: প্রফেসর মোহাম্মদ খালেদ।
: সুফিতত্ত্বের গবেষক সৈয়দ আহমদুল হক মনীষীদের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছিলেন, তিনি সম্মানিত হয়েও অত্যধিক হৃষ্ট হন না, অপমানিত হলেও ক্রোধ করেন না এবং ক্রুদ্ধ হলেও রূঢ় বাক্য বলেন না। মেথু আর্নল্ডের ভাষায়, Sweetness within sweetness without, Perfection within and perfection without…। মৌলানা রুমী এরকম মানুষকে স্বচ্ছ আয়নার সঙ্গে তুলনা করেছেন। প্রফেসর মোহাম্মদ খালেদ ছিলেন এমন একজন স্বচ্ছ আয়নার মতো মানুষ।
আজকে প্রফেসর খালেদ-কে নিয়ে এমন আলোচনায় যাবো না। তবে একটি মজার কথা দিয়ে তাঁকে নিয়ে কিছু কথা বলছি। সবাই জানেন তিনি ১৯৭০ এর সাধারণ নির্বাচনে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের (এম এন এ) নির্বাচিত হয়েছিলেন। এই নির্বাচন ছিলো কড়িহীন প্রার্থীর বিপরীতে কড়িভর্তি প্রার্থীর নির্বাচন। গাড়ির বহরের বিপরীতে সাইকেল ও নৌকা বহরের নির্বাচন, উচ্চ উগ্রকন্ঠের বিপরীতে বিনয়ী মানুষের নম্র ব্যবহারের নির্বাচন। শুধুমাত্র দেশপ্রেম, মাটি মানুষের ভালোবাসায় প্রফেসর মোহাম্মদ খালেদ সে নির্বাচনে জয়ী হয়েছিলেন। ভোটের ব্যবধান ছিলো এতো বেশি যা ছিলো কল্পনার বাইরে, যদিও তখন আওয়ামী লীগ এই প্রার্থীকে রাখা হয়েছিলো খরচের খাতায় অর্থাৎ তিনি নির্বাচনে বিজয়ী হতে পারবেন না। কিন্তু তার যোগ্যতা, কর্মীবল, জনগণের স্নেহ ভালোবাসায় তিনি পাকিস্তান রাজনীতির মধ্যমণিতে পরিণত হয়েছিলেন। কারণ- তিনি যাকে পরাজিত করেছিলেন তিনি ছিলেন পাকিস্তানের প্রাক্তন ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট, পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের স্পিকার এ কে ফজলুল কাদের চৌধুরী। তার পরাজয় এবং খালেদ সাহেবের বিজয় ছিলো তৎকালীন পাকিস্তানের আলোচনার বিষয়। এখানে একটি কথা বলা প্রয়োজন যে, নির্বাচনে প্রফেসর খালেদ বিজয়ী হওয়ার সংবাদে বঙ্গবন্ধু তাৎক্ষণিক তাজউদ্দিন আহমদ কে জড়িয়ে ধরে উচ্চ কন্ঠে বলেছিলেন, আমার প্রফেসর জিতেছে আমার খালেদ জিতেছে (তথ্য ডা. জাকেরিয়া চৌধুরী)
: এবারে জয়ের কথাগুলো অন্যদিকে নিয়ে যেতে চাই।
: তখন পশ্চিম পাকিস্তানে অনেক বাঙালি ছিলেন। তারা প্রফেসর খালেদ কে শুভেচ্ছা জানিয়ে বার্তা পাঠালেন, কথা বললেন। তাঁকে পশ্চিম পাকিস্তানে যাওয়ার আমন্ত্রণ জানালেন। তখন তাঁর ব্যস্থতা ছিলো খুবই বেশি। তিনিতো নির্বাচিত হয়ে গেছেন এখন তাঁর দায়কি? তিনি নির্বাচনের সময় যেমন করে পুরো নির্বাচনী এলাকা লুঙ্গি পরে সাধারণ পোশাকে মানুষের বাড়ি বাড়ি ঘুরে বেড়িয়েছিলেন ভোটের জন্য। এবার তিনি পুনরায় পথে নামলেন জনগণের কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করার জন্য। তাঁর সেই সাইকেল বাহিনী, নৌকার মাঝি বাহিনী, সর্বস্তরের নেতা কর্মীরা পুরো নির্বাচনী এলাকায় ঘুরে মানুষের দোয়া চাইলেন। মানুষ খুবই খুশি হলেন।
পশ্চিম পাকিস্তানে যাওয়ার চাপ বাড়লো। বঙ্গবন্ধুকে তিনি সব জানালেন। বঙ্গবন্ধু বললেন, প্রফেসর করাচির বাঙালিরা আমাকে অনুরোধ করেছেন তোমাকে তারা দেখতে চায়। আমাকে যেতে অনুরোধ করেছেন। আমিতো এখন ঢাকা ছাড়তে পারছিনে তুমি গিয়ে মানুষের আশা পূরণ করে এসো (তথ্য ডা. জাকারিয়া চৌধুরী) প্রফেসর খালেদ গেলেন করাচিতে। সফর হবে মাত্র ২ দিনের। তিনি করাচি যাচ্ছেন এতথ্য আওয়ামী লীগ পশ্চিম পাকিস্তানী কিছু নেতাকে জানিয়ে রেখেছিলেন এবং তাঁর নিরাপত্তার কথাও প্রশাসনকে জানিয়ে রেখেছিলো আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে। সেদিন ছিলো ২৫ ডিসেম্বর ১৯৭০ খ্রিস্টাব্দ। করাচি বিমান বন্দর থেকে রাউজানের কিছু প্রবাসী তাঁকে নিয়ে গেলেন একটি আন্তর্জাতিক মানের হোটেল। (নাম মনে করতে পারছিনা) সময় তখন প্রায় ২টা। ইতোমধ্যে প্রচুর বাঙালি লবিতে জড়ো হয়েছে। জয় বাংলা শ্লোগান হোটেলের লবি জুড়ে। সবাই তাঁকে দেখতে চায়, ছবি তুলতে চায়। তিনি তাঁর স্বাভাবিক পোশাকে সবার সামনে উপস্থিত হলেন। সালাম শুভেচ্ছা বিনিময় হয়েছে। তাঁর পোষাক ছিলো সাদা পায়জামা, সাদা কোর্তা এবং একটি কালো কোট, পায়ে ছিলো কালো রং এর পামসু। পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ বিশেষ করে চট্টগ্রামের মানুষ, রাউজানের মানুষ তাঁর জীবনযাত্রা সম্বন্ধে জানেন। তবে বিস্ময়ের সৃষ্টি করেছিলেন পশ্চিম পাকিস্তানী মানুষের চোখে মুখে। এতো সাধারণ একজন মানুষ কেমন করে ফজলুল কাদের চৌধুরীকে পরাজিত করলেন? তারা ভেবে কুল পাচ্ছিলেন না। বিভিন্ন দলের মানুষ সাধারণ মানুষ এলেন দেখলেন, ছবি তুললেন। লবিতে তিনি জনতার উদ্দেশ্যে সংক্ষিপ্ত বক্তব্য রাখলেন। মানুষ জানতে চেয়েছিলো কেমন করে তিনি ও তাঁর দল পাকিস্তানের প্রাক্তন ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট, জাতীয় পরিষদের প্রাক্তন স্পিকারকে পরাজিত করলেন। তিনি ফজলুল কাদের চৌধুরীর প্রশংসা করে সুন্দর বক্তব্য দিয়েছিলেন। তাঁর সমালোচনা করেননি। শুধু বলেছিলেন বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব জনগণের ভালোবাসা, কর্মী বাহিনীর ত্যাগে তিনি জয়ী হয়েছিলেন। তাঁকে কয়েকটি সভায় বক্তৃতা দিতে হয়েছিলো। এতো মানুষের সমাগম হয়েছিলো তা ছিলো আশাতীত।
চট্টগ্রাম ফিরে আসার পর তিনি দৈনিক আজাদী কার্যালয়ে (আন্দরকিল্লাহ) আড্ডায় বসেছিলেন। তার পশ্চিম পাকিস্তান সফরের কথাগুলো মজা করে বলছিলেন। কতোমানুষ তাঁকে দেখতে এসেছিলেন এমন প্রশ্নের জবাবে প্রফেসর খালেদ মজা করে বলেছিলেন, যাঁরা আমাকে দেখতে এসেছিলেন তারা যদি আমাকে আট আনা পয়সা করে দিতেন তাহলে আমার নেতা কর্মীরা নির্বাচনে তাদের পকেট থেকে খরচের টাকাগুলো ওঠে আসতো। তিনি মজা করে বললেও এটা প্রমাণ হয়েছিলো যে তিনি মানুষের শ্রদ্ধা অর্জন করতে পেরেছিলেন। পশ্চিম পাকিস্তানের কেউ বলেছিলেন, তাদের ধারণা ছিলো তিনি কোন জমিদার বা জমিদারের ছেলে ছিলেন অথবা অনেক বড় কোন শিল্পপতি ছিলেন অথবা বড় ধরনের ব্যবসায়ী ছিলেন। তাইতো তিনি প্রচুর অর্থ ব্যয় করে জনাব চৌধুরীকে পরাজিত করতে পেরেছিলেন। তাকে দেখার পর সবার ধারনা পাল্টে গেলো।
: প্রফেসর খালেদ ও তাদের ঝানু সংসদ।
: তাদের একটা ঝানু সংসদ ছিলো রাউজানে। সে সংসদের ক’জন বন্ধু ছিলেন সাধন কুমার ধর, ডা. জাকেরিয়া চৌধুরী, যৌতিশ চন্দ্র ধর, আবুল কাশেম, জালাল আহমেদ, মোহাম্মদ খালেদ (তিনি অন্য একজন খালেদ, ব্যাংকার) নুরুল আলম চৌধুরী ও আরো ক’জন। তারা ছিলেন তাঁর নাটকের সঙ্গী, সৃজনশীল কাজের সঙ্গী এবং তার রাজনৈতিক কর্মক্ষেত্রের বন্ধু। ’৭০ এর নির্বাচনে তারা নিজেদের অর্থে প্রফেসর খালেদ সাহেবের জন্য নির্বাচনে উজাড় করে দিয়েছিলেন। এই মানুষগুলো এম.এন.এ খালেদ সাহেবের নিকট কোন সুযোগ নেওয়ার জন্য আসেননি। তবে সময় সুযোগ পেলে তারা গ্রামে এবং শহরে কারো না কারো বাসায় আড্ডায় বসতেন। তাদের গুণ ছিলো যে, তারা প্রায়ই সবার খবর রাখতেন। প্রতিমাসে তারা নিজেরা চাঁদা দিয়ে একটি ফান্ড করেছিলেন। সে টাকা দিয়ে অতি গোপনে দরিদ্র ছাত্র, অসহায়, অসুস্থদের সাহায্য করতেন।
প্রফেসর মোহাম্মদ খালেদ এর আদর্শের মানুষ ছিলেন এ বাংলার প্রথম মুসলমান বিএসসি ইঞ্জিনিয়ার মো. আবদুল খালেক ও রাজনীতিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তাঁদের আদর্শের বাইরে তিনি একবিন্দু চলেননি। ১৯৭০ ও এম.এন.এ এর নির্বাচনে তিনি এ পদের জন্য দরখাস্ত করেননি। বঙ্গবন্ধু বাধ্য করেছিলেন তাঁকে এম এন এ নির্বাচন করার জন্য দৈনিক আজাদী, কোহিনূর ইলেকট্রিক প্রেস ও এম এ মালেকের বুদ্ধিদীপ্ত অর্থনৈতিক সহযোগিতায় তিনি বিশাল কর্মী বাহিনী নিয়ে নির্বাচনের মাঠে ছিলেন।
লেখক: গবেষক ও কলামিস্ট