: মুক্তিযুদ্ধ: ঘাতক বাহিনীর বেয়াদপী এবং হাফেজ মাওলানা সৈয়দ মুনির উদ্দিন নুরুল্লাহ (রহ:) মাজার শরীফ।
: মহান মুক্তিযুদ্ধের একেবারে সূচনা সময়। বলা চলে ২৬ মার্চের বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার পূর্বক্ষণেই পাকিস্তানী সেনা কর্তৃপক্ষের খারাপ উদ্দেশ্য আঁচ করতে পেরে ক্যাপ্টেন রফিকুল ইসলাম (পরে মেজর রফিক-বীর উত্তর) হালিশহর ইপিআর ক্যাম্প দখলে নেন। পাকিস্তানী সৈন্যদের পরাজিত করে আটক করে রাখেন। বাঙালি বীর সৈন্যরা পুরো হালিশহর ক্যান্টনমেন্ট দখলে নিয়ে বাংলাদেশের পতাকা তুলে দেন। বলা চলে ১ মার্চ থেকেই পুরো হালিশহর এলাকা ছিলো জয় বাংলার দখলে। পাকিস্তানী সৈন্যরা ঐ সময় সিভিল ড্রেসে বিহারি অধ্যুষিত অঞ্চলে বাঙালিদের মাঝে সাম্প্রদায়িকতার বীজ ছড়াতে চেষ্টা করেছিলো। তখনকার আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ ও স্বাধীনতাকামী বাঙালিরা দৃঢ় ছিলেন বলেই তাদের সেই ক্থটচাল সফল হয়নি। এদিকে ২৭ মার্চ থেকে পাকিস্তান নৌ-বাহিনীর সৈন্যরা হালিশহর আনন্দ বাজার অঞ্চল দিয়ে বঙ্গোপসাগর এলাকায় তাদের যুদ্ধ জাহাজ ভিড়ায়। যেহেতু হালিশহর ইপিআর ক্যাম্প সম্বন্ধে পাকিস্তান বাহিনীর সবকিছু জানাই ছিলো। তাই তারা ইপিআর ক্যাম্প দখলে নিতে যুদ্ধ শুরু করে। বাঙালি সৈন্যরা হালকা অস্ত্র দিয়ে প্রতিরোধ যুদ্ধ চালাতে থাকেন। ২৮ মার্চ চট্টগ্রাম বন্দর থেকে নৌ-বাহিনীর আক্রমনও চলতে থাকে। পাকিস্তান বাহিনীর ভারি অস্ত্রের কাছে মুক্তিযোদ্ধা ইপিআর সৈন্যরা লোকক্ষয় করতে চাইছিলেন না। কারণ প্রশিক্ষিত সৈন্যদের আরো বড় যুদ্ধের জন্য বাঁচিয়ে রাখা প্রয়োজন ছিলো। তাই তারা কৌশলগত ভাবে পিছিয়ে আসেন। ৩১ মার্চ পাকিস্তান বাহিনীর বর্বর সৈন্যরা ইপিআর ক্যাম্প দখলে নিয়েই গণহত্যা শুরু করে। দখলের পর তারা দেখতে পায় কিছু পাকিস্তানী সৈন্য পরিখার মধ্যে মৃত পড়ে রয়েছে। তখনই তারা ক্যাম্প থেকে বের হয়ে বাঙালি হত্যা শুরু করে। একসময় তারা চলে আসে চৌচালা (আনন্দ বাজার) সুলতানুল আউলিয়া হযরত হাফেজ সৈয়দ মুনির উদ্দিন নুরুল্লাহ (র:) এর মাজারের সামনে। তিনি কতোবড় মাপের অলিআল্লাহ ছিলেন তা সংক্ষিপ্ত পরিসরে বলা সম্ভব নয়। পাকিস্তানী নৌ-বাহিনীর দাম্ভিকতা এবং মানুষ হত্যার শংকায় হযরত মাওলানা সিরাজুল মোস্তুফা বেরিয়ে আসেন। তিনি বাঙালিদের বাঁচানো এবং এলাকার মানুষ যেন নির্যাতনের শিকার না হন সেজন্য তিনি জীবনের ঝুঁকি নিয়েছিলেন। তাঁকে দেখে পাকিস্তান নৌ-বাহিনীর ঘাতক সদস্যরা থমকে দাঁড়ায়। একেবারে সাধারণ মানের লুঙ্গি পাঞ্জাবি পরে তিনি পাকিস্তান বাহিনীর মুখোমুখি হন। তাঁর চোখের দিকে তাকিয়ে ঘাতকরা কেমন যেন দুর্বল হয়ে পড়ে। এরিমধ্যেও তারা হুজুরের সাথে কিছু কড়া কথা বলে, পাকিস্তানী সৈন্যদের হত্যা করা হলো কেন, কেন তুমি প্রতিরোধ করোনি। একদিকে বেয়াদপি অন্যদিকে হুমকি দিয়ে পারেতো গুলি চালিয়ে দেয়। কিন্তু কেন যেন অস্ত্র তুলে আবার নামিয়ে ফেলে। হুজুর দু’একটি কথার বেশি কিছু বলেননি। পাকিস্তানী বাহিনী কথা না বাড়িয়ে ফিরে চলে যায় তাদের দেহে কাঁপন ধরে।
: তারপরের ঘটনা আরো কঠিন ছিলো।
: পাকিস্তানী সৈন্য যারা হুজুরের সাথে বেয়াদপি করেছিলো তারা সবাই ক্যাম্পে ফিরে আসে। অল্প কয়েক ঘন্টার পর তারা সবাই চোখে দেখছিলো না। অনেকটা অন্ধের মতোই। রটে গেলো সর্বত্র। সেনাবাহিনীর বড় বড় চোখের ডাক্তার এলো। তাদের দেখলো কিন্তু খুঁজে পায়নি কোন রোগের লক্ষণ। বিচলিত হলেন সবাই। ইতোমধ্যে বালুচ সৈন্যরা মাজার শরীফ ও হুজুরের ওখানে যাওয়ার তথ্য জানান সবাইকে। উন্নত চিকিৎসাও চলছিলো কিন্তু কোন ফল হয়নি। তাই তারা বালুচ সৈন্যদের নিয়ে পুনরায় গেলো মাজার শরিফের সামনে। এবারও হুজুর মাওলানা সিরাজুল মোস্তফা (রহ:) তাঁর অতি সাধারণ পোশাকে এসে দাঁড়ালেন। কোন কথা বললেন না। সৈন্যরা তাঁর পায়ে ধরতে চাইলেন কিন্তু তিনি তাদের দূরে সরিয়ে দিলেন, ক্ষমা চাইলেন, চোখের জল ফেললেন। এবার হুজুর আকাশের দিকে তাকিয়ে হাতের ইশারায় তাদের চলে যেতে বললেন। তারা চলে গেলে। ক্যাম্পে গিয়ে তারা ফিরে পেলো দৃষ্টিশক্তি। এই ঘটনার পর মুক্তিযুদ্ধের ঐ পুরো সময় মাজার এলাকায় ঘাতক বাহিনী কোন অন্যায় কাজ করতে যায়নি। হুজুরের পুরো পরিবার ছিলেন চট্টল গৌরব এক দফার প্রবক্তা এম.এ. আজিজ এর ভক্ত। মহান মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার আগেই ১১ জানুয়ারি ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে এম.এ. আজিজ মৃত্যুবরণ করেছিলেন। সেদিন বঙ্গবন্ধু, তাজউদ্দিনসহ দলের অনেকে ঢাকা থেকে এম.এ. আজিজ এর মরদেহকে সম্মান জানাতে এসেছিলেন। হুজুরের পরিবার ছিলেন ন্যায়ের পক্ষে এবং অন্যায়ের বিপক্ষে। যেহেতু পাকিস্তানীরা অন্যায় করছিলো তাই হুজুরকেতো ন্যায়ের পক্ষে থাকতে হয়েছিলো। নিরাপদ স্থান হিসেবে মাজার পরিচিত হলেও কিছু অবাঙালির ছেলে এলাকায় মাঝে মধ্যে ঘুরতো। একবারতো মুক্তিযোদ্ধারা মহব্বত আলী একাডেমি এলাকায় ঘাতকদের দোসদের প্রচন্ড আঘাত করেছিলো। যেহেতু স্থানটি ছিলো সাগর পাড়ে সেজন্য এলাকার মানুষ মুক্তিযুদ্ধের সময় অন্য এলাকায় চলে যান। যুদ্ধের পুরো সময় হালিশহরে ইপিআর ক্যাম্প থেকে পাকিস্তানী সৈন্যরা মাজার শরিফের ভয়ে আর পশ্চিমমুখী হয়নি। এর আগে পাকিস্তান বাহিনী আনন্দ বাজার প্রফেসর ফজলুল হক সাহেবের বাড়িতে ঢুকে হত্যাকান্ড চালিয়ে ছিলো। পথে ঘাটে অনেক মানুষকে গুলি করে হত্যা করেছিলো। এখনো রেল লাইনের পাশে শহীদের এর পবিত্র কবর দৃশ্যমান।
চট্টগ্রাম শহর দখলে নেওয়ার পর থেকে ঘাতক বাহিনী গণহত্যা, নির্যাতন বাড়িয়ে দেয়। প্রতি পাড়া মহল্লা থেকে মা-বোনদের তুলে নিয়ে নির্যাতন ও হত্যাকরে চট্টগ্রাম শহরে অন্তত: ১১২টি (আমার গবেষণায়) বধ্যভূমি ও নির্যাতন কেন্দ্রের প্রত্যক্ষ তথ্য পাওয়া গেছে। বাঙালিদের হত্যা করে, নির্যাতনের পর হত্যা করে বিশেষ ট্রাকে করে চৌচালার ভেতর দিয়ে সাগর পাড়ে যেতো হত্যা করা বাঙালিদের সাগর জলে ফেলার জন্য। বালুচ সৈন্যদের চাইতে পাঞ্জাবি সৈন্যরা ছিলো হিংস্র। তাই পাকিস্তানী সামরিক প্রশাসন নির্যাতন ও হত্যাকান্ডের জন্য পাঞ্জাবি সৈন্যদের দায়িত্ব প্রদান করতো। জনশ্রুতি রয়েছে যে হালিশহর হুজুরকে কেন্দ্র করে পাঞ্জাবি সৈন্যদের সাথে বালুচ সৈন্যদের মাঝে ইপিআর ক্যাম্পের ভেতর গোলাগুলি হয়েছিলো। মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন পর্যায়ে কৌশলগত কারণে মুক্তিযোদ্ধারা নিরাপদ স্থান এবং তথ্যের জন্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন মাজার শরিফে অবস্থান করতেন। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় চট্টল গৌরব এ.বি.এম মহিউদ্দিন চৌধুরী পাকিস্তানী নির্যাতন শিবির থেকে মুক্তি পেয়ে প্রথমে আশ্রয় নেন হযরত শাহ আমানত শাহ এর মাজার শরীফে। তারপর ভিক্ষুক এবং অন্যান্যদের নিকট থেকে তথ্য নিয়ে পরে একজন আত্মীয়ের বাসায় ওঠেন। পরে তিনি চলে যান ভারতে। সেখান থেকে উন্নত প্রশিক্ষণ নিয়ে ফিরে আসেন দেশে। হালিশহরের হুজুর এবং পাকিস্তানী সৈন্যদের অন্ধ হওয়ার সংবাদ পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর প্রায় সবার কানে যায়। তারা প্রায় সবাই খুবই ভীত হয়ে পড়ে। এরপর থেকে মাজার এলাকায় অথবা মাজার অবমাননার মতো কোন ঘটনা তারা ঘটায়নি। এটাও ছিলো মহান আল্লাহর বিশেষ রহমত এবং পাকিস্তানী ঘাতকদের জন্য শিক্ষা।
আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে বিশেষ করে চট্টগ্রাম পর্বে অসংখ্য মাজার হয়ে ওঠে ছিলো মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য তথ্য কেন্দ্র। এখান থেকে সত্যের পথের যাত্রী মুক্তিযোদ্ধারা খাদেম বা মাজার শরিফের কর্মীদের মাধ্যমে তথ্য ভান্ডার গড়ে তুলেছিলেন। ঘাতক বাহিনীর চোখকে ফাঁকি দিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা পরিচালনা করেছেন অসংখ্য অপারেশন। পরে চেষ্টা করবো বিভিন্ন মাজার শরিফের তথ্যে মুক্তিযোদ্ধাদের ত্যাগের কথা জানাতে।
লেখক: গবেষক ও কলামিস্ট।