বাঙালি জাতিসত্তার এক সর্বজনীন উৎসব বাংলা নববর্ষ। এই উৎসবকে নিয়ে রয়েছে কত গান, ছড়া, কবিতা, নাচ, শিল্পকর্ম, নানা ফুলের বাহার, নিজেদেরকে নানাভাবে রাঙিয়ে তোলার পোশাক আশাক, কত বিচিত্র ঐতিহ্যের খাবার। অন্যান্য উৎসবের সাথে এই উৎসবের এক আলাদা বৈশিষ্ট্য রয়েছে। ধর্মীয় আবহে উৎসবমুখর বছরের অন্যান্য সময় অনুষ্ঠানাদি হলেও এই নতুন বছরের শুরুতে পহেলা বৈশাখ বাঙালির প্রতিটি ঘরে ঘরে এক আনন্দের বার্তা বয়ে নিয়ে আসে। পুরাতনের সব গ্লানি, ব্যর্থতা, দুঃখ, কষ্ট, জীর্ণতা ভুলে গিয়ে নতুন বছরকে মহানন্দে উচ্ছ্বাসে সুস্বাগতম জানিয়ে বরণ করে নেয়- মঙ্গলময়, সমৃদ্ধময়, সুখময় ও আনন্দময় আগামীর প্রত্যাশায়। তাই ধনী-গরীব, আবাল-বৃদ্ধ-নারী, সকল জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে একত্রিত হয়ে এক প্রাণে প্রাণে মহাপ্রাণের সর্বজনীন বাঙালির মহৌৎসব উদযাপন করে। হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রীষ্টান, মুসলিম, পাহাড়ি বাঙালি এপার-ওপার বাংলার সকলে একাত্ম হয়ে মিলেমিশে একাকার হয়ে অসামপ্রদায়িক ও সমপ্রীতির মুক্ত চিন্তা চেতনায় এই উৎসবে সামিল হয়। মনে হয় এই দিনে হলেও এই কথাটা সবাই প্রতিপালন করি ‘সবার উপর মানুষ সত্য তাহার উপর নাই’। বাংলার ইতিহাস ঐতিহ্যের ধারক বাহক ও জাতীয় চেতনার অবিচ্ছেদ অংশ এই বাংলা নববর্ষ।
একমাত্র এই নর্ববষকে ঘিরে গড়ে উঠেছে বিরাট অর্থনৈতিক কর্মযজ্ঞও। বাংলা নববর্ষের অন্যতম আয়োজন বৈশাখী মেলা। সাদা- লাল পোশাকে এক অনন্য আবহ ফুটে উঠে বাঙালির নারী-পুরুষ, শিশু-কিশোর, বয়োবৃদ্ধ সকলেই দেহ মনে, সাথে নানা রঙের ফুলে নারীর অপরূপ সৌন্দর্য আরো অপরূপ হয়ে উঠে, আর পান্তা ভাতে ইলিশ খাওয়ার ধুম ছড়িয়ে পড়ে সকল বাংলা ভাষাভাষী মানুষের খাবারের তালিকায়, মাটি ও বেতের তৈরী নানা কারুকাজে আকর্ষণীয় কুটিরশিল্প, তৈজসপত্র ও আসবাবপত্রের সংঞ্জামাদির বিরাট সংযোজন ঘটে, ঐতিহাসিক গ্রাম্য মেলাগুলো বর্তমানে বিশাল থেকে বিশালতার রূপ নিয়েছে, লক্ষ লক্ষ অর্থ লেনদেনের অনন্য মাত্রা যোগ হয়েছে। অনেক সময় এই মেলাকে গিয়ে আরো বহুবিধ গ্রাম্য খেলা যেমনঃ বলীখেলা, কুস্তি, নৌকাবাইচ, লাঠিখেলা আয়োজন করা হয়। প্রাচীন গ্রাম বাংলার সংস্কৃতি যেমনঃ পুতুলনাচ, বায়োস্কোপ, নাগরদোলা বেশ উপভোগ্য ও আকর্ষণীয়। এ ছাড়াও থাকে হরেক রকম বৈচিত্র্যময় খাবার দাবারের বিশাল সমারোহ। বাংলা নববর্ষ বাঙালির সর্ববৃহৎ লোকজ উৎসবে পরিণত হয়েছে। পৃথিবীর সর্বত্র বাংলা ভাষাভাষী লোকেরা যে যেখানে আছে সকলে নিজেকে একদিনের জন্য হলেও বাঙালি সাজে সজ্জিত করে তোলে। আধুনিকযুগে অনলাইন ফেইসবুক দুনিয়াই বা সামাজিক যোগাযোগের নানা মাধ্যমে এই দিনে সবার ওয়ালে ওয়ালে শোভা পায় লাল-সাদার অপূর্ব যুগল, পারিবারিক ও সামাজিক আনন্দের অসাধারণ মাধুর্যময় বাঙালিয়ানার উৎসবমুখর মুহূর্তের ছবিসমূহ। তাই এই প্রাণের উৎসব আরো প্রাণবন্ত হয়ে উঠে সকলের কণ্ঠে সমস্বরে বাজে প্রাণের বাঙালি কবি রবি ঠাকুরের কথা ও সুরে ‘এসো হে বৈশাখ এসো এসো, তাপস নিঃশ্বাস বায়ে মুমূর্ষুরে দাও উড়ায়ে বৎসরের আবর্জনা দূর হয়ে যাক যাক যাক এসো এসো……..’।
আমার খুব মনে পড়ে এমন দিনে খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে পরিপাটি হয়ে নতুন কাপড় চোপড় পরে ধর্মীয় কার্যাদি শেষ করে বন্ধু-বান্ধব মিলে চট্টগ্রাম শহরের প্রাণকেন্দ্র ডিসি হিলের সেই লোকগীতি ও লোকনৃত্যের অনুষ্ঠান উপভোগ করে, পান্তা-ইলিশ খাওয়ার জন্য লাইনে ভিড়ের মধ্যে প্রচণ্ড গরমে অপেক্ষা করা, আবার লাল তরমুজের রসে গরমের তপ্ত রোদে কিছুটা স্বস্তি বোধ করে প্রাণের আড্ডায় মাতিয়ে তুলে ভিড় ঠেলে ঠেলে সেই চট্টগ্রাম ফুসফুস খ্যাত সিআরবির শিরীষ গাছের তলায় প্রাণের মিলনে গাছের ছায়ায় আরামে উচ্ছ্বাসে হাসি-ঠাট্টায় আনন্দে দিনটি খুবই ভালো কাটতো। এর আগের দিন ফুল দিয়ে ঘর সাজানো ও পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করা হতো। চৈত্র সংক্রান্তিতে বিশেষ পাঁচমিশালি সব্জি, নাড়ু, মোয়া আর নববর্ষে ইলিশ ভাজা, নানা ধরনের ভর্তা, মিষ্টি, পায়েস ও মুখরোচক খাবারের আয়োজন করা হতো। আর মা-বাবাকে এবং আশেপাশে প্রতিবেশীদের মধ্যে বয়োজ্যেষ্ঠদের পা ছুঁয়ে প্রণাম, সালাম বা আশীর্বাদ নেওয়ার রীতি আমরা প্রতিপালন করেছি। বৈশাখ উৎসবের অংশ হিসাবে আবার বৈশাখের দ্বিতীয় সপ্তাহে মনের আনন্দে নানা আকর্ষণীয় মাটির আর বেতের নানা ঘর সাজানোর উপকরণ সংগ্রহে ছুটে যেতাম লালদিঘির ময়দানে ‘জব্বারের বলীখেলায়’। একবার এক বৌদির সাথে মেলায় গিয়েছি, মেলায় প্রচণ্ড ভিড়ে আমি উনাকে হারিয়ে ফেলি। আমি বয়সে অনেক ছোট হলেও আসা-যাওয়ার পথটা মনে রেখেছি। দুরুদুরু বুকে তখন আমি হেঁটে হেঁটে আন্দরকিল্লা থেকে কালুরঘাটের বাসে চড়ে ঠিকঠাক বাসায় পৌঁছে দেখি ঐ বৌদিসহ আমার মা রীতিমত কান্নাকাটি করে মানুষজন জড়ো করে কিভাবে আমাকে খুঁজবে এমনই চিন্তায় অস্থির! আমাকে পেয়ে আমার মা এমনভাবে জড়িয়ে ধরলো মনে হলো সাত রাজার ধন খুঁজে পেয়েছে। এই হলো অকৃত্রিম ভালোবাসার মূর্ত প্রতীক মা জননী। পৃথিবীর কারো সাথে এমন মমতাময়ী মায়ের তুলনা হয় না। মা তোমাকে নববর্ষের প্রণাম ও ভালোবাসা জানাই দূরপ্রবাস জীবন থেকে।
পরিশেষে এমন প্রাণের উৎসবকে এক শ্রেণীর মানুষ বিতর্কিত করার হীন চেষ্টায় লিপ্ত থাকে। অনেক সময় অপ্রীতিকর, বিব্রতকর ও মর্মান্তিক ঘটনাও ঘটিয়ে আপামর জনসাধারণের আনন্দকে ম্লান করে দেওয়ার অপচেষ্টা করে থাকে। তাই কোনো অপশক্তি যেন আমাদের ঐতিহ্যকে এমন প্রাণের উৎসবকে ধ্বংস করতে না পারে সেদিকে প্রত্যেক বাঙালিকে সচেতন থাকতে হবে। এই দিনটিতে প্রজন্মেরা বাঙালির সঠিক ইতিহাস জানতে পারে। প্রজন্মের সুপ্ত মানবিক মূল্যবোধকে জাগ্রত করে, অসামপ্রদায়িক চেতনায় সমপ্রীতির বন্ধন সৃষ্টি করে। বাংলা নববর্ষ মানুষে মানুষে প্রেম ভালোবাসা মায়া মমতার এক অনিন্দ্যসুন্দর মহানন্দের এক উৎকর্ষ প্রেরণা দান করে থাকে। তাই বাংলা নববর্ষের আয়োজন আরো ব্যাপকতর হয়ে আনন্দে উচ্ছ্বাসে বাংলার আবহমান কৃষ্টি-সংস্কৃতি লোকজ উৎসব সর্বজনীনতায় উজ্জীবিত থাকুক। শুভ নববর্ষ।
লেখক: মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী প্রাবন্ধিক ও প্রাক্তন এনজিও কর্মী