ছাত্র–জনতার গণঅভ্যুত্থানে সরকার পতনের আগেই দ্বাদশ সংসদের সদস্যদের শুল্কমুক্ত সুবিধায় আমদানি করা ৭টি গাড়ি তড়িঘড়ি করে খালাস করে নিয়েছেন ক্রিকেটার সাকিব আল হাসান, চিত্রনায়ক ফেরদৌস ও ব্যারিস্টার সুমনসহ সাবেক সাতজন এমপি।
অন্যরা হলেন, ব্রাহ্মণবাড়িয়া–৫ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ফয়জুর রহমান, লক্ষ্মীপুর–৩ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য গোলাম ফারুক পিংকু, নাটোর–১ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য আবুল কালাম, কিশোরগঞ্জ–৫ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য মুজিবুর রহমান মঞ্জু।
জুলাই মাসেই উত্তপ্ত পরিস্থিতি আঁচ করতে পেরে তারা গাড়িগুলো খালাস করে নেন। ওই সময় আরো ৪ জন সাবেক এমপি ৪টি গাড়ির জন্য ছাড়পত্র জমা দিলেও কাস্টম ক্লিয়ারেন্স না পাওয়ায় ডেলিভারি নিতে পারেননি। এছাড়া ৪৪ জন এমপির নামে গাড়ি আনা হলেও সেগুলোর কোনো ছাড়পত্র বা ক্লিয়ারেন্স পাওয়ার আগেই সংসদ বিলুপ্ত হয়ে গেছে। এসব গাড়ি এখন আর এমপি কোটায় খালাসের সুযোগ নেই বলে জানিয়ে কাস্টমস সূত্র বলেছে, গাড়িগুলো আটকা পড়েছে। সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী গাড়িগুলোর ব্যাপারে পদক্ষেপ নেয়া হবে। গাড়িগুলোর প্রতিটি ৮১০ শতাংশ শুল্ক পরিশোধের পর একেকটির বাজারমূল্য দাঁড়াবে দশ কোটি টাকার ধারেকাছে। তবে সরকার সহজ শর্তে গাড়িগুলো বিক্রির প্রক্রিয়া গ্রহণের কথা বলেছে। সূত্র জানায়, দেশের প্রচলিত আইনে সংসদ সদস্যরা প্রতি পাঁচ বছরে একবার শুল্কমুক্ত সুবিধায় গাড়ি আমদানি করতে পারেন। তবে গত বেশ কয়েক বছর ধরে এমপিরা হাই সিসির দামী গাড়ি আনতে শুরু করেন। শুল্ক আইন অনুযায়ী ৪ হাজার সিসির বেশি ইঞ্জিনের এ ধরনের গাড়ির শুল্ক ৮১০ শতাংশ। অর্থাৎ একটি গাড়ির দাম ১ কোটি টাকা হলে তার উপর ৮ কোটি ১০ লাখ টাকা শুল্ক পরিশোধ করতে হবে। দেশের এমপিদের এই শুল্ক পরিশোধ করতে হয় না। চলতি ২০২৪–২৫ অর্থবছরের বাজেটে সংসদ সদস্যদের গাড়ির ওপর ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপের প্রস্তাব করা হলেও প্রস্তাবটি বাতিল হয়ে গেছে।
কাস্টমস সূত্র জানায়, সদ্য বিলুপ্ত দ্বাদশ জাতীয় সংসদের ৫১ জন সদস্য শুল্কমুক্ত সুবিধায় গাড়ি আমদানি করেন। এদের মধ্যে সাবেক ডেপুটি স্পিকার শামসুল হক টুকু, সাবেক মন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক, সাবেক মন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া, সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী আরাফাত, মাগুরা–১ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য সাকিব আল হাসান, ব্রাহ্মণবাড়িয়া–৫ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ফয়জুর রহমান, লক্ষ্মীপুর–৩ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য গোলাম ফারুক পিংকু, নাটোর–১ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য আবুল কালাম, কিশোরগঞ্জ–৫ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য মুজিবুর রহমান মঞ্জু, সংরক্ষিত নারী আসনের সাবেক সংসদ সদস্য জান্নাত আরা হেনরি, সাবেক সংসদ সদস্য ও চিত্রনায়ক ফেরদৌস, হবিগঞ্জের ব্যারিস্টার সৈয়দ সায়েদুল হক সুমন এবং বিএনপি থেকে আওয়ামী লীগে যোগ দেওয়া সাবেক এমপি শাহজাহান ওমরসহ অন্তত ৫১ জন।
এদের প্রত্যেকেই হাই সিসির মার্সিডিজ বেঞ্জ, রেঞ্জ রোভার এবং বিএম ডব্লিউ, টয়োটা ল্যান্ড ক্রুজার, টয়োটা জিপ, টয়োটা এলসি স্টেশন ওয়াগটসহ অত্যাধুনিক মডেলের গাড়ি আমদানি করেন।
এদের মধ্যে ক্রিকেটার সাকিব আল হাসান, ফেরদৌস ও ব্যারিস্টার সুমনসহ তৎকালীন সাত সংসদ সদস্য চট্টগ্রাম বন্দর থেকে গাড়ি ছাড় করে নিয়ে যান। ওই সাত গাড়িতে সংশ্লিষ্টরা ৭৫ কোটি টাকা শুল্ক সুবিধা পেয়েছেন। সাবেক সংসদ সদস্য জান্নাত আরা হেনরিসহ আরো একজন সমস্ত প্রক্রিয়া সম্পন্ন করলেও গাড়ি খালাস নিতে পারেননি। এছাড়া অনুপম শাহজাহান জয় ও এবিএম আনিসুজ্জামান নামে আরও দুই সাবেক এমপি গাড়ি ছাড় করানোর জন্য নথিপত্র জমা দিয়েছিলেন। উক্ত চারটিসহ মোট ৪৪ টি গাড়ি এখন বন্দরের শেডে রয়েছে। জাহাজ থেকে নামানোর ৩০ দিন পেরিয়ে গেলে নিয়মানুযায়ী গাড়িগুলো নিলামে বিক্রির প্রক্রিয়া শুরু করবে চট্টগ্রাম কাস্টমস।
কাস্টমস কর্মকর্তারা বলেছেন, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ যেহেতু ভেঙে গেছে তাই এমপিদের শুল্কমুক্ত সুবিধায় গাড়ি পাওয়ার কোনো সুযোগ আর নেই। তবুও প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনার জন্য জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে চিঠি দেয়া হয়েছে। এনবিআর থেকে যে নির্দেশনা দেয়া হবে সেভাবে পরবর্তী কার্যক্রম গ্রহণ করা হবে বলেও তারা জানান।
চট্টগ্রাম কাস্টমস কমিশনার মোহাম্মদ ফাইজুর রহমান সাংবাদিকদের বলেন, ৬ আগস্টের আগে যারা শুল্কায়ন সম্পন্ন করেছেন তাদের গাড়ি খালাস হয়ে গেছে। তবে জাতীয় সংসদ বিলুপ্ত হওয়ার পর এমপি হিসেবে শুল্কমুক্ত সুবিধা আর তারা পাবেন না। এক্ষেত্রে যথাযথ প্রক্রিয়ায় শুল্ক দিয়ে এসব গাড়ি খালাস নিতে হবে।
অপরদিকে শুল্কমুক্ত সুবিধায় আনা গাড়ি যদি যথাযথ প্রক্রিয়ায় কেউ খালাস না করেন তবে সেগুলো বিক্রি করতে পারে সরকার। গত বুধবার (২৮ আগস্ট) অন্তর্বর্তী সরকারের অর্থ ও বাণিজ্য উপদেষ্টা ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ ঢাকায় সাংবাদিকদের বলেছেন, সাবেক এমপিদের নামে চট্টগ্রাম বন্দরে এসে আটকে থাকা শুল্কমুক্ত গাড়ি ফেরত পাঠানো ঠিক হবে না। ফেরত পাঠালে দেশ রাজস্ব হারাবে। তাই এই গাড়িগুলো বিক্রি করার শর্ত সহজ করে দেওয়ার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।