আমাদের সামাজিক অবক্ষয় এবং অসহিষ্ণুতার আরেক নাম কিশোর গ্যাং। উদ্বেগজনকভাবে লক্ষ্য করা যাচ্ছে ইদানিং পত্র পত্রিকায় নিয়মিত শিরোনাম হচ্ছে কিশোরগ্যাং। যে শিরোনামে শংকিত অভিভাবক, শংকিত শিক্ষক– শিক্ষার্থী এবং শংকিত সাধারণ মানুষ। বুক ধরফর করা এ ধরনের শিরোনামে না জানি কার কপার পুড়লো, কার আদরের সন্তানটা নিজের অগোচরে এই কিশোর গ্যাং এর সদস্য হচ্ছে।
চট্টগ্রামসহ সারাদেশে কিশোরগ্যাং কালচার ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। কোনভাবেই তাদের নিয়ন্ত্রণ, দমন করা যাচ্ছে না। আইনশৃংখলা বাহিনীও হিমশিম খেয়ে যাচ্ছে তাদের কর্মকাণ্ডে। সাধারণত ১৮ বছরের নিচে ছেলেমেয়েরা কিশোর হিসেবে বিবেচিত। তাই এই বয়সের ছেলেমেয়েরা অপরাধমূলক কর্মকান্ডে লিপ্ত হলে তাদেরকে কোন শাস্তি দেওয়া যায় না। বড়জোর সংশোধনাগারে পাঠানো যায়।
দেশে ২০১২ সাল থেকে কিশোর গ্যাং নামক একটি সন্ত্রাসী সংস্কৃতির অস্তিত্ব আবিস্কৃত হলেও বর্তমানে এর ভয়াবহতা ছড়িয়ে পড়েছে পুরো দেশে। সমপ্রতি শুধুমাত্র চট্টগ্রামেই কয়েকটি চাঞ্চল্যকর – রোমহর্ষক অপরাধ ঘটে গেছে কিশোরদের দ্বারা। ৯ জুন চট্টগ্রামের বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত খবরে জানা যায় সিনিয়রের সামনে সিগারেট খাওয়া নিয়ে দ্বন্দ্বে পটিয়ায় স্কুল ছাত্রকে ছুরিকাঘাত করা হয়েছে। অন্যদিকে মোবাইল ব্যবহার করতে মানা করায় শিক্ষকের মাথা ফাটিয়ে দিল তাঁরই ছাত্ররা। পরে স্থানীয়রা রক্তাক্ত অবস্থায় ওই শিক্ষককে উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করে। নগরীর কোতোয়ালী এলাকায় সন্ত্রাসী কার্যক্রমের প্রস্তুতিকালে ‘টিন স্কোয়াড’ নামে কিশোর গ্যায়ের পাঁচ সসস্যকে আটক করেছে র্যাব।
যে বয়সে কিশোরদের সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং লেখাপড়া নিয়ে ব্যস্ত থাকার কথা, তারা জড়িয়ে পড়ছে বিভিন্ন অনৈতিক কর্মকান্ডে। কিশোর বয়স হচ্ছে স্বপ্ন পুরনের বয়স, স্বপ্ন দেখার বয়স। একটা ফুল যখন ফুটতে শুরু করে তখন যদি আঘাত করা হয়, তাহলে ফুলটা অকালে ঝরে যায়। কিশোররা আমাদের আগামীর কর্ণধার তাদেরকে সঠিক পথে পরিচালিত করা আমাদের দায়িত্ব।
আমাদের কিশোর বয়সে গ্রামে– গঞ্জে পাড়া– মহল্লায় অনেক কিশোর সংগঠন ছিল। এদের নামও ছিল অর্থবোধক। যেমন, কিশোর সংঘ, কিশোর আলো, কিশোর মেলা ইত্যাদি। এধরণের সংগঠনের সদস্য কিশোররা লেখাপড়ার ফাঁকে ফাঁকে সামাজিক সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে লিপ্ত থাকত। পাড়ার যে কারও বিপদে ুআপদে ঝাঁপিয়ে পড়ত। আমাদের পাড়ায় ও এরকম একটা সংগঠন ছিল, সেটার নাম ছিল ‘কিশোর সংঘ’। গ্রামের রাস্তা ভেঙ্গে গেছে , রিঙা ঢুকতে পারছে না। তারা যেখান থেকে পারে মাটি কেটে রাস্তা মেরামত করে দিত। পাড়ার যেকোন সামাজিক সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে তাদের স্বতঃস্ফুর্ত অংশগ্রহণ ছিল। বড়রা উপদেষ্টা হিসেবে তাদের সাথে থাকত। মাসিক ৫–১০ টাকা হারে চাঁদার বিনিময়ে যে কেউ এই সংঘের সদস্য হতে পারত। চাঁদার টাকা দিয়ে রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, শরৎচন্দ্র, মাসুদরানা সিরিজ, হুমায়ুন আহমেদসহ বিভিন্ন ভালো ভালো লেখকের বই কিনে রাখা হত। সংঘের সদস্য এবং তার ছোট ভাই–বোন সবাই এই বইগুলো পড়তে পারত। কোন গরিব ছেলেমেয়ে ফরম ফিলাপের টাকা দিতে না পারলে তাদের জমানো টাকা থেকে সাহায্য করা হত।
তাছাড়া আগে যেখানে সুস্থ বিনোদন ও সাংস্কৃতিক চর্চা হতো এখন সেখানে অপসংস্কৃতি জায়গা দখল করে নিয়েছে। এখন আর আগের মত সন্ধ্যায় কারও ঘরের পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় হারমোনিয়ামসহ গানের সুর ভেসে আসে না। কেউ আর বাঙালির প্রাণের সুর রবীন্দ্র সংগীত আর নজরুল সংগীতের মত শ্রুতিমধুর সংগীতে আকৃষ্ট হচ্ছে না। দেশাত্মবোধক গানে আর কেউ দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হচ্ছে না। আকাশ সংস্কৃতির প্রভাবে তাদের মধ্যে অসহিষ্ণুতা এবং অস্থিরতা চরম আকার ধারণ করেছে। লেখাপড়ার পাশাপাশি খেলাধুলা, গানবাজনাসহ নানা সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড একজন ছাত্রের চারিত্রিক জীবন গঠনের জন্য যে অপরিহার্য সেটা এখন সবাই ভুলে যেতে বসেছে।
কিশোররা রাজনৈতিক ছত্র ছায়ায়ও নানা অপরাধমূলক কর্মকান্ডে ব্যবহৃত হচ্ছে। তারা এলাকায় চাঁদাবাজি, চুরি, ছিনতাই থেকে শুরু করে খুনাখুনি পর্যন্ত করতে দ্বিধা করে না। এখন গ্রুপভিত্তিক কিশোর অপরাধ সংগঠিত হচ্ছে। সিনিয়র জুনিয়র দ্বন্দ্ব, সিগারেট খাওয়া, মারধর, সশস্ত্র হামলা, প্রভাব বিস্তারের জেরে হরহামেশা ধাওয়া পালটা ধাওয়া এসবতো আছেই।
গত ১১ জুন ‘কিশোর গ্যাং নিয়ন্ত্রণে তিন উপায় ভাবছে সিএমপি‘ শীর্ষক একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে ‘দৈনিক আজাদী‘তে। এতে বলা হয়েছে কিশোর গ্যাং সংস্কৃতি বর্তমানে আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে। হিরোইজম বা বাহাদুরি, কাঁচা টাকা পয়সা, মাদকাসক্তি, সাংস্কৃতিক চর্চার নামে ছেলেমেয়েদের অবাধে মেলামেশার তীব্র আকর্ষণ ইত্যাদি হাতছানি দিয়ে ডাকায় দ্রুত এসমস্ত গ্যাং এবং তাদের সদস্য সংখ্যা বাড়ছে। সেই সাথে টিকটক, লাইকি ইত্যাদি নানান ধরনের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও পথভ্রষ্ট হয়ে কিশোররা কিশোর গ্যাংয়ে নাম লেখাচ্ছে। ফলে সমাজকে ভেতরে ভেতরে উইপোকার মত খুবলে খেয়ে ফেলছে এই অশুভ চর্চা। সিএমপি কমিশনার কৃষ্ণ পদ রায় এ প্রসঙ্গে জানান, ২০১৯ সালে করা কিশোর গ্যাংয়ের একটি তালিকা আমাদের কাছে আছে। কিশোর গ্যাংয়ের এই তালিকা হালনাগাদ করা হবে। পাশাপাশি এই গ্যাং কালচার দমাতে তিন উপায়ে কাজ কিরার কথা ভাবছে পুলিশ। এক, নুতন করে কিশোর গ্যাংয়ের সলিড তালিকা তৈরি করে তাদের আইনের আওতায় নিয়ে আসা। দুই, কিশোর গ্যাংয়ে জড়িত কিশোরদের অভিভাবকদের ডেকে কাউন্সেলিং সভা করা। তিন, এসব গ্যাং কালচারে যেসব কথিত বড় ভাইরা ছায়া হয়ে আছেন তাদেরও সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে আইনের আওতায় আনা।
কিশোর তরুণ সমাজ দেশের ভবিষ্যৎ। দল বেঁধে তাদের সন্ত্রাসী হয়ে ওঠা খুবই চিন্তার বিষয়। ভবিষ্যৎ প্রজন্ম যদি উচ্ছন্নে যায় তাহলে শেষ হয়ে যাবে পরিবার, সমাজ, সর্বোপরি রাষ্ট্র। কিশোর গ্যাং যদি এখনই প্রতিহত বা নির্মূল করা না যায় তাহলে সমাজ ও রাষ্ট্র এক ভয়ংকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হবে। এক্ষেত্রে আইন শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে। সন্ধ্যার পর দলবদ্ধ কিশোরদের রাস্তাঘাটে মার্কেটে দেখলে কৈফিয়ত চাইতে হবে এবং ঘরে যাওয়ার জন্য বাধ্য করতে হবে। এক্ষেত্রে অভিভাবকদেরও ছেলেমেয়েদের ব্যাপারে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। সন্তান কোথায় যায়, কার সাথে মেশে তা খেয়াল রাখার দায়িত্ব অবশ্যই তাদের।
সামাজিক এবং পারিবারিক সম্পর্কের জায়গাটা দুর্বল হয়ে গেলে তা দ্রুত কিশোরদের অপরাধের দিকে নিয়ে যেতে পারে। ঘরে স্বামী –স্ত্রী নিত্য ঝগড়া কলহ আর বিবাহবিচ্ছেদ এবং অভিভাবকদের অসচেতনার কারণে সন্তান বেপরোয়া হয়ে বিপথে চলে যায়। অর্থাভাব যেমন একটি কিশোরকে অপরাধ জগতের দিকে ধাবিত করে, তেমনি অর্থের প্রাচুর্য ও কখনো অনর্থের কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। সেবন করছে দামি সিগারেট, ভয়াবহ মাদক।
সমাজ চিন্তকরা মোটা দাগে সামাজিক অবক্ষয়, ধর্মীয় মূল্যবোধের অবমাননা, দুর্বল কাঠামোর শিক্ষানীতি এবং রাজনৈতিক নীতিহীনতাকেই এই কিশোর গ্যাং নামক সামাজিক দুর্যোগের কারণ হিসেবে গণ্য করছেন। একসময় পাড়ার বয়স্কদের ছোটরা সম্মান করত। অন্যায় করতে দেখলে পাড়ার বড়রাও ছোটদের শাসন করতে পারত। এখন সেই ঐতিহ্য আর নেই। ভেঙ্গে পড়েছে সামাজিক মূল্যবোধ।
একটি সমাজের জন্য সামাজিক মূল্যবোধ এবং সহনশীলতা খুবই জরুরি। সহনশীলতার উপর নির্ভর করে সমাজের স্থিতিশীলতা। সহনশীল মনোভাব মানুষকে অস্থিরতা থেকে মুক্ত করে। তাই সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্র থেকেই অপসংস্কৃতি এবং অসহিষ্ণুতার বিষবৃক্ষ উপড়ে ফেলতে হবে। তবেই সমাজে শান্তি ও শৃঙ্খলা ফিরে আসবে। দেশ ও জাতি ভয়াবহ দুর্যোগ থেকে নিস্তার পাবে। সূত্র: কিশোর গ্যাং : অনিরাপদ সমাজ ও জাতি : ড. এ কে এম মাকসুদুল হক।
লেখক : প্রাবন্ধিক; সহকারী অধ্যাপক, বোয়ালখালী হাজী নুরুল হক ডিগ্রি কলেজ।