সাগরতলে সম্ভাবনার দুয়ার

বিশ্ব মহাসাগর দিবস আজ

আহমদ গিয়াস, কক্সবাজার | শনিবার , ৮ জুন, ২০২৪ at ১০:০১ পূর্বাহ্ণ

বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশের প্রায় মূল ভূখণ্ডের সমান নিজস্ব জলসীমা রয়েছে, যার আয়তন ১ লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গকিলোমিটার। মাছ ধরা, সমুদ্রপথে মালামাল পরিবহন ও তেলগ্যাস উত্তোলন ছাড়া জাতীয় অর্থনীতিতে এই বিশাল আয়তনের জলসীমার অবদান সীমিত। কিন্তু সাগরতলে শহর ও বাড়ি নির্মাণসহ নতুন নতুন উদ্ভাবনী কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে বঙ্গোপসাগরকে ঘিরে দেশের সুনীল অর্থনীতিতে সম্ভাবনার নতুন দুয়ার খুলতে পারে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। পৃথিবীর প্রায় এক চতুর্থাংশ মানুষ সাগরের ওপর নির্ভরশীল। সাগর টিকে না থাকলে এই পৃথিবীতে মানুষের টিকে থাকাও কঠিন হয়ে পড়বে। এজন্য সমুদ্রের গুরুত্ব তুলে ধরতে আজ ৮ জুন বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও উদযাপিত হচ্ছে বিশ্ব সমুদ্র দিবস।

এবারের বিশ্ব মহাসাগর দিবসের প্রতিপাদ্য হলো Awaken New Depths বা সমুদ্রের প্রতি নতুন গভীরতা জাগ্রত করুন। আর এই বছরের অ্যাকশন থিম বা কর্মপ্রতিপাদ্য হলো Catalysing action for our ocean and climate’ বা ‘আমাদের মহাসাগর এবং জলবায়ুৃর জন্য যুগান্তরী পদক্ষেপ’।

১৯৯২ সালে রিও ডি জেনেরিওতে অনুষ্ঠিত আর্থ সামিটে বিশ্ব মহাসাগর দিবসের প্রস্তাব করা হয়। এরপর ৫ ডিসেম্বর, ২০০৮ তারিখে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ প্রতি বছর ৮ জুনকে বিশ্ব মহাসাগর দিবস হিসাবে পালন করার জন্য সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। সমুদ্রের সাথে মানুষের সম্পর্ক সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টির জন্য দিবসটি পালন করা হয়। প্রতি বছর দিবসটি স্মরণে জাতিসংঘের ইউএন ডিভিশন ফর ওশান অ্যাফেয়ার্স অ্যান্ড দ্য ল অফ দ্য সি জনসচেতনতামূলক নানা কর্মকাণ্ডের আয়োজন করে।

বাংলাদেশ ওশানোগ্রাফিক রিসার্চ ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক প্রফেসর ড. তৌহিদা রশীদ জানান, দিবসটি স্মরণে কক্সবাজারেও বাংলাদেশ ওশানোগ্রাফিক রিসার্চ ইনস্টিটিউটের উদ্যোগে আয়োজন করা হয়েছে দিনব্যাপী নানা অনুষ্ঠানমালার। কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে সকাল ৯টায় বোরি মিলনায়তনে ‘Awaken New Depths’ বা সমুদ্রের প্রতি নতুন গভীরতা জাগ্রত করুন প্রতিপাদ্য নিয়ে সেমিনার ও বিকালে সমুদ্র সৈকতে পরিষ্কারপরিচ্ছন্নতা অভিযান। আর এসব অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি থাকবেন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের সচিব আলী হোসেন।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ওশানোগ্রাফি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. ওয়াহিদুল আলম বলেন, বাংলাদেশের প্রায় অর্ধেক মানুষ বঙ্গোপসাগরের ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু প্লাস্টিকসহ নানা দূষণের কারণে আগামী ৩০ থেকে ৫০ বছরের মধ্যে সাগর ব্যবহার অযোগ্য হয়ে উঠতে পারে বঙ্গোপসাগর। তাই বঙ্গোপসাগরের দীর্ঘস্থায়ী ব্যবহার নিশ্চিত করতে নানা ইতিবাচক পদক্ষেপ নিতে হবে।

বঙ্গোপসাগর হলো ভারত মহাসাগরের উত্তরপূর্ব অংশ, যার পশ্চিম ও উত্তরপশ্চিমে ভারত, উত্তরে বাংলাদেশ এবং পূর্বে মিয়ানমার এবং ভারতের আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ দ্বারা আবদ্ধ। এর দক্ষিণ সীমা হলো সঙ্গমান কান্দা, শ্রীলঙ্কা এবং ইন্দোনেশিয়ার সুমাত্রার উত্তরপশ্চিমতম বিন্দুর মধ্যে একটি রেখা। এটি বিশ্বের বৃহত্তম জল অঞ্চল, যাকে উপসাগর বলা হয়। দক্ষিণ এশিয়া ও দক্ষিণপূর্ব এশিয়ায় বঙ্গোপসাগরের ওপর নির্ভরশীল দেশ রয়েছে। যার মধ্যে ভারত, ইন্দোনেশিয়া, মিয়ানমার, শ্রীলঙ্কা ও বাংলাদেশ অন্যতম। এর প্রাথমিক প্রবাহ ভারত মহাসাগর আর অববাহিকার দেশ হলো বাংলাদেশ। বঙ্গোপসাগরের সর্বোচ্চ দৈর্ঘ্য ২ হাজার ৯০ কিমি (,৩০০ মাইল) এবং সর্বোচ্চ প্রস্থ ১ হাজার ৬১০ কিমি (,০০০ মাইল)। এর উপরিভাগের আয়তন ২৬ লক্ষ কিমি (১০ লাখ বর্গমাইল)। বঙ্গোপসাগরের সর্বোচ্চ গভীরতা ৪ হাজার ৬৯৪ মিটার বা ১৫ হাজার ৪০০ ফুট। তবে গড় গভীরতা ২ হাজার ৬০০ মিটার (,৫০০ ফুট)

পৃথিবীতে মোট ৬৪টি লার্জ মেরিন ইকোসিস্টেম বা সামুদ্রিক বাস্তুতন্ত্র রয়েছে, যার মধ্যে আমাদের বঙ্গোপসাগরও অন্যতম। বঙ্গোপসাগরকে বলা হয় পৃথিবীর বৃহত্তম ডেল্টা বা অববাহিকা। পৃথিবীর তৃতীয় বৃহত্তম রিভার সিস্টেম গঙ্গাব্রহ্মপুত্রমেঘনা বা পদ্মাযমুনামেঘনা বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে বিপুল পরিমাণ স্বাদু পানি বঙ্গোপসাগরে পতিত হয়। যার ফলে বাংলাদেশের উপকূল ও সাগরের পানি পৃথিবীর অন্যতম উর্বর জলরাশি হিসাবে স্বীকৃত, যেখানে রয়েছে একটি সমৃদ্ধ জীববৈচিত্র্যসহ বিশ্বে বিপন্নপ্রায় বিরল কয়েকটি সামুদ্রিক জলজ স্তন্যপায়ী প্রাণীর আবাসস্থল (হট স্পট)। আমাদের বঙ্গোপসাগরে রয়েছে মহাসাগরীয় জায়ান্ট হিসাবে পরিচিত বিশ্বের বিরল প্রজাতির তিমি ও ডলফিন।

Wildlife Conversation Society (WCS) এর সর্বশেষ জরিপ মতে, বাংলাদেশে ১৩ প্রজাতির সিটাসিয়ান বা জলজ স্তন্যপায়ী প্রাণী রয়েছে; যার মধ্যে ৫ প্রজাতির তিমি, ৭ প্রজাতির শুশুক (ডলফিন) ও এক প্রজাতির হুছুম (পরপইস)। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মেরিটাইম অ্যাফেয়ার্স ইউনিট বাংলাদেশের সমুদ্র এলাকায় ৩৪৭ প্রজাতির সামুদ্রিক মাছ, ৪৯৮ প্রজাতির ঝিনুক, ৫২ প্রজাতির চিংড়ি, ৫ প্রজাতির লবস্টার, ৬ প্রজাতির কাঁকড়া, ২২০ প্রজাতির সামুদ্রিক শৈবাল ও ৬১ প্রজাতির সিগ্রাস চিহ্নিত করেছে।

জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ ও প্রকৌশল বিভাগের প্রফেসর ড. আশরাফ আলী সিদ্দিকী বলেন, পৃথিবীর এক পঞ্চমাংশ দেশের কোনো সমুদ্রসীমা নেই। এ দেশগুলো ল্যান্ডলক্‌ড বা স্থলসীমাবেষ্ঠিত ভূখন্ড হিসাবে পরিচিত। বাংলাদেশ সাগরবেষ্ঠিত এমন এক ভূখণ্ড, যার রয়েছে স্থলভাগের প্রায় সমান সমুদ্রখণ্ড। কিন্তু মাছ ধরা, সমুদ্রপথে মালামাল পরিবহন, তেলগ্যাস উত্তোলন ও খনিজ সম্পদ উত্তোলন এবং পর্যটন ছাড়া জাতীয় অর্থনীতিতে এই বিশাল আয়তনের জলসীমার অবদান খুব সীমিত। অথচ সাগরতলে শহর ও বাড়ি নির্মাণসহ নতুন নতুন উদ্ভাবনী কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে বঙ্গোপসাগরকে ঘিরে দেশের সুনীল অর্থনীতিতে সম্ভাবনার নতুন দুয়ার খুলতে পারে। তিনি বলেন, কর্ণফুলী নদীর তলদেশে টানেল নির্মাণ করা গেলে সাগরতলে কেন শহর ও বসতি গড়ে তোলা যাবে না?

পূর্ববর্তী নিবন্ধপ্রেমের টানে শ্রীলঙ্কার তরুণী ফটিকছড়িতে
পরবর্তী নিবন্ধমিশ্র ফল চাষে বদলে যাচ্ছে পাহাড়ের কৃষি অর্থনীতি