সাগাই ফোর্ট এস্কেপ অজানা এক অধ্যায়

মোহছেনা ঝর্ণা | শুক্রবার , ১১ অক্টোবর, ২০২৪ at ৭:৩৯ পূর্বাহ্ণ

মুক্তিযুদ্ধের গল্প আমার কাছে কখনো ফিকে হয় না। কখনো একঘেয়ে লাগে না। কারণ সাতকোটি মানুষের গল্পই তো এখনো জানা হলো না আমাদের। এদেশের আনাচেকানাচে এখনো কত শত শত লক্ষ গল্প রয়ে গেছে আমাদের অগোচরে। তাই তো টিভিতে যখন মুক্তিযুদ্ধের উপর নির্মিত একই ছবি বারবার দেখি আমার বিরক্তি লাগে না। ক্লান্তি লাগে না। বরং যতবার দেখি ততবারই চোখ ভিজে যায় সেই ভয়ঙ্কর দিনগুলোতে রক্তাক্ত হয়ে মানুষের রুদ্ধশ্বাস বেঁচে থাকার কথা মনে করে। মুহূর্তেই তাজা প্রাণ হত্যার বীভৎসতায় গা শিরশির করে ওঠে। আতঙ্কে নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়! মুক্তিযুদ্ধের উপর নির্মিত গানগুলো যখনই শুনি সারা শরীর জুড়ে একটা টগবগে শিহরণ হয়। মুক্তিযুদ্ধের গল্প মানেই আমাদের অস্তিত্বের গল্প।

লেখক স্বরলিপি আমাদের মুক্তিযুদ্ধের একদম ভিন্ন একটা বিষয়ের দিকে আলো ফেলেছেন তার “সাগাই ফোর্ট এস্কেপ” বইটিতে। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর পাকিস্তান সেনাবাহিনী, বিমান বাহিনীতে কর্মরত আমাদের বাংলাদেশের ছেলেদের যে কী অনিশ্চয়তার ভেতর একটা কঠিন সময় পার করতে হয়েছে সে বিষয়টা কখনো সেভাবে ভাবনাতেই আসেনি। সাধারণ ভাবে অন্য কারো ভাবনাতে এসেছে কি না জানি না, অন্তত আমার ভাবনাতে কখনো আসেনি।

মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন পাকিস্তান সেনাবাহিনী এবং বিমান বাহিনীতে দায়িত্বরত প্রায় ২০ হাজার সামরিক সদস্য পশ্চিম পাকিস্তানে অবস্থান করছিলেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তাঁদেরকে বন্দি করা হলো বিভিন্ন দুর্গে বা বন্দিশালায়। সেরকমই একটি বন্দিশালা হলো সাগাই ফোর্ট। যেটি পাকিস্তানের খাইবার পাতুনখোয়ায় অবস্থিত একটি দুর্গম দুর্গ। এখানে মূলত অবিবাহিত সামরিক সদস্যদের বন্দি করে রাখা হয়েছিল।

এই বন্দিদশা থেকে বেশ ক’জন সামরিক সদস্য পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছিলেন যেটি “সাগাই ফোর্ট এস্কেপ” নামে বইটির আলোচ্য বিষয়। কিভাবে তাঁরা ছিলেন সেখানে, কিভাবে পালিয়েছেন, কেমন শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছেন এসব বিষয় সেই সাগাই ফোর্ট পালিয়ে আসা বীর যোদ্ধাদের মুখ থেকেই লিপিবদ্ধ করেছেন স্বরলিপি, যা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন।

সাগাই ফোর্ট এস্কেপ এর মূল পরিকল্পনাকারী ক্যাপ্টেন আনিসুর রহমান সিনহা। তাঁর বরাতে জানা যায়, সাগাই ফোর্টএ বন্দি বাঙ্গালির সংখ্যা ছিল প্রায় তিনশ জন। সেখান থেকে ১১ জন ফোর্ট থেকে পালাতে সক্ষম হন। কিন্তু তাঁদের ভেতর থেকে চারজন স্থানীয় খাঁচাদারদের হাতে ধরা পড়েন। তাঁদেরকে পাকিস্তানে মিলিটারির হাতে তুলে দেওয়া হয়। এরপর তাঁদের অনেক কঠিন নির্যাতনের শিকার হতে হয়। কোর্ট মার্শালের মুখোমুখি হতে হয় ক্যাপ্টেন আনিসুর রহমান সিনহাকে।

সাগাই ফোর্টে বন্দি মানুষগুলো জানতো না সরকারিভাবে তাঁরা তখন কোন দেশের নাগরিক। স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে আসলে তাঁরা চাকরি ফিরে পাবেন কি পাবেন না এরকম অনিশ্চয়তাও ছিল তাঁদের মনে। তবুও তাঁরা স্বাধীন বাংলাদেশেই ফিরতে মরিয়া ছিলেন। তাঁদের সুযোগ ছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সদস্য হয়েই পাকিস্তানে থেকে যাওয়ার। কিন্তু তাঁরা তা চাননি।

পরবর্তীতে অবশ্য সাগাই ফোর্ট সহ অন্যান্য বন্দীসদস্যদের স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরিয়ে আনা হয় এবং তাদের চাকরিও আগের পদেই বহাল থাকে। তারপরও বন্দিদশায় তাঁদের প্রতিটা মুহূর্তের দুঃশ্চিন্তা, অনিশ্চয়তা এবং অবশেষে দুর্গ পালানোর দুঃসাহসী পদক্ষেপ সবমিলিয়ে স্বরলিপি তার কলমে আমাদের একটা নতুন দিক সম্পর্কে জানালেন বলে স্বরলিপিকে ধন্যবাদ। আর এই গল্পগুলো যেহেতু সাগাই ফোর্টের দুঃসাহসী অভিযানের সদস্যদের মুখ থেকে সরাসরি জানা গেছে সেকারণে এই গল্প (এখন গল্পই বলছি, কিন্তু ঘটনার সময়কার শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতির কথা ভাবতেও পারছি না) গুলো আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ।

স্মৃতিচারণমূলক সত্য ঘটনা অবলম্বনে রচিত “সাগাই ফোর্ট এস্কেপ” পড়ে ভালো লেগেছে। একটা নতুন দিক জানলাম বলে আরও বেশি ভালো লেগেছে।

ইমেইল: swapnopriyo453@gmail.com>

পূর্ববর্তী নিবন্ধকোতোয়ালি থানা ছাত্রদলের সন্ত্রাস বিরোধী বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ
পরবর্তী নিবন্ধপুঁথির জাদুকর আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ