প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নারী ও শিশু অধিকার এবং উন্নয়ন নিশ্চিতকরণে নানা রকম পদক্ষেপ এবং কার্যক্রম গ্রহণ করেন। এ লক্ষ্যে সরকার জেন্ডার সমতা এবং নারীর ক্ষমতায়নে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন এবং নারীর প্রতি সব ধরনের বৈষম্য দূরীকরণ সনদ অনুসরণে কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করছে। জাতিসংঘ কর্তৃক ঘোষিত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য মাত্রার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক কর্মকান্ডে নারীর সম্পৃক্তকরণকে শক্তিশালী অনুঘটক এবং বহুমাত্রিক বিষয় হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। উল্লেখ্য, জাতিসংঘ ২০১৫ সালে এসডিজি গ্রহণ করে। এটি ১৫ বছর মেয়াদি। এর উদ্দেশ্য ২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্বে শান্তি ও সমৃদ্ধি নিশ্চিত করা। সেই লক্ষ্যে ১৭টি লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। আর ১৬৯টি সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে। জাতিসংঘ এর আগে সহস্রাব্দের উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এমডিজি) গ্রহণ করেছিল। এরপরই এসডিজি আসে। এসডিজির লক্ষ্যগুলোর মধ্যে দারিদ্র্য দূর করা, খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করা, সুস্বাস্থ্য, উন্নত শিক্ষা নিশ্চিত ও লিঙ্গবৈষম্য প্রতিরোধ অন্যতম।
নারীর ক্ষমতায়ন একটি দেশের সার্বিক উন্নয়নের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। নারী-পুরুষের ব্যবধান কমিয়ে এনে লিঙ্গ সমতা অর্জন, নারীর ক্ষমতায়ন ও উন্নয়ন ছাড়া দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন সম্ভব নয়। অর্থনৈতিক উন্নয়ন, সুষম সমাজ গঠন ও সামগ্রিক অগ্রগতিকে কাঙ্ক্ষিত মানে পৌঁছানোর লক্ষ্যে নারী-পুরুষের সমান অংশীদারত্ব নিশ্চিতকরণের লক্ষ্য নিয়ে বিশ্বব্যাপী গৃহীত হয়েছে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য মাত্রা। বিশ্বব্যাপী লিঙ্গ সমতা অর্জন এবং সব নারী ও মেয়েদের ক্ষমতায়নের লক্ষ্যকে সামনে রেখে গৃহীত বৈশ্বিক উন্নয়ন এজেন্ডার এই অভীষ্টে বাংলাদেশ ঈর্ষণীয় সাফল্য অর্জন করেছে এরই মধ্যে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেনের ভাষায়, জাতীয় সংসদ এবং সরকারে প্রভাবশালী নারী নেতৃত্ব রয়েছে-এমন দেশের একটি বড় উদাহরণ বাংলাদেশ।
বর্তমান জাতীয় সংসদের স্পিকার, প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেতা এবং সংসদ উপনেতা সবাই নারী। ১৯৯১ সালে জাতীয় সংসদে ১২ দশমিক ৭৩ শতাংশের তুলনায় ২০১৫ সালে জাতীয় সংসদে নারীর অংশগ্রহণ ছিল ২০ দমমিক ২৯ শতাংশ। গত সংসদে নারীর জন্য সংরক্ষিত আসন সংখ্যা ৪৫ থেকে বাড়িয়ে ৫০ করা হয়েছে। বর্তমান সংসদে ২২ জন সরাসরি নির্বাচিত নারী সংসদ সদস্য রয়েছেন। যার ফলে সংসদে নারী সংসদ সদস্যের হার বেড়ে ২০ দশমিক ৫৭ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। আইন বিভাগ, বিচার বিভাগ এবং নির্বাহী বিভাগসহ সরকারের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী পদের ক্ষেত্রে নারীদের অধিকতর অংশীদারিত্ব নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে কার্যকর উদ্যোগ প্রক্রিয়াধীন।
জেন্ডার সমতা ও নারীর ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করতে সরকার বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। তবু অনেকে মনে করেন, এসডিজির সব লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে বহুপথ পাড়ি দিতে হবে। তাঁদের মতে, এসডিজি অর্জনের এখনও প্রধান দুর্বলতা তথ্য-উপাত্তের ঘাটতি। অনেক ক্ষেত্রে অগ্রগতি বিচার-বিশ্লেষণ করার মতো প্রয়োজনীয় তথ্য-উপাত্ত পর্যন্ত নেই। বৈষম্য দূরীকরণ, শান্তি ও ন্যায়বিচার, জলবায়ু রক্ষায় ভূমিকা ও কর্মসংস্থান নিশ্চিত করার মতো বিষয়গুলোতে বাংলাদেশের এখনও কার্যকর অগ্রগতি হয়নি। মানুষের পুষ্টি পূরণে কাঙ্ক্ষিত অগ্রগতি অর্জিত হয়নি। দেশে এখনও পাঁচ বছরের কম বয়সী ৩১ শতাংশ শিশু খর্বকায়, ২২ শতাংশ পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুর ওজনস্বল্পতা রয়েছে। নগরে- দারিদ্র্য ও ঘনবসতি, পার্বত্য চট্টগ্রামে- দুর্গম এলাকা, খাদ্য ঘাটতি, ফসলি জমির অভাব, বিভিন্ন সমপ্রদায়ের সাংস্কৃতিক পার্থক্যের কারণে খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন এবং পোশাক শিল্পে- নারীদের কঠোর পরিশ্রম ও অসচেতনতার কারণে পুষ্টি পরিস্থিতির তেমন কোনো উন্নত হয়নি।
লিঙ্গসমতা অর্জন ও নারীর ক্ষমতায়নে যথেষ্ট অগ্রগতি সাধিত হলেও এখনও বেশকিছু চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। তাঁদের মতে সেগুলোর মধ্যে রয়েছে নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতা রোধকরণ, বাল্যবিবাহ প্রতিরোধকরণ, কর্মক্ষেত্র এবং জনসমাবেশে নারীদের জন্য সহায়ক পরিবেশ নিশ্চিতকরণ ইত্যাদি।
বাংলাদেশে নারীর ক্ষমতায়ন বৃদ্ধি পেতে থাকলেও তাদের বিরুদ্ধে শারীরিক, মানসিক ও যৌন সহিংসতার ঘটনা দেশ (৮২ শতাংশ) এবং দেশের বাইরে (১৮ শতাংশ) ব্যাপকহারে বেড়েছে। সহিংসতার উৎস এবং কারণ যেহেতু একাধিক, এগুলো নির্মূল করতে বহুমুখী পদক্ষেপেরও প্রয়োজন। এর মধ্যে পরিবারের অনুপ্রেরণা, সামাজিক সহায়তা বৃদ্ধি, আইনি বিধান প্রয়োগ, নারীর সক্ষমতা বৃদ্ধি, কম খরচে আইনি সেবা, অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতা অর্জন নিশ্চিত করা প্রয়োজন। অন্যদিকে, বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে সরকারের সুনির্দিষ্ট উদ্যোগ এবং দেশের মানুষের আর্থসামাজিক অবস্থান উন্নয়নের কারণে বাংলাদেশে ১৮ বছরের কম বয়সী মেয়েদের বিয়ের হার কমছে। শিক্ষার অভাব, দারিদ্র্য, প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং জলবায়ুর পরিবর্তন, লিঙ্গবৈষম্য, হয়রানি এবং সামাজিক চাপের কারণে সংঘটিত বাল্যবিবাহ রোধে বাংলাদেশ বরাবরের মতো বিভিন্ন আইন, নীতি ও কর্মসূচি গ্রহণ চালু রাখবে। এছাড়া কর্মক্ষেত্র এবং জনসমাবেশে নারীদের প্রতি কটূক্তিমূলক মন্তব্য, টিজিং ইত্যাদি অশোভন ক্রিয়াকলাপ বন্ধে উৎসাহ প্রদান এবং নির্মূল করার জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি।
নারীর প্রতি কটূক্তিমূলক মন্তব্য থেকে বিরত রাখতে সামাজিক সচেতনতা তৈরি এবং প্রেরণা প্রদান, যৌন হয়রানি মোকাবিলায় আইন প্রণয়ন, জনসমাবেশে কটূক্তির (ভিএডব্লিউ) শিকার হলে পূর্ণ আইনি সহায়তা প্রদান এবং জনসমক্ষে প্রকাশ্য শাস্তির বিধান করতে হবে। এর মাধ্যমে নারী সহায়ক কর্মক্ষেত্র এবং জনপরিবেশ নিশ্চিত করার পথ সুগম হবে।