: হাইব্রিডদের কবল থেকে রাজনীতি এবং নেতাদের বাঁচানো প্রয়োজন।
: একসময় চট্টগ্রামের রাজনীতি বিশেষ করে প্রগতিশীল রাজনীতির ধারায় নেতা কর্মীরা ছিলেন কর্মও তত্ত্বের নির্দেশনায় পরিচালিত। সেই ১৯৪৮ থেকে ১৯৭১ এর বিজয় পর্যন্ত প্রতিটি সংগ্রামে রাজনৈতিক নেতৃত্ব ছিলেন শুধুই দেশের জন্য, বাঙালি জাতীয়তাবাদের জন্য, বাংলা ভাষার সম্মান মর্যাদার জন্য, শিক্ষার অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য, শোষণ বঞ্চনা থেকে মুক্তির জন্য, বাঙালিদের জাতীয় স্বীকৃতির জন্য এবং শেষটা স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য। রাজনীতির এই ধারাবাহিকতার অন্যতম প্রধান অংশীদার ছিলো চট্টগ্রাম। সেই ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে থেকে প্রতিবাদ, প্রতিরোধ, ত্যাগ, বিদ্রোহের প্রতিদান পেয়েছিলো চট্টগ্রাম। তাইতো মহাত্মা গান্ধী বলেছিলেন Chittagong to the fore অগ্রগামী চট্টগ্রাম। এর জন্য রাজনৈতিক নেতা কর্মীদের অবদান ছিলো শ্রদ্ধা করার মতো। পরবর্তী সময় বাঙালি জাতীয়তাবাদী সংগ্রামের সূচনা এবং স্বাধীন বাংলাদেশ।
: নেপথ্য এবং প্রত্যক্ষ মানুষগুলো ছিলেন কারা?
: ইতিহাস খোঁজার জন্য খুব বেশি পেছনে যাওয়ার প্রয়োজন নেই। কারণ আমরা নেতা হিসেবে পেয়েছিলাম হুজুর ভাসানী এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে। এরা জাতির বিশেষ প্রয়োজনে একই সুরে এবং একই ধারায় কথা বলেছেন। ফলে জাতি পেয়েছিলো পথের দিশা। তাঁরা জাতিকে বুঝাতে পেরেছিলেন শোষণের কথা, বঞ্চনার কথা, গণতন্ত্রহীনতার কথা, বৈষম্যের কথা। বিশেষ করে ৬ দফা ঘোষণার পরতো পুরো বাঙালি জাতি প্রকৃত নির্দেশনা পেয়ে গিয়েছিলেন। এই নির্দেশনা পালনে এবং জনমত সৃষ্টির জন্য লড়াকু কর্মীর ভূমিকায় ছিলেন প্রধানত ছাত্র রাজনৈতিক নেতা কর্মীরা। তাঁরা ছাত্রদের মধ্যে অবস্থান করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, গণমানুষের ঘরে ঘরে পৌঁছে গিয়েছিলেন। তাঁদের মনে ছিলো দেশপ্রেম, বাঙালিদের অধিকার প্রতিষ্ঠার প্রেম। সে সময় প্রগতিশীল ছাত্রদের মানুষ ঠাঁই দিতেন নিজের বুকের ভেতর। তাদের স্নেহ করতেন, ভালোবাসতেন, নিরাপত্তা দিতেন। প্রতিজন কর্মীর নিকট তাদের ছাত্রনেতারা ছিলেন বন্ধু, গাইড, ফিলোসফার। নেতার পকেটে ৫ টাকা থাকলে কাজে থাকা কর্মীদের ৪ আনা করে ভাগ করেদিতেন। কর্মীরা নিতে চাইতেন না কিন্তু জোর করে দেওয়া হতো। নেতা তখন পায়ে হেঁটে নিজ গন্তব্যে চলে যেতেন। নির্দেশনা ছিলো ভালো ছাত্র না হলে ছাত্রকর্মী হওয়া যাবেনা, নিয়মিত পড়ালেখা না করলে ছাত্ররাজনীতি করা যাবে না, পরীক্ষায় ফেল করলে দলে থাকা যাবেনা, নিয়মিত দৈনিক পত্রিকা পড়ার অভ্যাস করতে হবে, সৃজনশীল গল্পের বই পড়তে হবে, খেলাধুলা করে শরীর গঠন করতে হবে, মানুষের বিপদে এগুতে হবে, ভালো কাজের সাথে সম্পৃক্ত থাকতে হবে এবং সন্ধ্যার পর ঘরে ফিরতে হবে। আরো একটি নির্দেশনা ছিলো প্রতিজন নেতা কর্মীকে একে অপরের বাসা চেনার চেষ্টা করতে হবে। এই মানুষগুলো ছিলেন ছাত্রলীগ বা ছাত্র ইউনিয়নের অংশ। তখনো দেখেছি এবং জেনেছি নেতারা হোটেলে বসতেন না। নিজেদের পকেটে থাকতো গুড় এবং চিড়া। এগুলো খেয়ে পথের পাশে টিউবয়েলের জল পান করে ক্ষুধা নিবারণ করেছিলেন। সত্য হচ্ছে এসব নেতারা প্রতিজনই ছিলেন মেধাবী ছাত্র। এই নেতা কর্মীরা ৬ দফা ১১ দফার জন্য কাজ করেছেন, এরাই আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার বিরুদ্ধে গণজাগরণ সৃষ্টি করেছিলেন, এরাই শেখ মুজিবকে বঙ্গবন্ধু করেছিলেন এবং এরাই ১৯৭০ এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে জয়ী করে এনেছিলেন। আর ১ মার্চ ১৯৭১ এর দিন থেকে এরাই ছিলেন বিদ্রোহী বাংলার সংগ্রামী। ২ মার্চ, ৩ মার্চ, ৭ মার্চের পথ ধরে ২৬ মার্চের বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণা এবং জীবন বাজি রেখে জীবন জয়ী মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ। এরাই এনেছেন স্বাধীন বাংলাদেশ।
: প্রশ্ন হলো এমন নেতা, রাজনীতি এবং কর্মী বাহিনী কোথায়?
: সম্ভাবনা দেখছিনা কিন্তু হতাশতো নই। কারণ ইতিহাসের প্রয়োজনে অনেকে নেতা হয়ে যান। কিন্তু কর্মী হওয়া খুবই কঠিন। একটি সত্য গল্প বলছি। গত ২১ অক্টোবর গিয়েছিলাম প্রাক্তন মেয়র আ জ ম নাসির উদ্দিন এর কার্যালয় আগ্রাবাদ বাণিজ্যিক এলাকায়। উদ্দেশ্য ছিলো বীর মুক্তিযোদ্ধা আবু সাঈদ সরদার এর সাথে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক প্রকাশিত একটি গ্রন্থ সংগ্রহের ব্যাপারে আলোচনার জন্য। সাথে ছিলে কবি আইয়ুব সৈয়দ। যাওয়ার আগেই ভেবেছিলেন প্রচুর নেতাকর্মীর ভিড় থাকবে। এই ভাবনার কারণ ছিলো। যখন তিনি মেয়র ছিলেন তখন দু’বার তাঁর ঐ কার্যালয়ের সামনে দিয়ে কমার্স কলেজে গিয়েছিলাম। দেখি প্রচুর মটর সাইকেল, বাইরে প্রচুর কর্মী। কেউ সিগারেট টানছেন, কেউ রাস্তায় দাঁড়িয়ে চা খাচ্ছেন, কেউ হাসি ঠাট্টায় সময় কাটাচ্ছেন। ড্রাইভার বললেন, এরা সবাই মেয়র সাহেবের অফিসে এসেছেন। ফেরার পথেও এমন অবস্থা। পরে আরো একদিন একই অবস্থা দেখে নিজের অজান্তেই বললাম, তারা এগুবে কিন্তু দল পিছিয়ে যাবে। জেনেছি এরা প্রায় সবাই হাইব্রিড, ভেতরের অবস্থাও তাই। অনেক সময় তাদের জোর করে বাইর করতে হয়েছে। তখন মেয়র সাহেব নিজের ব্যবসায়িক কাজও করতে সমস্যায় পড়তেন। অন্যদিকে একটি অংশ ছিলো রাজনৈতিক কার্যালয়। এখন তিনি মেয়র নেই। তাঁর রাজনৈকি কার্যালয়ে আবু ভাই এবং ইসহাক ভাই ছাড়া আর কেউ নেই। রয়েছেন তাঁর অফিসের ক’জন সার্বক্ষণিক কর্মী। যখন তিনি মেয়র ছিলেন তখন হাইব্রিডদের জন্য প্রকৃতরা কাছে ভিড়া ছিলো কষ্টের আর এখন তিনি মেয়র নেই তাই তারা চলে গেছেন ক্ষমতার কাছের মানুষদের অতি নিকটে। এটাই হচ্ছে রাজনৈতিক ট্র্যাজেডি।
: অন্য একটি দৃশ্য … ।
: রেজাউল করিম চৌধুরী মুক্তিযোদ্ধা। ষাট দশকের শুরু থেকে ছাত্রলীগের জন্য নিবেদিত ছিলেন। ত্যাগ ছিলো। চট্টগ্রাম কলেজ ছাত্রলীগ থেকে মুক্তিযুদ্ধে। এবার দল তাঁকে মেয়র প্রার্থী করে মূল্যায়ন করেছেন। করোনার জন্য নির্বাচন স্থগিত রয়েছে। কিন্তু তিনি কাজে রয়েছেন। প্রকৃত আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের মানুষগুলোর সাথে কিছু মানুষের ভিড় লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এদের বেশির ভাগই বসন্তের কোকিল, বসন্তের সময় তাদের দেখা মেলে। এরাও কিন্তু হাইব্রিড। এরা সকালে তাঁর রাজনৈতিক কার্যালয়ে যান বসেন চা বিস্কুট ভক্ষণ করেন, এলাকার মানুষের ইজারা নিয়েছেন, ভোটাররা যেন তাদের কথায় ওঠে বসে, ভাবটা এমনই। সেই হাইব্রিডের মানুষ(!) গুলো পাড়ায় মহল্লায়, বস্তিুতে নিজ ঘরে পোস্টার লাগিয়ে বলে বেড়ান, রেজাউল ভাইতো আমাকে খুব পছন্দ করেন, নির্বাচনের পর আপনাদের সমস্যার সমাধান করে দেবো। এমন কথায় সাধারণ মানুষ আবেগ আপ্লুত হয়ে ঐ হাইব্রিডকে খুশি করার চেষ্টা করেন। পুরো শহরে কিছু হাইব্রিড এমন কথা বলে মেয়র প্রার্থীর সুনাম নষ্ট করছেন। এই হাইব্রিড অমানুষগুলো এমন ভাব দেখাচ্ছেন যেন তিনিই মেয়র প্রার্থী। শুধু তাই নয় তারা এখন সবাই তাঁর আত্মীয় বনে গেছেন। যদিও মেয়র প্রার্থী তাঁদের চেনেন বলে মনে হয় না। এরা কিন্তু বিপদের বন্ধু হবে না, এরা হবে সুখের সময়ের পায়রা। এদের জন্যই প্রকৃত রাজনীতিক নেতা কর্মীরা বিভ্রান্ত হয়ে পড়েন। তাঁদের পরশে যাওয়ার জন্য অনাহুত হাইব্রিডের ছবি দিয়ে ব্যানার দেওয়া হয়েছিলো, দেখেছি। প্রভাব খাটিয়ে ফ্ল্যাটবাড়ির লনে মহিলা দিয়ে পোস্টার এবং পোস্টারের রশি তৈরি করে ফ্ল্যাটবাসির সমালোচনার মুখে পড়েছেন। এরাই হচ্ছে হাইব্রিড। এদের এমন অন্যায়ের কাজের তথ্য মেয়র প্রার্থী রেজাউল করিম চৌধুরী জানেন না। এমন কথাগুলো প্রকৃত ভালো মানুষরা জেনেও চুপ করে রয়েছেন। এতেতো হাইব্রিডদের কোন ক্ষতি হচ্ছে না, তারাতো চা-নাস্তা, সিগারেট ফুঁকিয়ে দাম্ভিকতা প্রদর্শন করেই চলেছেন। একজন নির্বাচন প্রার্থী তিনিতো অনেকটা অসহায় হয়ে থাকেন। তিনিতো কাউকে কিছু বলতে পারেন না। ফলে হাইব্রিডরা সুযোগ পাচ্ছেন। কেউ তাদের কড়া কথা বলতে সাহসী নয়। এসব হাইব্রিডের কড়া কথা বলতে হবে, তাদের বিরুদ্ধেতো সোচ্চার হতে হবে। তাদের লেজ কেটে দিতে হবে। কারণ এমন মানুষরা দেশ, জাতি বা দলের প্রয়োজনে আসেনা। তারা দলের ক্ষতি করেই নিজের সফলতা কামনা করে।
যখন যে দল ক্ষমতায় থাকে হাইব্রিডরা সে দলের পতাকাতলে সমবেত হয়। এরা সবসময় থাকে সরকারি দলের হয়েই। এরা কখনো বিরোধী দলে যায় না, বিরোধী দল কাকে বলে তারা জানে না। পুলিশের গুতো বা ঠ্যাংগানি এরা কখনো খায় না। তবে এরাই কিন্তু আঞ্চলিক বা এলাকার বাড়তি নেতা। দলের প্রকৃত ও পরীক্ষিত নেতা-কর্মীরা যতোটুকু বলেন এই হাইব্রিডরা বলেন আরো শতগুণ বাড়িয়ে। এরা যখন হাঁটেন তাদের পেছনে থাকে অনেকে। কিন্তু প্রকৃত নেতাকর্মীরা যখন হাঁটেন তাদের পেছনে কেউ থাকে না। কারণ এরা হটকারি কথা বলেন না, অনাহুত স্বপ্ন দেখান না। জাতির এই সময় হাইব্রিডদের দমন জরুরী হয়ে পড়েছে। তাদের নিয়ন্ত্রণ নয় পুরোপুরি দমন করে রাজনীতিতে পরিচ্ছন্ন অঙ্গন সৃষ্টি প্রয়োজন। লেখক: গবেষক ও কলামিস্ট।