সাংবাদিকতার পথিকৃৎ

মহিউদ্দিন ইমন | শনিবার , ২১ ডিসেম্বর, ২০২৪ at ৬:১০ পূর্বাহ্ণ

অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ ১৯২২ সালের ৬ জুলাই তার পিতা আবদুল হাদী চৌধুরীর কর্মক্ষেত্র তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের বিহারের পাটনায় জন্মগ্রহণ করেন। তবে তার পৈতৃক নিবাস চট্টগ্রাম জেলার রাউজান থানার সুলতানপুর গ্রামে। তিনি ১৯৪২ সালে চট্টগ্রাম কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করে কলকাতার ইসলামিয়া কলেজে স্নাতক শ্রেণিতে ভর্তি হন। কিন্তু হঠাৎ পিতার মৃত্যু হলে তিনি ফিরে আসেন চট্টগ্রামে। চট্টগ্রাম কলেজ থেকে স্নাতক সমাপ্ত করে পরবর্তীতে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইসলামের ইতিহাসে এম.. ডিগ্রি অর্জন করেন। অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদের কর্মজীবন ও রাজনৈতিক জীবন দুইই শুরু হয়েছিল ছাত্রাবস্থায়। তাঁর কর্মজীবন ছিল বহুমুখী। ব্যবসা করেছেন, ব্যাংক কর্মকর্তা ছিলেন, শিক্ষকতার সঙ্গে যুক্ত থেকেছেন বেশ কিছুকাল, আর সাংবাদিকতা এর সাথে তো জড়িয়ে ছিলেন নিবিড়ভাবে।

১৯৬২ সাল থেকে আমৃত্যু চট্টগ্রামের প্রাচীন দৈনিক পত্রিকা ‘দৈনিক আজাদী’র সম্পাদক ছিলেন তিনি। ১৯৭১ সালে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র এবং বৈদেশিক প্রচার দপ্তরে কাজ করেন। সকল ক্ষেত্রে সদাই তিনি ছিলেন সৎ, নিষ্ঠবান। ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিক জীবনেও ছিলেন না তার ব্যতিক্রম। মানবিক মূল্যবোধসম্পন্ন বিবেক আর মানব কল্যাণমুখী চেতনায় অবিচল ছিলেন আজীবন। বায়ান্নোর ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে চুয়ান্নোর যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ছেষট্টির ছয় দফা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণ অভ্যুত্থান, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধসহ দেশের স্বাধিকার ও প্রগতিশীল বিভিন্ন আন্দোলন সংগ্রামে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত ছিলেন তিনি।

সাংবাদিক হিসেবে তার লেখনী সর্বদাই সত্য আর ন্যায়ের পক্ষে ছিল সোচ্চার। শুভ্র জীবনাদর্শ, নির্লোভ দৃঢ়চিত্ত আর ঋজু ব্যক্তিত্বের গুণে তিনি তাঁর পেশাগত পরিচয়কে ছাপিয়ে নিজেই একটি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছিলেন।

বাংলাদেশের স্বাধীকার আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধে অসাধারণ অবদানের জন্য ২০১৯ সালে দেশের সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কার হিসাবে পরিচিত ‘স্বাধীনতা পুরস্কার’ প্রদান করা হয় তাঁকে অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ শিক্ষকতা দিয়ে কর্মজীবন শুরু করলেও ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেকের অনুপ্রেরণায় তিনি সাংবাদিকতায় যুক্ত হন। তাঁর সম্পাদনায় দৈনিক আজাদী পত্রিকা দেশের সংবাদপত্র জগতে অনন্য অবস্থানে পৌঁছে।

অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ চট্টগ্রামে সাংবাদিক অঙ্গনের একজন সুনিপুণ পথিকৃৎ। রাজনৈতিক অঙ্গনেও তিনি বাঙালি জাতীয়তাবাদীর চেতনার একটি আলোকবর্তিকা।

মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক হিসেবেও তাঁর অন্যতম ভূমিকা ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ সম্পাদক ও সাংবাদিক হিসেবে যেমন সত্যদ্রষ্টা ছিলেন একইভাবে রাজনীতিক হিসেবেও তিনি ছিলেন নির্লোভ। ৭০’র জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জয়ী হয়েছিলেন। এরপর অসহযোগ আন্দোলনের সময় তিনি বাঙালি জাতিসত্তার উত্থানে আন্তরিকভাবে সক্রিয় ছিলেন।

ভারতে প্রবাসী থাকাকালে অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ মুক্তিযুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। তিনি তাঁর উপর অর্পিত দায়িত্ব অত্যন্ত নিষ্ঠার সাথে পালন করতেন, প্রবাসে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র ও মুজিবনগর সরকারের তথ্য মন্ত্রণালয় পরিচালনায়ও অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ অগ্রগণ্য ভূমিকা পালন করেছেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে নিজের শত আর্থিক কষ্টের মাঝেও অন্যদের কষ্টে পাশে গিয়ে দাঁড়িয়েছেন। বর্ণাঢ্য গুণাবলীর অধিকারী অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদের শুন্যস্থান কখনো পূরণ হবার নয়। একজন মানুষ হিসেবে তিনি মানুষের জন্যই নিবেদিত ছিলেন। চট্টগ্রাম তথা দেশের প্রবীনতম সম্পাদক, সর্বজনের আস্থাভাজন, দুর্গত বাংলার শুভ বিবেক খ্যাত অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ আমাদের অনুপ্রেরণার উৎস।

মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক, সংবিধান প্রনেতা, বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহচর অসামপ্রদায়িক চেতনার প্রতিক অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ। আজীবন সততা ও সাহসীকতা ছিল তাঁর রাজনৈতিক নেতৃত্বের সম্বল। তাঁর সততা, ন্যায়নিষ্টা ও অসামপ্রদায়িক রাজনীতি নতুন প্রজন্মকে যুগ যুগ ধরে উদ্দীপ্ত করবে। অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ ছিলেন চিত্তের পূজারী। অতিসাধারণ জীবনযাপনের মাধ্যমে দলমত নির্বিশেষে সকলের কাছে ছিলেন গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিত্ব এবং অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত। কর্মের মাধ্যমে তিনি আজীবন সবার হৃদয়ে চিরঞ্জীব হয়ে থাকবেন।

পূর্ববর্তী নিবন্ধচট্টগ্রাম ওয়াসার কর্মকাণ্ডে জনদুর্ভোগ চরমে
পরবর্তী নিবন্ধঈশান এখন