: কেমন শিক্ষক চাই এবং আমার স্কুল শিক্ষক।
: এখানে আমি আমার স্কুল জীবনের শিক্ষকের কথা বলছি। খুঁজছি তাঁদের। আমার স্কুল জীবনের বন্ধুদের নিয়ে বসেছি এই জন্য যে, তাঁদের নিকট আমার বা তাদের শিক্ষকদের তথ্য আছে কিনা। অনেক শিক্ষকের নাম এসেছে কিন্তু তাঁরা বেঁচে আছেন কিনা সে তথ্য কেউ জানেন না। আমরা লজ্জায় পড়ে গেলাম। ছাত্র শিক্ষক সম্পর্ক নিয়ে অনেকে মজার মজার কথা বলেছেন কিন্তু সে শিক্ষকদের কথা স্মৃতির অতলে পড়ে রয়েছে। হাতড়ে হাতড়ে প্রায় ২৫/২৬ জনের প্রকৃত নাম স্মরণে এনেছি বা আনতে পেরেছি। কয়েকজন শিক্ষকের নাম মনে করতে পারিনি তবে তাদের চেহারা স্মৃতির ফ্রেমে রয়েছেন। সেই ৪৮/৪৯ বছর আগে স্কুলে পর্ব শেষ করেছিলাম। বন্ধুদের সবাই ৬৫ বছরের কোঠায়। তাহলে বুঝুন আমাদের শিক্ষকদের বয়স কতো? বেঁচে থাকার কথাতো নয়। সৃষ্টিকর্তার মহিমায় দু’জন শিক্ষক এখনো বেঁচে আছেন। তাঁরা দু’জনই এখনো সরব। তাঁদের একজন সাধন চন্দ্র খাস্তগীর এবং অন্যজন সৈয়দ আবদুল খালেক। প্রথমজন পড়িয়েছেন হাই সেকশনে আর দ্বিতীয় জন প্রাইমারি সেকশনে। আরো ক’জনের সন্ধান চলছে তাঁরা বেঁচে আছেন কিনা জানতে। তবে বন্ধুরা এমনসব পুরানো স্মৃতি টেনেছেন যাকিনা প্রকৃত শিক্ষকদের প্রতিচ্ছবি চোখের সামনে ভেসে উঠলো। আমরা তখন ১৯৭১-এ, জ্বলছে আগ্রাবাদ, পুড়ছে আগ্রাবাদ। বাদামতলীর প্রতিরোধ ভেঙ্গে গেছে। সবাই যুদ্ধে যাওয়ার জন্য আত্মগোপন করে আছেন। ১ মার্চ থেকে ১ এপ্রিল আগ্রাবাদ তখন পাকিস্তান নৌবাহিনীর দখলে। মানুষ তারা মারছে পাখির মতো। আমাদের বই খাতাগুলো টেবিলে পড়ে রয়েছে। এমন সময় পাকিস্তানী সৈন্যদের তাড়া খেয়ে গোসাইল ডাঙ্গা এলাকা থেকে পালিয়ে এলেন অজিত কুমার দাশ। তাঁর বাসা তখন আগুনে পুড়ে গেছে। তিনি আশ্রয়ে এলেন। আমাদের অসহায় মুখ দেখে মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, পড়ার বই, নোটস্ খাতাগুলো যত্ন করে রেখে দেবে। এগুলো বেঁচে থাকলে কাজে লাগবে। বসানোর জন্য অনেক চেষ্টা করলাম কিন্তু তিনি সামনে এগুচ্ছেন। আরো ক’জন ছাত্র-ছাত্রী সামনে এসে দাঁড়ালেন। সবার হাত স্যারের পায়ে। স্যার আশীর্বাদ করে সবার মাথায় হাত রাখলেন। তারপর বসলেন। ইতোমধ্যে অনেক অভিভাবক খবর পেয়ে ছুটে এলেন। স্যার বোকা বোকা চেহারা নিয়ে বসেছিলেন। গোসাইল ডাঙ্গা, ফকির হাট এবং বন্দর এলাকায় বাঙালিদের করুণ মৃত্যুর বর্ণনা দিয়ে তিনি কাঁদলেন, আমরা কাঁদলাম এবং অভিভাকরা কাঁদলেন। চলে তাঁকে যেতেই হবে কারণ স্যার ছিলেন হিন্দু। পাকিস্তানীদের ভাষায় মালাউন। তিনি আমাদের জন্য দেবতা। স্যার চারদিকে তাকিয়ে করুণ কন্ঠে বললেন, বাঁচলে দেখা হবে- তবে বই এবং নোটস্ খাতাগুলো হেফাজতে রেখো। চলে গেলেন অদৃশ্য হয়ে। স্মৃতির পাতায় ভাসছিলো এ ধরনের শিক্ষকদের ত্যাগের তথা, ছাত্র-ছাত্রীদের প্রতি তাঁদের দায়িত্ববোধের কথা। তখনতো নকল ছিলো না। তারপরেও কিছু অতি সাহসী শিক্ষার্থী দু’একজন টোকাটুকি করতেন। তাদেরকে এস এস সি পাস করানোর জন্য শিক্ষকরা ছিলেন নিবেদিত। কোন শিক্ষক-শিক্ষিকা শ্রেণিকক্ষে ফাঁকি দিচ্ছেন তা কিন্তু শিক্ষার্থীরা ধরে ফেলতে পারতো। তাছাড়া নিবেদিত শিক্ষকরা ছিলেন বলেই এখনো তারা আমাদের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার আদর্শ। মনে পড়ে তাঁদের। যাদের নাম মনে পড়ছে তাদের ক’জন ছিলেন আলী আশরাফ, আবদুল মতিন, শামসুল হক, ফজলুল হক মজুমদার, রফিক উল্লাহ, প্রীতিশ ভাট্টাচার্য, পি কে দত্ত, দীপক কুমার ঘোষ, শাহাবুদ্দিন মজুমদার, আবদুল আউয়াল, রশিদ আহমদ, মোস্তাক আহমদ, মহিউদ্দিন খান, মো. আবদুর রশিদ, মৌ. আসমত উল্লাহ, হারুন-অর-রশিদ, আবদুল করিম, মহিউদ্দিন আহমদ, আবু হাফিজ, আকতার উদ্দিন, লুৎফুর রহমান, হরনাথ বাইন, আলী আজগর, মোহাম্মদ আলী, লস্কর স্যার, আজিজ স্যার, নিবেদিতা ব্যানার্জী, গৌরিসেন, রমা দত্ত, রোকেয়া বেগম, লতিকা বড়ুয়া, শান্তি দাশ, নুর মোহাম্মদ, গোপাল বাবু, শফি উদ্দিন (স্কাউট টিচার) মনোয়ারা বেগম, হেদায়েত উল্লাহ খান প্রমুখ।
অনেকজন শিক্ষকের নামতো মনে করতে পারিনি। বারবার বন্ধুরা অনেকের নাম উচ্চারণ করে চোখ মুছে স্বাভাবিক হতে চেয়েছিলেন কিন্তু পারেননি। রফিক উল্লাহ ও প্রীতিশ স্যারের ইংরেজি, দীপক কুমার ঘোষ গণিত এবং শাহাবুদ্দিন স্যারের গণিতের কথা সবার মুখে ছিলো। তবে সাধন চন্দ্র খাস্তগীর স্যার যেমন বাংলা পড়াতেন, তেমনি ইংরেজি। আরো মজার কথা ছিলো যে, তিনি অভিনয় করে পড়াতেন। ফলে তার শ্রেণিতে সব সময় ছাত্র-ছাত্রী মজা পেতেন বেশি। পড়াতে গিয়ে তিনি চোখ, মুখ, মাথা এবং পা এমন করে দোল খাওয়াতেন তা দেখে প্রতিজন শিক্ষার্থী হেসে কেঁদে কুটি কুটি হয়ে যেতেন। শ্রেণিকক্ষে তিনি যেমন অভিনয় করে, মজা করে পড়াতেন ঠিক তেমনি মঞ্চে ছিলেন বেশ সরব। স্কুলের বার্ষিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে খাস্তগীর স্যার এবং অজিত স্যার মঞ্চ নাটকে অভিনয় করতেন। এদের কথাতো ভুলার নয়। এমন শিক্ষকদের কথাতো এপরিসরে শেষ করা যাবে না, তবে বিস্তারিত তথ্য দেওয়ার চেষ্টা করবো ‘আমার স্কুল শিক্ষক’ গ্রন্থে, খাস্তগীর স্যার এখনো মাথার ছায়া হয়ে রয়েছেন।
তাঁদের ত্যাগের কথা বলি। কিছু শিক্ষক ছিলেন যারা বাসায় গিয়ে ছাত্র-ছাত্রীদের তদারকী করে নির্দেশনা দিতেন। একাজগুলো পরীক্ষার পূর্বে অথবা ৮ম শ্রেণির বৃত্তি পরীক্ষা, এস এস সি পরীক্ষার পূর্ব সময়ে। এজন্য কোন অভিভাবক স্যারদের টাকা দিয়ে সম্মান দেখাতে চাইলে উল্টো রেগে যেতেন। আমাকে দিয়ে বুঝেছি আমার শিক্ষকরা কেমন ছিলেন? শ্রেণির শিক্ষার বাইরে শিক্ষকদের কেউ কেউ আমাদের সাথে খেলাধুলা করতেন, মজা করতেন, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করতেন। এগুলো বছরের শুরুতে স্কুল শিক্ষার অংশ ছিলো। বিশেষ করে বার্ষিক পিকনিককে শিক্ষকরা শিক্ষা সফরের মর্যাদায় আনতেন, কোথায় যাবেন কেন যাবেন সে সম্পর্কে ধারণা দিতেন। আমরাতো ১৯৬৮ থেকে ১৯৭১ এর বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রোডাক্ট। তাই আন্দোলন সংগ্রামে শিক্ষকদের মৌলিক সমর্থন ছিলো। তাদের চোখের ভাষায় আমাদের সতীর্থ ছোট বড় সবাই ছিলাম বঙ্গবন্ধু ও বিপ্লবী আগ্রাবাদের অংশ। ছাত্রলীগ এবং ছাত্র ইউনিয়ন ছিলো সতীর্থদের ভালোবাসার ছাত্রসংগঠন। তবে ১৯৭০-১৯৭১ এসে ছাত্রলীগ একক ছাত্রসংগঠনে পরিণত হয়। আমরা সে সংগঠনের ছায়া সঙ্গী এবং ১ মার্চ থেকে ৩০ মার্চ পর্যন্ত ছিলেন ছাত্র-শিক্ষক সবাই প্রতিরোধে। তারপর স্বাধীনতা যুদ্ধ। বিচ্ছিন্ন সবাই। ফিরে এসেছেন ৯ মাস পর কিন্তু বিজয়ের মধ্যেও ছিলেন করুণ কান্না। কতোজন হারিয়ে গেছেন তাদের খবর রাখা হয়েছিলো কিন্তু অভিজ্ঞতা ও দুর্বল মন ও মানসের কারণে এখন সবই স্মৃতি। এখন হাতড়ে ফিরছি অতীত সতীর্থ ভাই-বোন ও শিক্ষকদের স্মৃতিতে। এখন মনে পড়ছে সেই বাংলা, ইংরেজি, গণিত ক্লাশের শিক্ষকদের। জটিল আরবি ও উর্দুর ক্লাসগুলো এখনো হাসির খোরাক হয়ে রয়েছে। রাজনীতির অপপ্রয়োগের ফলে আমার উর্দুভাষী সতীর্থকে বিচ্ছিন্ন দ্বীপে পাঠিয়ে দিয়েছি। এখনো তাদের ক’জন সতীর্থ ভাই-বোনকে চোখে ভাসছে। আমার স্কুল আগ্রাবাদ স্কুল প্রতিষ্ঠা ১৯৫৩ থেকে ১৯৭১ পর্ব সজনে বিজনে এখনো কাঁদায়, এখনো হাসায়। আমার ১৯৭১ দেশের জন্য, সময়ের জন্য গৌরবের। আমাদের শিক্ষক, আমার শিক্ষক স্মৃতি ও প্রীতিতে রয়েছেন। দোয়া করি যাঁরা এখনো আছেন তাঁরা যেন সুস্থ থেকে আরো দীর্ঘজীবী থাকুক এবং প্রয়াতদের রূহ এবং আত্মার শান্তি কামনা করছি।
লেখক: গবেষক ও কলামিস্ট।