সাদা পোশাকে অভিযান চালানো নিষিদ্ধ হলেও তা রয়ে গেছে কাগজে কলমেই। সাদা পোশাকে থানা পুলিশের ‘অভিযান’ নিয়ে চলছে নানা অভিযোগ। সোর্সের কথার উপর ভিত্তি করে সাদা পোশাকে সিভিল টিমের সদস্যরা অভিযান চালাতে গেলে সাধারণ মানুষও বিভ্রান্তিতে পড়ে। তারা কি সন্ত্রাসী নাকি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য তা বুঝতে পারে না। পাশাপাশি অভিযোগ রয়েছে, সোর্সের কথার উপর ভিত্তি করে সাদা পোশাকে থাকা এসব সিভিল টিমের সদস্যদের অনেকেই সাধারণ মানুষকে হয়রানি, জোরপূর্বক অর্থ আদায়সহ নানা অনৈতিক কাজে জড়িয়ে পড়ছে। আবার সব কিছু জানার পরও অভিযুক্ত পুলিশ সদস্যদের রক্ষার চেষ্টার অভিযোগও রয়েছে অনেক সিনিয়র কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে। আর এ সুযোগে পুলিশের কোনো সদস্য কখনো ইয়াবা দিয়ে ফাঁসিয়ে দিচ্ছেন কিশোরকে, কখনো দোকান কর্মচারীকে পিটিয়ে নির্যাতন করছেন, কখনো আবার সিনিয়র কর্মকর্তাকে ছিনতাইকারী ভেবে ঘুষি মেরে নাক ফাটিয়ে দিচ্ছেন। শুধু তাই নয় সাদা পোশাকে অভিযান করতে গিয়ে কাউন্টার টেররিজমের এক পরিদর্শককে হাতকড়া পরিয়ে টেনেহিঁচড়ে থানায়ও নিয়ে গেছেন। এমন বেপরোয়া আচরণে সাধারণ মানুষের পাশাপাশি ক্ষুব্ধ পুলিশ সদস্যরাই। তবে সিএমপি কমিশনার সালেহ মোহম্মদ তানভীর স্পষ্টভাবেই জানিয়ে দিয়েছেন, ব্যক্তির দায় কখনোই বাহিনী নেবে না। তাছাড়া জবাবদিহিতার ঊর্ধ্বে কেউই নয়। সাদা পোশাকে অভিযান প্রসঙ্গে তিনি বলেন, সিএমপির কাউন্টার টেররিজম, ডিবি সাদা পোশাকে অভিযান করতে পারে। এটা বৈধ। এর বাইরে অবশ্য পুলিশ সদর দপ্তরের নির্দেশে কিছু অভিযান সিভিল পোশাকে বলবৎ করা থাকে। এসব বিষয় ছাড়া পুলিশের সাদা পোশাকে অভিযান করার এখতিয়ার নেই।
গত ১৬ জুলাই বৃহস্পতিবার রাতে নগরীর ডবলমুরিং থানার বাদামতলীর বড় মসজিদ গলির একটি বাসা থেকে মো. মারুফ (১৯) নামে এক তরুণের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। ওই তরুণকে সন্দেহভাজন মাদক বিক্রেতা বলে জানিয়েছিল পুলিশ। জানা গেছে, ১৬ জুলাই বড় মসজিদ গলিতে মারুফের ওপর চড়াও হয় কাশেম নামের একজনসহ এসআই হেলাল খানের দু’জন সোর্স। এ দু’জন সোর্স দশম শ্রেণি পড়ুয়া মারুফ, তার মা রুবি আক্তার ও বোন নেহাকে মারধরসহ শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করেন। এর মাঝে ঘটনাস্থলে আসেন এসআই হেলাল খান। এসআই হেলালের দাবিকৃত ১ লাখ টাকা না দেয়ায় মারুফের মা বোনকে থানায় নিয়ে যাওয়ার উদ্দেশ্যে গাড়িতে তুলেন হেলাল ও তার সহযোগীরা। এটি বুঝতে পেরে এবং অপমানিত বোধ করে মারুফ আত্মহত্যা করে। এ ঘটনার পর রাতেই বিক্ষুব্ধ এলাকাবাসী রাস্তায় নেমে আসে। মারুফের লাশ উদ্ধার করতে গেলে বাধার মুখে পড়ে পুলিশ। বিক্ষোভের মুখে নগর পুলিশের পশ্চিম জোনের উপকমিশনার ফারুকুল হক অভিযুক্ত এসআই মো. হেলালকে ক্লোজ করার ঘোষণা দেন। এরপর পরিস্থিতি শান্ত হয়। পরবর্তীতে তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে উঠে আসে, ঘটনাস্থলে যাওয়া এসআই হেলাল সিভিল টিমের সদস্য হলেও অভিযানে যাওয়ার সময় থানাকে অবহিত করে যান নি। তাছাড়া তার বিরুদ্ধে এ ধরনের অভিযোগ এই প্রথম নয়। অপরাধ প্রমাণিত হওয়ায় তাকে পরে চাকরিচ্যুত করা হয়।
ওই ঘটনার পর সিএমপির ১২ জন এসআই ও ১৭ জন এএসআইকে বদলি করা হয়। যাদের অধিকাংশই ছিলেন থানার সিভিল টিম বা সাদা পোশাকে অভিযান পরিচালনাকারী টিমের সদস্য। যদিও তৎকালীন পুলিশ কমিশনার মাহবুবর রহমান তখন তাদের বদলিকে ‘নিয়মিত বদলির অংশ’ হিসেবে উল্লেখ করেন। তবে বিশ্বস্ত সূত্রে জানা যায়, সাদা পোশাকে এসআই হেলালের অভিযানের ঘটনায় এক কিশোরের ‘আত্মহত্যার’ পর সিএমপির ১২ এসআইকে একযোগে বদলির দুই দিন পর ১৭ এএসআইকে বদলি করা হয়।
কিন্তু পুলিশের বেপরোয়া আচরণ এখানেই থেমে নেই। এরপর টেকনাফের ‘ওসি প্রদীপ’ কাণ্ডের পর বিতর্কিত পুলিশ সদস্যদের লাগাম টেনে ধরার মানসে চট্টগ্রামসহ দেশজুড়ে চলছে পুলিশের রদবদল। এ অবস্থায় ছিনতাইকারী ভেবে সিএমপির এক ইন্সপেক্টরকে প্রকাশ্যে মারধর এবং পরে হাতকড়া পরিয়ে এক এসআই ও এএসআইয়ের কোতোয়ালী থানায় নিয়ে যাওয়ার ঘটনা নিয়ে সমালোচনার ঝড় উঠে খোদ পুলিশ সদস্যদের মধ্যেই। গত ২৫ অক্টোবর নগরীর রেয়াজুদ্দিন বাজারে এ ঘটনা ঘটলেও অজ্ঞাত কারণে গত ৩১ অক্টোবর লাঞ্ছনার শিকার ইন্সপেক্টর আফতাব পুলিশ কমিশনার বরাবর লিখিত অভিযোগ করেন লাঞ্ছনাকারী এসআই রবিউলের বিরুদ্ধে। অভিযোগে আফতাব পেশাগত জীবনে তাঁর অর্জন তুলে ধরে এ ঘটনায় জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়ে পুলিশ কমিশনারের কাছে সুবিচার প্রত্যাশা করেছেন। আফতাব লিখিত অভিযোগে বলেছেন, তার ও তার সাথে থাকা হাসানের কল ডিটেইল রেকর্ড এবং বাসার সিসি ক্যামেরার ফুটেজ বিশ্লেষণ করে পুলিশ কর্মকর্তারা নিশ্চিত হয়েছেন, তারা ছিনতায়ের ঘটনার সময় নিজেদের বাসাতেই ছিলেন। এরপর ছিনতাইয়ের শিকার নূর মোহাম্মদ ও তার স্বজনরা ভুল করে তাদের শনাক্তের কথা স্বীকার করে লিখিত দেন বলে জানান আফতাব। ঘটনাটি সিএমপির একজন উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা তদন্ত করছেন বলে জানিয়েছেন সিএমপি কমিশনার সালেহ মোহম্মদ তানভীর। তিনি বলেন, তদন্ত প্রতিবেদন পেলে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবো।
এ বিষয়ে গত ২৮ অক্টোবর কোতোয়ালী থানার ওসি মোহাম্মদ মহসীনের কাছে জানতে চাইলে তিনি এ বিষয়ে কিছুই জানেন না বলে জানান। তিনি এও বলেন, আমি ইন্সপেক্টর আফতাব এবং এসআই রবিউলের সাথে নিজে কথা বলেছি। তারা এ ধরনের কোন ঘটনা ঘটেনি বলে জানিয়েছেন। সাংবাদিকরা কোত্থেকে এসব ‘উল্টাপাল্টা’ তথ্য পেয়েছে, তা নিয়ে বিরক্তি প্রকাশ করেন তিনি। একই ভাবে কোতোয়ালী থানার পরিদর্শক তদন্ত মো. কামরুজ্জামান এ ধরনের ঘটনা ঘটেনি জানিয়ে বলেন, আমরা কোথাও কিছু পাইলাম না, অথচ সাংবাদিক বললেন এ ধরনের ঘটনা ঘটছে। তবে ইন্সপেক্টর আফতাবই বা কেন ঘটনার ছয় দিন পর অভিযোগ করলেন তাও রহস্যজনক।
এর আগে গত ২৯ এপ্রিল নগরীর টেরীবাজার মোহাদ্দেছ মার্কেটের প্রার্থনা বস্ত্রালয়ের ম্যানেজার গিরিধারী চৌধুরী এএসআই কামরুল হাসানের মারধরের শিকার হয়ে মারা যান। তখনও সমালোচিত হয় পুলিশ। এ ঘটনায় পুলিশের তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে এএসআই
কামরুলের অপেশাদার আচরণের প্রমাণ মেলায় তাকে সাময়িক বরখাস্তও করা হয়। তবে আচরণগত পরিবর্তন না হওয়ায় বারবার এমন ঘটনায় উদ্বিগ্ন সবাই।