ২৩ অক্টোবর পার্কটি সীলগালা করে জমির মালিক প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়কে বুঝিয়ে দেয় জেলা প্রশাসন। অবশ্য এর আগে চসিকের অনুকূলে পার্কটির জায়গার বরাদ্দ বা লিজ বাতিল চেয়ে একই বছরের ২৩ আগস্ট প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব, ২৭ আগস্ট সামরিক ভূমি ও ক্যান্টনমেন্ট অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এবং চট্টগ্রাম সেনানিবাসের ইস্টার্ন সার্কেলের সামরিক ভূসম্পত্তি প্রশাসক বরাবর পৃথক তিনটি দাপ্তরিক পত্র দেন চট্টগ্রামের তৎকালীন জেলা প্রশাসক আবুল বাসার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামান। একই বছরের ১৩ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রাম সেনানিবাসের ইস্টার্ন সার্কেলের সামরিক ভূসম্পত্তি প্রশাসক বরাবর দেয়া আরেকটি পত্রে জায়গাটি জেলা প্রশাসনের অনুকূলে বরাদ্দ চাওয়া হয়। এতে জায়গাটিতে উন্মুক্ত স্থানসহ মুক্তিযুদ্ধের একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করার প্রস্তাব করা হয়।

পূর্ববর্তী নিবন্ধধানমণ্ডিতে গ্রেপ্তার সাবেক এমপি মমতাজ
পরবর্তী নিবন্ধরাউজানে মানিক হত্যা মামলার আসামি কায়সার গ্রেপ্তার