সাজঘর নাট্যকর্মীদের জীবন ও মঞ্চসংগ্রামের নাট্যভাষ্য

ইউসুফ ইকবাল | সোমবার , ২৮ জুলাই, ২০২৫ at ৫:১৮ পূর্বাহ্ণ

করোনাউত্তর চট্টগ্রামে মঞ্চনাটক নির্মাণের সর্বশেষ সাংগঠনিক প্রচেষ্টার নাম স্কেচ গ্যালারি নন্দন। চট্টগ্রামের পাঁচ দশকের নাটকের স্থিরচিত্র সংগ্রহ এবং প্রদর্শনী আয়োজনের মাধ্যমে সংগঠনটি নাট্যাঙ্গনের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। এর পর ভালোবাসি ভালোবাসি নাটক প্রদর্শনীর মাধ্যমে মঞ্চাভিষেক হয় নন্দনের। এবার সাজঘর দিয়ে তারা নাট্যযাত্রায় নতুন সড়ক উন্মোচন করেছে।

সাজঘর কথাকোবিদ হুমায়ুন আহমেদের উপন্যাসের নাট্যরূপ। শাহরিয়ার হান্নানের নাট্যরূপে নাটকটির আখ্যান স্পষ্টত দুটি বৃত্তকে কেন্দ্র করে অগ্রসর হয়েছে। প্রথমটি, একটি নাটকের মহড়ার বাস্তবতা; অন্যটি, মহড়াধীন নাটককে মঞ্চে নির্মাণকালীন বাস্তবতা। অনেকটা ‘নাটকের ভেতর নাটক’ রীতিতে উপস্থাপিত হয়েছে সাজঘর। এনাটকের ভেতর মহড়াধীন নাটকের বাস্তবতায় প্রধান চরিত্র একজন নাট্যকার। তিনি সমকালীন সময় ও সমাজবাস্তবতার উপর ভিত্তি করে নাটক লিখতে চান। সমাজের বাস্তবতা এমন যেএখানে শ্রেণিবিভক্তি, শোষণ, বঞ্চনা নিত্যদৃশ্যমান। মানুষ চাইলেই নিজের ইচ্ছামতো বিকশিত হতে পারে না। নাট্যকার জীবনের যে রূঢ় বাস্তবতার ভূমিতে বড় হয়েছেন নাটকে তার তীব্র সমালোচনা করতে চান। নাটকের চরিত্রকেও তিনি সেবাস্তবতায় প্রতিবাদমুখর করে সৃষ্টি করতে চান। কিন্তু, আদর্শহীন নষ্ট রাজনীতির শিকার হয়ে মানুষগুলো কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে এগিয়ে যেতে পারে না। ফলে, তার সৃষ্ট চরিত্র হয়ে ওঠে জীবনযুদ্ধে বার বার পরাজিত আহত ও বিক্ষত জীবনসৈনিক। প্রত্যাশা আর প্রাপ্তিতে তাদের বিশাল ব্যবধান। এসামাজিক বাস্তবতায় নাট্যকার চাইলেও কোনো চরিত্রকে স্বাধীনভাবে সৃষ্টি করতে পারেন না। এই অপারগতা, অক্ষমতা বা অতৃপ্তি নাট্যকারকে আত্মদ্বন্দ্ব ও চেতনার তীব্র ঘূণাবর্তে নিয়ে যায়। সেখানে প্রতিপক্ষ হিসাবে দাঁড়ায় তার সৃষ্ট চরিত্র ছলিমুদ্দিন, কুদ্দুস প্রমুখ। চরিত্রগুলো তাদের জীবনের পরিণতিকে মেনে নেয় না। তারা স্বপ্ন দেখে নতুন সমাজের। তারা নিজেদের ন্যায্য অধিকার দাবি করে এবং জীবনের, ভাগ্যের ও প্রচলিত সমাজের আমুল পরিবর্তন চায়।

সাজঘরএর অভিনেয় নাটকের মঞ্চায়ন বাস্তবতা আমাদের নাট্যচর্চার বাস্তবতাকে স্মরণ করিয়ে দেয়। এপর্বে পূর্বা নাট্যদলের নির্দেশক বজলুই হয়ে ওঠে আখ্যানবৃত্তের কেন্দ্র। দলের কর্মীদের উদাসীনতা, মহড়ায় অনুপস্থিতি, অপেশাদার আচরণ, দলে ব্যক্তিগত সম্পর্কের প্রভাব; অর্থ, অবকাঠামোসহ অজস্র সীমাবদ্ধতাকে সাথে নিয়ে পূর্বাকে টিকিয়ে রেখেছেন বজলুভাই। দলের যে কোনো সম্ভাব্য সংকট মোকাবেলায় তিনি পারঙ্গম । কিন্তু, এবার নতুন নাটকের হল বুকিং, টিকেট ছাপানো সহ আনুষঙ্গিক সকল আয়োজন সম্পন্ন হওয়ার পর লীনার মাতৃত্বজনিত কারণে হঠাৎ অভিনয় থেকে দূরে থাকার সিদ্ধান্তে ভীষণ বিচলিত হন তিনি। অগত্যা নতুন আনকোরা কর্মী দিয়ে চরিত্র রিপ্লেস করা হয়। কিন্তু, প্রদর্শনীর কদিন আগে সেও জানিয়ে দেয় তার অভিনয়ে অপারগতার কথা। নাটকের নির্দেশক বজলুসহ পুরো দল আবার সংকটের মুখোমুখি দাঁড়ায়। এরপর সবচেয়ে বড় দুঃসংবাদটি শোনা যায় দলের সিনিয়র ও সিরিয়াস অভিনেতা আসিফের অভিনয় ছাড়ার সংবাদে। আসিফলীনার দাম্পত্যে পরপর দুটি সন্তান ভূমিষ্ট হওয়ার পর মারা গেছে। লীনাকে সে কথা দিয়েছে তার জীবনের সবচেয়ে প্রিয় জিনিস উৎসর্গ করে হলেও সে তৃতীয় সন্তানকে বাঁচাতে চায়। আসিফের কাছে জীবনের শ্রেষ্ঠ জিনিস তার অভিনয়। অভিনয়ের কারণে জীবনে সে হারিয়েছে অনেক কিছু, আবার পেয়েছে অপরিমেয়। অভিনয় তাকে নামযশ খ্যতি এনে দিয়েছেলীনাকে পেয়েছে। অভিনয় তার জীবনতার ধ্যান জ্ঞান। সন্তানের জীবনের জন্য আসিফ সেই অভিনয়কেই উৎসর্গ করল। এসব জটিল পরিস্থিতি সামাল দিয়ে পূর্বা নাট্যগোষ্ঠীকে নাটক করতে হয়। সাজঘর নাটকের এচিত্র আমাদের নাট্যদলগুলোর অভ্যন্তরীন বাস্তবতাকে প্রতিফলিত করে। বিগত পঞ্চাশ বছর ধরে প্রতিকূল স্রোতে অজস্র নাট্যপ্রেমীর সহস্র দিবসের শ্রমে ঘামে গড়ে উঠেছে আমাদের নাট্যাঙ্গন। এখানে শিল্প নির্মাণের আনন্দ আর কটিমেন্ট পালন ছাড়া আর কিছু পাওয়ার নেই নাট্যকর্মীদের। এনাটকের কর্মীদের মতো শত প্রতিকূলতাকে অতিক্রম করে নাট্যশিল্পকে বাঁচিয়ে রেখেছে আমাদের নাট্যকর্মীরা। এসমিল পরিস্থিতির কারণে সাজঘরএর আখ্যান প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে নাট্যকর্মী ও নাট্যপ্রেমী দর্শকের কাছে।

নাটকের চরিত্রগুলো কোনো না কোনভাবে নাট্যচর্চার সাথে যুক্ত। তাদের ব্যক্তিগত সুখদুঃখ, সম্পর্ক, যাপিত জীবন সবকিছুই নাটককে কেন্দ্র করে। মঞ্চই তাদের কাছে জীবনের বসতি। নাটকই তাদের কাছে জীবন। তারা মনে করে– ‘নাটকের একটা দল মানে পরিবারের বাইরে একটা পরিবার’। এখানে আনন্দ আছে, বেদনা আছেসুখ দুঃখের ভাগাভাগি আছে। নাটকের সাথে যুক্ত হওয়ার পেছনেও রয়েছে তাদের জীবনের নানা নাটকীয়তা। আসিফ মেধাবী ছাত্র হলেও অভিনয়ের নেশায় সে শিক্ষাজীবনের ইস্তফা দেয়। শুরু হয় তার নাটকজীবন। স্টার ড্রামেটিক ক্লাবের বার্ষিক নাটকে আসিফের অভিনয় দেখে তার বাবা অশ্রুসজল হয়। মঞ্চে আসিফের অভিনীত চরিত্রের আবেগের সাথে একাত্ম হলেও বাস্তব জীবনে তিনি আসিফের নাট্যচর্চা মেনে নিতে পারেন না। আসিফ অভিনয়ের স্বীকৃতিস্বরূপ মেডেল গলায় দিয়ে বাড়ি ফিরলে তার বাবা সেটি ছুড়ে ফেলে দেয় কুয়োর পানিতে। তার পরও সে অভিনয়ের নেশা ছাড়তে পারেনি। পিতার মৃত্যুর পর পুনরায় নাটকে নামে। আসিফের অভিনয়ে মুগ্ধ হয় ডিস্ট্রিক্ট জজের কন্যা লীনা। নাটককে অঙ্গীকার করে সে আসিফের সাথে পা বাড়ায় যুগলজীবনের পল্লবিত যাত্রাপথে। কিন্তু, নাটকের পথ কখনোই কুসুমাস্তীর্ণ ছিল না। তবুও নাট্যাঙ্গনের নানা বৈরি বাস্তবতা আর ব্যক্তিগত জীবনের অকথিত যন্ত্রণাকে মেনে নিয়ে লীনাও নিজেকে সমর্পণ করেছে নাটকের বন্ধুর প্রাঙ্গণে। নাটকের নির্দেশক বজলু নাটকের প্রতি কী এক অপার ভালোবাসায় এক জীবন কাটিয়ে দিয়েছে নাটকের মঞ্চে। পুরনো কর্মী জলিল সাংসারিক টানাপোড়েন, ব্যক্তিগত জীবনে নানা সংকটে থেকেও এখনো নাটক নিয়ে স্বপ্ন দেখেন। কী এক সম্পর্কের মায়াবী জালে যেন জড়িয়ে আছে পূর্বার কর্মীরা। নাটকের দলের হাজারো সমস্যা সত্ত্বেও এই সম্পর্কের টান টিকিয়ে রেখেছে তাদের নাট্যচর্চা।

নাটক মঞ্চে প্রাণ পায়। নাট্যকর্মীদের অজস্র দিবসের শ্রম, ঘাম, ত্যাগের বিনিময়ে নাটকের পাণ্ডুলিপি জীবন্ত হয়ে ওঠে মঞ্চের মানচিত্রে। তখন দর্শক নাটকের শিল্পবাস্তবতার রসে অবগাহন করে লাভ করে অনির্বচনীয় সুখানুভূতি। নাটক উপভোগকালীন শিল্পীর অপরিমেয় ত্যাগের বিষয়টি দর্শকের কাছে অজানাই থেকে যায়। এনাটক সে অজানা আখ্যানকেই উন্মোচন করেছে। সাজঘর নাটকে মহড়াধীন নাটকের প্রেক্ষাপটে উঠে এসেছে শ্রেণিবিভক্ত সমাজের বিরূপ বাস্তবতা। এবাস্তবতা আমাদের পরিচিত পরিমণ্ডল থেকে নেওয়া। আর নাটকের দলের বাস্তবতায় ব্যক্তির জীবন সংকট, মাতৃত্বের অব্যক্ত যন্ত্রণা, অস্ফুট প্রণয়াকাঙ্ক্ষা, মধ্যবিত্তের সরলপ্রত্যাশা প্রভৃতির প্রতিফলন পরিলক্ষিত হয়। এটি নাট্যকর্মীদের প্রতিদিনকার অভিজ্ঞতা। নাটকটি কোনো সরলরৈখিক কাহিনীবৃত্ত তৈরি করে না কিংবা কোনো একক চরিত্রকেও প্রতিষ্ঠিত করে নাবরং তা পূর্বা নাট্যদলের বহুমাত্রিক ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সুখদুঃখের গল্প হয়ে ওঠে।

রঙ্গমঞ্চে মহড়াধীন নাটকের দৃশ্যমান জীবন কাহিনীর পাশাপাশি সাজঘরেরঅর্থাৎ কুশীলবদের বাস্তব জীবনের নেপথ্য কাহিনী এনাটকে উঠে এসেছে। শেষ পর্যন্ত সাজঘর নাট্যকর্মীদের জীবন, নাট্যচর্চার প্রতিকূল বাস্তবতা ও মঞ্চসংগ্রামের বিশ্বস্ত নাট্যভাষ্য হয়ে দর্শকের মনে শিল্পীর প্রতি শ্রদ্ধা, সম্মান ও সহানুভূতি জাগিয়ে তোলে। এখানেই নাটকটির সার্থকতা।

পূর্ববর্তী নিবন্ধসৌন্দর্য
পরবর্তী নিবন্ধখাগড়াছড়িতে অস্ত্র মামলায় ১৭ বছরের কারাদণ্ড