: মুসলিম হাই স্কুল, লালদিঘি ময়দান এবং স্কুলের প্রথম মহিলা প্রধান শিক্ষক।
: স্কুলের ছাত্র শিশুরা গর্ব করে বলছিলো… জানো আমাদের স্কুলে নতুন ম্যাডাম প্রধান শিক্ষক এসেছেন। পাশের ছাত্রটি চোখ বাঁকা করে বলেছে, ম্যাডাম প্রধান শিক্ষক মানে? বুঝনি অর্থাৎ মুসলিম হাই স্কুলে বর্তমান প্রধান শিক্ষক হচ্ছেন আমাদের আয়েশা ম্যাডাম (আয়েশা খাতুন) স্কুলের ইতিহাসে ৩৬তম প্রধান শিক্ষক অর্থাৎ প্রথম মহিলা প্রধান শিক্ষক। স্কুলের ইতিহাসে রক্ষণশীলতার অর্গল ভাঙ্গলো, শিক্ষা, সাহিত্য, সংস্কৃত ও মানবপ্রেমে লিঙ্গের কোন পার্থক্য নেই। শুধুই মানুষ। যতোদূর জেনেছি মনে হচ্ছে নতুন প্রধান শিক্ষক সহকর্মীদের সহমর্মী সমর্থন পেয়েছেন। শিক্ষক হিসেবে তাঁরা পুরুষ মহিলা বিচার করেননি। নতুন মহিলা প্রধান শিক্ষককে বরণ করেছেন প্রকৃত শিক্ষক সুলভ মানবিকতায়। সময় বদলেছে একটা সময় ছিলো মুসলিম হাই স্কুলে মহিলা প্রধান শিক্ষক আদৃত ছিলেন না। এমন নজির খুব বেশি দিনের নয়। একজনতো এই স্কুলে প্রধান শিক্ষক হয়ে যোগদান করতে পারেননি শুধু মহিলা বলে। সে মানসিকতার পরিবর্তন এসেছে। সে প্রমাণতো নতুন মহিলা প্রধান শিক্ষক আয়েশা খাতুন। তিনি ১৯০৯-২০২১ অর্থাৎ ১১২ বছরের ঐতিহ্যের সাথে নতুন ঐতিহ্যযুক্ত করে ৩৬তম স্থানটি পূরণ করেছেন। শুভ কামনা শিক্ষাবিদ আয়েশা খাতুন এর জন্য।
: প্রতিষ্ঠার সংক্ষিপ্ত ইতিহাস।
: ১৮৩৪ খ্রিস্টাব্দে লর্ড ম্যাকলের শিক্ষা সংস্কার নীতির প্রেক্ষিতে চট্টগ্রামে উচ্চ শিক্ষার প্রসার ঘটে। এর আগে চট্টগ্রামে শিক্ষার ভিত ছিলো মক্তব, টোল বা পাঠশালা কেন্দ্রিক। প্রাথমিক শিক্ষার ভিত রচিত হয়নি। তারপর চট্টগ্রামের শিক্ষানুরাগী কিছু ধনাঢ্য মানুষ শিক্ষার জন্য উদ্যোগী হলেও সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার কারণে চট্টগ্রাম ছিলো শিক্ষায় পিছিয়ে। লর্ড ম্যাকলের শিক্ষা সংস্কার নীতির ফলে চট্টগ্রামে প্রতিষ্ঠিত হয়,
১. দি চিটাগাং জিলা স্কুল ১৮৩৬ খ্রিস্টাব্দে।
এই স্কুলটি প্রতিষ্ঠিত হয় চট্টগ্রাম কলেজের বর্তমান স্থানে পর্তুগিজদের একটি স্থাপনায়। পরে ১৮৬৯ খ্রিস্টাব্দে চট্টগ্রাম কলেজ প্রতিষ্ঠিত হলে জিলা স্কুল কয়েকটি স্থান পরিবর্তন করে আইস ফ্যাক্টরি রোডে স্থায়ী হয় এবং তখন থেকে এর নামকরণ হয় কলেজিয়েট স্কুল। এর ৭৩ বছর পর ১৯০৯ খ্রিস্টাব্দে মুসলিম হাই স্কুল প্রতিষ্ঠা পায়। ঐখানেও একটি ইতিহাস রয়েছে। ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দে পলাশী যুদ্ধের পর ব্রিটিশরা পর্যায়ক্রমে পুরো ভারতবর্ষ দখলে নিয়ে যায়। মুসলমান এবং ভারতবাসী শিক্ষা ও সংস্কৃতি থেকে পিছিয়ে পড়ে। অন্যদিকে মুসলমান সমাজ ইংরেজদের গ্রহণ করতে পারেনি এবং তারা শিক্ষায় রক্ষণশীল মানসিকতায় এগিয়ে চলে। যুগের পর যুগ মুসলমান সমাজ ছিলো রক্ষণশীল মানসিকতায়। সেসময় ভারত উপমহাদেশে জন্ম নেয় একজন দানবীর মুহম্মদ মুহসিন (হাজী মুহম্মদ মুহসিন) তিনি ছিলেন প্রচুর সম্পদের মালিক। তিনি বেঁচে ছিলেন প্রায় (১৭৩২ থেকে ১৮১২) খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত। বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে তাঁর অর্থে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘মুসলিন ফান্ড’। তাঁর এই ফান্ডের মৌলিক বৈশিষ্ট্য ছিলো মুসলমানদের শিক্ষায় সহায়তা দেওয়া। এই ফান্ড ছিলো ওয়াক্ফ করা। এই ফান্ডের অর্থে যে প্রতিষ্ঠানগুলো এ বাংলায় প্রতিষ্ঠিত সেগুলোর আংশিক তথ্য,
১. হুগলি মুসলিম হাই স্কুল
২. ঢাকা মুসলিম হাই স্কুল
৩. চট্টগ্রাম মুহসিনিয়া মাদ্রাসা (বর্তমান হাজি মুহম্মদ মহসিন কলেজ)
৪. চট্টগ্রাম হাজি মুহম্মদ মুহসিন হাই স্কুল
৫. চট্টগ্রাম মুসলিম হাই স্কুল।
উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, মুহসিনিয়া মাদ্রাসার অধ্যক্ষের সার্বিক তত্ত্বাবধানে ‘এ্যাংলো-পার্সিয়ান ডিপার্টমেন্ট’ হিসেবে মুসলিম হাই স্কুলের ভিত রচিত হয়। ১৯০৯ খ্রিস্টাব্দে স্কুলটি পূর্ণাঙ্গ স্কুল হিসেবে কোতোয়ালী এলাকায় পুর্তগিজদের পরিত্যক্ত দো’তলা ভবনে স্থানান্তরিত হয় এবং ১৯১০ খ্রিস্টাব্দে স্কুলটি মুসলিম হাই স্কুল হিসেবে প্রতিষ্ঠা পায়। সে হিসেবে স্কুলটির প্রতিষ্ঠার বয়স ১১২ বছর। স্কুলটির বর্তমান নাম গভর্মেন্ট মুসলিম হাই স্কুল।
: স্কুলের আরো কিছু প্রাসঙ্গিক তথ্য।
: গভ: মুসলিম হাই স্কুলের আরো অনেক ইতিহাস ঐতিহ্য রয়েছে। পরে সময় মতো পরিপূর্ণ ইতিহাস তুলে ধরার চেষ্টা করবো। এখন বলি লালদিঘি মাঠটি মুসলিম হাই স্কুলের। ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দে প্রধান শিক্ষক ছিলেন মৌ. আবদুর রহমান (১৯৩৭-১৯৪৯) তিনি জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মি. জেমিসন সাহেবের নিকট ছাত্রদের খেলার জন্য লালদিঘি মাঠটি স্কুলের জন্য বরাদ্দ চেয়েছিলেন। তিনি স্কুলের জন্য মাঠটি বরাদ্দ দিয়েছিলেন। সেই থেকে মাঠটি স্কুলের সার্বিক তত্ত্বাবধানে চলছে। এই মাঠের ইতিহাস ঐতিহ্য বাংলাদেশের স্বাধীনতার সঙ্গে প্রত্যক্ষ জড়িত। ইতিহাস তথ্য দেয়
১. ১৯৫২’র ভাষা আন্দোলনে ঢাকায় ছাত্র হত্যার প্রতিবাদে ২৩ মার্চ এই মাঠে একুশে প্রথম কবিতা ‘কাঁদতে আসিনি ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি’ পাঠ করা হয়েছিলো।
২. ১৯৫২’র ভাষা আন্দোলনে পরদিন এই মাঠ সংলগ্ন পশ্চিম পাশে ভিক্টোরিয়া পার্কে প্রথম শহিদ মিনার নির্মাণ হয়েছিলো।
৩. ১৯৬৬’র ২৫ মার্চ এই মাঠে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ৬ দফা কর্মসূচি ঘোষণা করেছিলেন।
৪. ১৯৬৬’ খ্রিস্টাব্দে এম.এ. আজিজ এ মাঠকে মুজিব পার্ক ঘোষণা করেছিলেন।
৫. চট্টগ্রামের প্রতিটি আন্দোলন এবং অন্যায়ের প্রতিবাদ হয়েছে এই মাঠে, বিশেষ করে ১৯৫২ থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত।
৬. ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের ২৩ মার্চ ছাত্রদের গার্ড অব অনার ও সালাম নিয়েছিলেন মৌ. সৈয়দ আহমদ ও এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী।
৭. ১৯৭১ এর ২৫ মার্চ আওয়ামি স্বেচ্ছাসেবক দলের গার্ড অব অর্ডার নিয়েছিলেন জহুর আহমদ চৌধুরী, এম.আর. সিদ্দিকী, শেখ মোজাফ্ফর আহমদ ও ডা. নুর নাহার জহর।
এই লালদিঘি মাঠের প্রকৃত মালিক মুসলিম হাই স্কুল। একটা সময় ছিলো বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান মাঠ ব্যবহারের জন্য স্কুল প্রধানের নিকট দরখাস্ত করে মাঠ চাইতেন। ভাড়া দিতে হতো ১৫০০ টাকা। সে টাকা জমা হতো সরকারি ট্রেজারিতে। এখন কি সে নিয়ম বলবৎ আছে? এখন মাঠে পার্ক হচ্ছে। মাঠকে ইতিহাসের উপযোগী করার চেষ্টা এটাতো ভালো কথা কিন্তু মাঠ রেখেই করা উচিত। এতো পার্ক কেন? চট্টগ্রামে আগ্রাবাদ জাম্বুরি মাঠকে পার্ক করে অন্তত: ৫ লক্ষ মানুষের খেলার স্থান বন্ধ করে দিয়েছে। যেখানে খেলোয়াড় হওয়ার কথা সেখানে হচ্ছে মাস্তান তৈরি। খেলার সুযোগ নেই বলে ছেলেরা নেতিবাচক পথে চলে গেছে। এজন্য দায়ী প্রতিটি সরকার এবং সংশ্লিষ্টরা। আমরা আর পার্ক চাই না। আমরা চাই মাঠ। ইতিহাস সংরক্ষণের নামে মাঠকে হত্যা করা হলে মানুষ কাউকে ক্ষমা করবেনা। লালদিঘি মাঠের ঐতিহ্য রক্ষা করে, ইতিহাস তুলে ধরে মাঠ রক্ষার আহ্বান জানাচ্ছি। একই সাথে গত ২১ জানুয়ারি তারিখে এই পত্রিকায় সাংবাদিক, বীর মুক্তিযোদ্ধা নাসির উদ্দিন চৌধুরীর লেখা ‘ইতিহাসকে কবর দিয়ে লালদিঘি মাঠে পার্ক চাইনা’ লেখার প্রস্তাব সমর্থন করছি। আহ্বান জানাচ্ছি এর পক্ষে সবাই ইতিবাচক ভূমিকা রাখুন। মুসলিম হাই স্কুল এবং লালদিঘি মাঠ সমান মর্যাদায় থাকুক।
তথ্য: ১. মো. গোলাম মোস্তফা- গভ. মুসলিম হাই স্কুল চট্টগ্রাম, সংক্ষিপ্ত ইতিহাস।
২. নাসির উদ্দিন চৌধুরী- ইতিহাসকে কবর দিয়ে লালদিঘি মাঠে পার্ক চাই না।
৩. স্মৃতির পাতায় চট্টগ্রাম কলেজ- মর্জিনা আখতার।
লেখক: গবেষক ও কলামিস্ট।