কক্সবাজার থেকে টেকনাফ পর্যন্ত প্রায় ১শ কিলোমিটারব্যাপী সমুদ্র সৈকতজুড়ে আছড়ে পড়ছে বঙ্গোপসাগরের ‘লাল জোয়ার’। গত ফেব্রুয়ারির শেষ দিক থেকে সমুদ্র বিজ্ঞানীরা বিষয়টি লক্ষ্য করলেও সম্প্রতি বিষয়টি উদ্বেগজনক পর্যায়ে পৌঁছেছে বলে মনে করছেন তারা। এ লাল জোয়ারই সাম্প্রতিক বঙ্গোপসাগরে তিমির মৃত্যুর অন্যতম কারণ বলেও ধারণা বিজ্ঞানীদের। এছাড়া গত মাসের শেষ দিকে কক্সবাজারের চিংড়ি পোনা উৎপাদনকারী হ্যাচারিগুলোর প্রায় দেড়শ কোটি পোনা মারা যাওয়ার ঘটনায় সাগরের এ ‘বিষাক্ত’ পানিকেই দুষছেন হ্যাচারি মালিকরা।
আবহাওয়াগত কারণে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সাগরগুলোতে মাঝেমধ্যে এমন লাল জোয়ারের ঘটনা ঘটে বলে জানান বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিএফআরআই) সামুদ্রিক মৎস্য ও প্রযুক্তি কেন্দ্রের প্রধান ড. শফিকুর রহমান। তিনি বলেন, ক্রমাগত তাপমাত্রা বাড়তে থাকলে এবং দীর্ঘদিন বৃষ্টিপাত না হলে কূলবর্তী সাগর ও নদীতে এক ধরনের ক্ষতিকর ফাইটো প্লাঙ্কটন (উদ্ভিজ্জ অণুজীব) বিস্তার করে। এই প্লাঙ্কটনগুলো পানির কলামে মিশে থাকা অক্সিজেন উপর দিকে তুলে আনে। যার কারণে পানির নিচের দিকে অক্সিজেন শূন্যতা তৈরি হয় এবং পানিতে বিষাক্ততা ছড়িয়ে পড়ে। বিষয়টি জলজ প্রাণীর জন্য হয় মারাত্মক। বৃষ্টিপাত হলে পরিস্থিতির উন্নতি হবে বলে মনে করেন তিনি।
বাংলাদেশ সমুদ্র গবেষণা ইনস্টিটিউটের বায়োলজিক্যাল ওশানোগ্রাফি বিভাগের বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা তরিকুল ইসলাম বলেন, গত ফেব্রুয়ারির শেষ দিক থেকে আমরা লাল জোয়ারের বিষয়টি লক্ষ্য করছি। তবে সম্প্রতি বিষয়টি উদ্বেগজনক পর্যায়ে পৌঁছেছে বলে মনে হচ্ছে। এ লাল জোয়ারই সম্প্রতি বঙ্গোপসাগরে তিমির মৃত্যুর অন্যতম কারণ হতে পারে।
তিনি বলেন, এক ধরনের ক্ষতিকর ফাইটো প্লাঙ্কটনের কারণে সাগরের পানির রং হলুদ বা বাদামিতে রূপান্তরিত হয়। হার্মফুল এলগার্ল ব্লুম বা এইচএবি নামে পরিচিত সেই বাদামি বা হলুদ পানির জোয়ারই বিশ্বব্যাপী ‘লাল জোয়ার’ নামে পরিচিত। এ কারণে সাগরের মাছসহ অন্যান্য প্রাণীর জীবন হুমকির মুখে পড়ে।
বাংলাদেশ সমুদ্র গবেষণা ইনস্টিটিউটের ভূ-তাত্ত্বিক ওশানোগ্রাফি বিভাগের সিনিয়র বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মো. জাকারিয়া বলেন, নদী ও খাল থেকে বয়ে আসা হালকা স্বাদু পানি যখন সমুদ্রের লবণাক্ত ভারী পানির সাথে মিশে, তখন সেটি সমুদ্রের পানির কলামে হরাইজন্টালি বা আনুভূমিকভাবে স্তর পুনর্বিন্যাস (স্ট্রেটিফিকেশন) না করে ভার্টিক্যালি বা উল্লম্বভাবে বিন্যস্ত হলেই সাগরের পানিতে অঙিজেন শূন্যতা তৈরি হয়। যেটি লাল জোয়ার নামে পরিচিত। নদী মোহনা ও সমুদ্র উপকূলে হার্মফুল এলগার্ল ব্লুম বা এইচএবি অনিয়ন্ত্রিত পর্যায়ে পৌঁছালেই লাল জোয়ারের সৃষ্টি হয়।
কঙবাজারে গত তিন দশকে এমন ঘটনা নজিরবিহীন বলে জানান সমুদ্রপাড়ের জেলেপল্লীর বাসিন্দারা। কঙবাজার শহরের দরিয়ানগর ঘাটের বোট মালিক নজির আলম বলেন, সাগর থেকে মাঝেমধ্যে এমন দুর্গন্ধযুক্ত গেজাইন্যা (ময়লাযুক্ত পানি ও আবর্জনা) ভেসে আসে। কিন্তু গত প্রায় এক মাস ধরে যে ঘটনা দেখা যাচ্ছে, তা আগে কখনও দেখা যায়নি।
কলাতলীর জেলে আবদুল গফুর বলেন, গত প্রায় ২/৩ মাস ধরেই সাগরের পানি বর্তমানে ঘোলাটে রয়েছে। যে কারণে মাছও ধরা পড়ছে খুব কম।
এছাড়া গত মাসের শেষ দিকে কঙবাজারের চিংড়ি পোনা উৎপাদনকারী হ্যাচারিগুলোর প্রায় দেড়শ কোটি পোনা মারা যাওয়ার ঘটনায় সাগরের এ ‘বিষাক্ত’ পানিকেই দুষছেন হ্যাচারি মালিকরা।
কঙবাজারের চিংড়ি পোনা হ্যাচারিগুলোর সংগঠন শ্রীম্প হ্যাচারি এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (শ্যাব) মহাসচিব নজিবুল ইসলাম বলেন, কঙবাজারের ৩০টি হ্যাচারি গত ফেব্রুয়ারি থেকে পোনা উৎপাদন করছে। কিন্তু এপ্রিলের চতুর্থ সপ্তাহ থেকে হঠাৎ হ্যাচারিগুলোর পোনা মরে যেতে শুরু করে। ইতোমধ্যে প্রায় দেড়শ কোটি পোনা মরে যাওয়ায় অধিকাংশ হ্যাচারির উৎপাদন বন্ধ হয়ে গেছে। তিনি জানান, কঙবাজারের হ্যাচারিগুলোতে সাগর থেকে সংগৃহীত লবণাক্ত পানিতে কৃত্রিম উপায়ে মা মাছ থেকে পোনা ফোটানো হয়। কিন্তু সাগরের পানি বিষাক্ত হয়ে পড়লে পোনা মারা যায়। তবে পোনা মারা যাওয়ার আরো অনেক কারণ থাকতে বলে মনে করেন সমুদ্রবিজ্ঞানীরা।
কঙবাজার আবহাওয়া বিভাগ জানিয়েছে, গত ৬ মাসে কঙবাজারে কেবল একবারই সামান্য বৃষ্টিপাত হয়েছে। যে কারণে গত মাসের মাঝামাঝি সময় থেকে তাপমাত্রা ক্রমাগত বেড়ে চলেছে। কয়েকদিন ধরে তাপমাত্রা ৩৮ ডিগ্রির উপরে ওঠানামা করছে।